নারীর প্রতি সহিংসতা ও আমাদের মন-মানসিকতা – সুপ্তা বড়ুয়া
মাঝে মাঝে মনে হয়, এর চেয়ে যদি অন্ধ হয়ে যেতাম, বধির হয়ে যেতাম তবেই বোধয় ভালো ছিলো। পৃথিবীর এ রূপ দেখতে হতো না। আমাদের সমাজের এ জঘন্যতর রূপ ধারণ করছে। আর আমরা একটা মেকি ‘হাম বড়' ভাব নিয়ে বুক ফুলিয়ে চলেছি! আদৌ কি আছে গর্ব করার মতো আমাদের? যে সমাজে, যে দেশে নারীদের সম্মান নেই, সেটা আদৌ কি সভ্য সমাজ?
ভারতের হায়দ্রাবাদে ডাঃ প্রিয়াঙ্কা রেড্ডিকে ধর্ষণ করার পর পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কারণ ধর্ষিত নারী তো এমনিতেই আর সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়, নাকি? খবরে জানা যায়, তিনজন সামান্য পথচারী একজন ডাক্তারকে মেরে ফেললো। তার মানে নারী সে যতই উচ্চতর পদে যাক না কেন, একজন সাধারণ পুরুষের তুলনায় তারপরও সে কিছুই নয়। কারণ নারীটির রয়েছে যোনী আর পুরুষটি যতই ক্ষমতাহীন হোক না কেন, তার তো শিশ্ন রয়েছেই! আপাত দৃষ্টিতে এটা পুরুষদের সাধারণ যৌনতা নিবারণের উপায় মনে হলেও আদতে ধর্ষণের পেছনের মূল কারণ আধিপত্যবাদ! নারী সে যতই কষ্ট করে নিজের একটা পরিচয় দ্বার করাক না কেন, আদতে পুরুষের তুলনায় কিছুই নয়। আর চারজন নরপশু মিলে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে হত্যা করে ফেললো ধর্ষণ শেষে। আর এদিকে সাধারণ জনগণ ধর্ষণের বিচার চাইলেও পর্ণ সাইটে গিয়ে খোঁজে সেই ধর্ষণের ভিডিও! সাবাশ, মহামান্য সমাজ!
২০১২ সালের ডিসেম্বরের সেই চাঞ্চল্যকর ‘নির্ভয়া’র বাস ধর্ষণের কথা মনে আছে? মেয়েটিকে বাস ড্রাইভারসহ আরো ৫ জন মিলে ধর্ষণ শেষে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে তাকে আর তার বন্ধুটিকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিলো। দু'সপ্তাহ মৃত্যুর সাথে লড়ে মেয়েটি মারা যায় আর তার বন্ধুটি কোন মতে প্রাণে বেঁচে আছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ভারতীয় বংশোদ্ভূত লন্ডনে লেখাপড়া করা এক সাংবাদিক ওই খুনীদের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলো, যেখানে খুনীরা তো তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী বা অনুশোচনা করেই নি বরং বলেছিলো, মেয়েদের এভাবে ঘরের বাইরে যাওয়া উচিত নয়। আর গেলে ওদের রেপ হওয়াই উচিত। ধর্ষণ যুগ যুগ ধরে আধিপত্যবাদেরই নমুনা, যার কারণে বাংলাদেশেও আধিবাসী শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এখানেও একটি সমাজে ভীতি সৃষ্টি করতেই ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সমাজের অশিক্ষিত শ্রেণীর মানুষের মনমানসিকতা নারীর প্রতি এটি হলেও কম বেশি শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই মনে করে নারীর স্বাধীনতার একটা লিমিট থাকবে। দেখি সাধারণ মানুষের কি মন-মানসিকতা নারীর প্রতি।
নারীরা ঘরে বাইরে ব্যাপকভাবে অত্যাচারের শিকার হচ্ছে, তারপরও সবাই বলে নারীর'ই নাকি ক্ষমতা! আমাদের চারপাশে এমনভাবে সব অত্যাচার নারীদের উপর কেন হচ্ছে? নারীকে মানুষ প্রায়শই মমতাময়ী, অবলা, দূর্বল হিসেবে দেখতেই পছন্দ করে। এর বাইরেই যে নারী তার এই বহুযুগের খোলস ছেড়ে বেরোতে চেয়েছে, দেখা যায় তাকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। নারীর অগ্রযাত্রায় প্রথম বাধা আসে ঘর থেকেই, পরিবার থেকেই। পরিবারে মেয়ে সন্তান হওয়া মানেই ‘পরের জিনিস' বড় করছি। একবার এক আত্মীয়কে বলেছিলাম, কেন তাদের মেয়ে এত ছোট বয়সে বিয়ে দিয়ে ফেলছে, মেয়েটির বয়স তখন বোধয় ১৬/১৭। উত্তরে ওই আত্মীয়টি বলেছিলেন, ‘যার যার জিনিস তার তার হাতে তুলে দেওয়া ভালো’। এটা বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারে তাদের কন্যাদের নিয়ে ভাবনা। অর্থাৎ নারী মানেই বস্তু, তাকে কারো হাতে তুলে দিতে হয়, গচ্ছিত রাখতে হয়। আপনি ভাববেন এটা তো গ্রামের মানুষের ভাবনা! আচ্ছা, যেই সাংবাদিকটি সেদিন সৃজিত-মিথিয়ার বিয়ের খবরে মিথিলাকে ‘মাল’ বলে সংবোধন করেছিলেন, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তো কারো মনেই প্রশ্ন আসতে পার? কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত সবার নজরেই নারী বস্তু!
