জাতীয় বীরদের অসম্মান এবং ৬০ কোটি টাকা – সুপ্তা বড়ুয়া
১৫ই ডিসেম্বর অটোয়ায় বাকাওভ আয়োজিত বিজয় মেলায় অংশগ্রহণ করেই মেজাজটা বেশ ফুরফুরে ছিলো। অনুষ্ঠানে নানা আয়োজনের ফাঁকে ফাঁকে কথা হচ্ছিল একজন পরিচিত ভাইয়ের সাথে। বলছিলাম, ‘ভাইয়া, আমি শঙ্কিত, মৌলবাদীগোষ্ঠী এখনো সক্রিয়’! উনি আমাকে আশ্বস্ত করছিলেন, ‘না, তারা অনেক বেশি চাপের মধ্যে আছে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের আর মুক্তচিন্তার মানুষরাই বোধয় এখন বাড়ছে’। আমার কথাটি যদি মিথ্যে হতো তবে আমিই বোধয় সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। কারণ তার পরদিন সকাল বেলা উঠেই খারাপ সংবাদটা দেখলাম।
কি দেখলাম? মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় এ বছর বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছে। আর এ তালিকার বৈশিষ্ট্য(???) হলো গ্যাজেটেড মুক্তিযোদ্ধাদের নাম রাজাকারের তালিকায় এসেছে। সকালবেলা দেখেই তো আমার মনে হলো, জুতো দিয়ে কেউ গালে বারী দিয়েছে বিজয় দিবসের সকালে। এ তালিকার উল্লেখযোগ্য দুটি নাম বাসদ নেতা মুক্তিযোদ্ধা তপন চক্রবর্তী আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের কৌশলি গোলাম আরিফ টিপু। আমার ছোট্ট মগজে সঙ্গে সঙ্গে এলো, এটি কোন বিশেষ মহলের উদ্দেশ্য প্রণোদিত কাজ। কিন্তু ফেসবুক জুড়ে দেখলাম, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে, হিন্দুদের নিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কথাবার্তা আর প্রশ্ন তোলা হলো ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, একুশে পদকপ্রাপ্ত গোলাম আরিফ টিপু'র কাজ নিয়েও। (তথ্যসূত্রঃ যুগান্তর, ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৯)
তপন চক্রবর্তী, তালিকায় ৬৩ নাম্বারে আর ৬৫ নাম্বারে রয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সুবীর চক্রবর্তী’র স্ত্রী আর মুক্তিযোদ্ধা তপন চক্রবর্তী’র মা উমা চক্রবর্তীর নাম।(তথ্যসূত্রঃ সমকাল ১৭ই ডিসেম্বর) তপন চক্রবর্তীর কন্যা ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী, ফেসবুকে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। সুপরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী’র মতো একজন জনদরদী নেত্রী আর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে বিজয় দিবসে এমন দায়িত্বহীন উপহার দিলো মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। তাছাড়া এই মন্ত্রণালয় বাসদ আর ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য দলের নেতা যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদেরকে তালিকাভুক্ত করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে বলে অন্য একজন বাসদ নেতার কাছে জানতে পারলাম। মুক্তিযুদ্ধ কোন একক রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিমালিকানা ছিলো না, সব দল আর মতের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এ যুদ্ধ সফল হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই এমন একটি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিবো বিজয় দিবসের দিন। জাতিকে বিভক্ত করা আর খোদ মন্ত্রণালয়েরই কাজকর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই মূলত এর উদ্দেশ্য। আমার তো মনে হলো, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিই বোধয় অক্টোপাসের মতো কব্জা করে ফেলেছে এ মন্ত্রণালয়টি। এমন একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের পর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির মন্তব্য আরো বেশি ক্ষোভ সৃষ্টি করবে যে কারো মনে। রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গণমাধ্যমকে বলেন, 'আমরা নিজেরা কোনো তালিকা প্রস্তুত করিনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যে তালিকা করেছে, আমরা শুধু তা প্রকাশ করেছি। সেখানে কার নাম আছে, আর কার নাম নেই সেটা আমরা বলতে পারব না।' (তথ্যসূত্রঃ কালের কন্ঠ, ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৯)। তাছাড়া একটি সামান্য পেনড্রাইভের তথ্য পেয়ে এ তালিকা প্রকাশ এবং এই কাজের জন্য বিএনপিকে দায়ী করাসহ নানা হাস্যকর মন্তব্য তো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী করেই চলেছিলেন।
অনেকের কাছেই হয়তো ব্যাপারটা ছেলে খেলা বা তামাশা মনে হতেই পারে, কিন্তু কোন কোন পরিবার এ আত্মসম্মানটুকু নিয়েই বেঁচে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সহচয় মো. মুজিবুল হকের নামও সদ্য প্রকাশিত তালিকায় এসেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই ‘হক চাচা' বলে সম্বোধন করতেন মানুষটিকে। এ রকম একটি সংবাদে মুজিবুল হকের পরিবার লজ্জায় অপমানে কি করবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না। মুজিবুল হকের বৃদ্ধা স্ত্রী এবং পরিবারবর্গ এ শোকে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেন, এমনটিই তথ্য দেন মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হকের সন্তান এ্যাডভোকেট রেজাউল হক শাহীন। (সূত্রঃ channelionline.com, ১৭ই ডিসেম্বর, ২০১৯)
তারপরও যদি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ বিষয়ে ক্ষমা চেয়ে তরিৎগতিতে এটা সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন তাও একটা কথা ছিলো। উল্টো মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন করে রাজাকারের লিস্ট থেকে নাম সরানোর কথাও বলা হয়েছিলো। এসব নাটক কে বা কারা করছে? কাদের অভিসন্ধি জড়িত আছে এর পেছনে? মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদেরই বা অতীত ইতিহাস কি? বিজয় দিবসকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই কি এদের কাজ? খোদ স্বাধীনতার স্বপক্ষের রাজনৈতিক দল বলে যারা নিজেদের দাবী করে সেই সরকার ক্ষমতায় থাকতে এমন ন্যাক্কারজনক একটি ঘটনাই বা ঘটে কি করে? বিজয় দিবসের দিন মুক্তিযোদ্ধাদের যথেষ্ট অপমান তো হয়েছে, আর নাই বা করলেন। এসব মুক্তিযোদ্ধারা কোন সুবিধা লাভের আশায় সেদিন দেশ রক্ষার্তে ঝাপিয়ে পড়েন নি। আর যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলো তারা এত লাভ-ক্ষতির হিসেবও করেন নি। এটি জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব উনাদের সম্মান আর প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া। কিন্তু উল্টো আমরা তাদের অপমান অপদস্ত করছি। এটাই কি ৪৮তম স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য?
মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত নানা টালবাহান করে লিস্টটি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ কোটি টাকা। দরিদ্র জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকার দায়িত্বজ্ঞানহীন এমন একটি কাজ করে জনগণের মাঝেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে দিলো। টাকা দিয়ে এ লিস্ট হয়তো সরিয়ে ফেলা সম্ভব হলে, কিন্তু যেসব সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাদের জনগণের সামনে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেওয়া হলো, তার সমাধান কি হবে? ইতিমধ্যে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি, সেসব নিয়েই এখন মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকার দুটো নিয়ে নানা রাজনীতি শুরু করে দিয়েছে। সরকারের এমন কাজের ফল ভোগ করবে মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবার। ৬০ কোটি টাকায়ও তাদের হারানো সম্মান হয়তো ফেরানো যাবে না।
সুপ্তা বড়ুয়া । অটোয়া, কানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
19-12-2019
-
-