তারপরও তো নারী সমাজে প্রতি পদে পদে কত বাধার সম্মুখীন হয়ে একটা অবস্থানে পৌঁছায়, কত অপমান-অত্যাচার সহ্য করে নারী একটা অবস্থান তৈরি করছে। কিন্তু যেহেতু তার একটা যোনী রয়েছে, সে আদতে কোন ছুঁতো পুরুষদের কাছে। তারপরও যদি নারীরা তার গন্তব্যে পৌঁছায়, সে সমাজে পরিচিতি লাভ করে হয় বেশ্যা নয় বেবিচারী হিসেবে। নারীর প্রতি এ প্রতিহিংসার ভয়াবহরূপ কি শুধু ধর্ষণ, নারীকে সমাজের প্রতি স্তরে স্তরে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে, সেটাও কি ধর্ষণের চেয়ে কম? এসব ঘটনায় মনে হতেই পারে নারীর সবচেয়ে বড় বাধা পুরুষ শুধু। আসলে নারীর বাধা শুধু পুরুষ নয়, পুরুষতান্ত্রিক নারীও, আদতে পুরুষতন্ত্রটাই এমন যেটার মূল লক্ষ্যবস্তু হলো, দূর্বলকে আঘাত করা, অবদমিত করে রাখা, ক্ষমতা যার হাতে সে চাইলেই সব করতে পারবে।
আরো দুটো ঘটনা বলিঃ
১) একবার এক চরম নারীবাদীই বলছিলেন অন্য একজন নারী সম্পর্কে যে, অমুকের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি তো বেশ আফসোস করলাম। আমি বললাম, অমুক (সেই মেয়েটি) তো কর্মজীবনে বেশ ভালো অবস্থানে পৌঁছেছে। আমার চরম নারীবাদী বন্ধুটিই বললো, ‘সে তো বসদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় যেতো, তাই খুব তাড়াতাড়ি প্রমোশন হয়েছিলো। আর এদিকে সংসার ভেঙে গেছে’। আমার তো আবার কথা আটকায় না মুখে, বলেই ফেললাম, নারীর সাফল্য সবসময় অন্য একটা দরজা দিয়েই আসে মনে করে সমাজ তা সে যতই যোগ্য, পরিশ্রমী আর সৎ হোক না কেন। আমার সেই নারীবাদী বন্ধুটির সাথে তারপর আমার আর কথাই হয় নি।
২) আমার একজন সহপাঠীনি জীবনে বেশ সম্মান অর্জন করেছে। বর্তমানে প্রবাসে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সে। তো সেদিন আমাদের স্কুলেরই এক সিনিয়র আপু’র সাথে হঠাৎ ফেসবুকে আলাপ হচ্ছিলো। উনি বার বার আমি কোন ব্যাচের জানতে চাইছিলেন, যেহেতু আমি কোনভাবেই উনাকে বোঝাতে পারছিলাম না, কোন ব্যাচের তাই সহপাঠিনীর নাম বললাম। সঙ্গে সঙ্গে ওই মহিলা বলে উঠলো, ‘ওর কিন্তু ডিভোর্স হয়ে গেছে’। কথাটা আমার কানে বেশ জ্বালাই ধরালো। বলে ফেললাম, ‘আমারও কিন্তু ডিভোর্স হয়েছে। আপনি যেহেতু ডিভোর্সটাকে এত বড় করে দেখাতে চাইছেন'। অফিসে ছিলাম বলে তখন বেশি কথা হয় না। বিকালে ফিরে আবার কল দিয়েছিলাম, উনি ধরেন নি। জানি আমার ফোন ধরার সাহস উনার আর হয়তো হবে না।
নারীর কোন সাফল্য তার পরিশ্রমে আসে না, আসে তার চাতুরতায়? নারীর কোন অর্জনই পর্যাপ্ত নয়, যদি তার সংসার ভেঙে যায়? তাহলে, আপনারা যারা ঘরে বসে একজন নারীর ধর্ষণের বিরুদ্ধে এত বক্তৃতা দিয়ে যান, উপরে উপরে নারীর জন্য কেঁদেকেটে বুক ভাসান, আপনারাও দিন শেষে সমাজকে নারীর জন্য কন্টকময় করে তুলছেন না? নারীর প্রতি এ হিংসা বড় তীব্র ভয়ঙ্কর, যেভাবে নারীকে বাধাগ্রস্ত করছে সমাজ ধর্ষণ করে, আপনারাও দিনশেষে যারা নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করছেন নারীর সমালোচনা করে, নারীর নানামুখী দোষত্রুটি খুঁজে খুঁজে আপনারা এক একজন কি? সমাজে এই যে নারীকেই যে কোন ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে হবে, তারই বা কি প্রতিকার? স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শারমীন রূম্পা খুন হলো দিনেদুপুরে, ফেসবুক সয়লাব হয়ে গেছে মেয়েটাকে গালাগাল দিয়ে। কারণ, সে প্রেম করেছিলো।
সেদিন আরেকজন বলিউড পরিচালক না কে জানি বললো, হত্যা থেকে বাঁচতে নারীর রেপ হতে সাহায্য করা উচিত। আর রেপ নাকি লিগেল করা উচিত। এই লেখাটি পড়ে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ওই লেখায় সমাজের একজন শিক্ষিত নারীর মন্তব্য পড়ে আমি তারচেয়েও বেশি হতবাক। একজন মন্তব্য করলো, ‘I would rather get killed than raped'। আসলেই? আমার জীবনটা তুচ্ছ আমি ধর্ষিত হলেই? ধর্ষণ কি শুধু শারীরিকভাবেই হয়, মানসিকভাবে হয় না? সমাজে প্রতিনিয়ত আমরা গালি খেয়ে যাচ্ছি, প্রতিনিয়ত আমাদের জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে আমাদের কাজের জন্য, এসব কি ধর্ষণ অপেক্ষা কম ভয়াবহ? দিল্লির এক নারীবাদী বলেছিলেন ‘আমার সম্ভ্রম আমার যোনীতে নয়, যেমনটি আমি বিশ্বাস করি পুরুষের মস্তিষ্কও তার শিশ্নতে নয়’। যতদিন নারীর সম্ভ্রম তার যোনীতে থাকবে ততদিন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নারীর অগ্রযাত্রায় তার চরিত্র হয়ে উঠবে মুখ্য, তার পেশাগত জীবনের চেয়ে তার পারিবারিক সংসার জীবন নিয়েই হবে বেশি আলোচনা, ততদিন নারী বিয়ে করলে ‘মাল’ নামে অভিহিত হবে, রাজনৈতিক কারণে স্বামী খুন হলে নারীর চরিত্র নিয়েই মিডিয়া পাড়া গরম থাকবে, সন্দেহবাতিক স্বামী আত্মহত্যা করলে স্ত্রীকেই জেলে যেতে হবে, আর দিনদুপুরে বিডিং থেকে ফেলে হত্যা করলে নারী হবে দুশ্চরিত্রা। একটি নারীবান্ধব সমাজ হয়তো আমরাও দেখে যেতে পারবো না। কিন্তু সেই সমাজ বিনির্মাণে আমার এই প্রতিবাদ দিঘীতে এক ফোঁটা জল হিসেবে হলেও দিয়ে গেলাম।
সুপ্তা বড়ুয়া । অটোয়া, কানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
29-12-2019
-
-