অটোয়া, রবিবার ৫ মে, ২০২৪
ইউরোপের পথে পথে ( শেষ পর্ব) – দীপিকা ঘোষ

ঊনিশ পর্বঃ ভেনিসের পুরো দৃশ্যপট এখনো চোখের ওপর ভাসছে। সবচাইতে বিস্ময়কর লেগেছিল সাগরের জলে ভাসমান দ্বীপরাজ্য দেখে। ভেনিস শহর উত্তরপূর্ব ইটালির ভ্যানিটো অঞ্চলের দ্বীপরাজ্যের রাজধানী। সেখানকার পর্যটন শেষ করে আমরা আপাতত রোমের ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ইন্টারন্যাশনাল’ এয়ারপোর্টের ইনফরমেশন ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে। গন্তব্য লণ্ডনের গ্যাটউইক এয়ারপোর্ট। কিছুক্ষণের মধ্যেই চেক-ইন কাউন্টারে লাগেজ চেকিং হয়ে গেল। পাসপোর্ট এবং টিকেট চেক করে বোর্ডিংপাস দেওয়া হলো সবাইকে। এবার বহির্গমন গেটের দিকে লম্বা প্যাসেজ ধরে হাঁটা শুরু। লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই একসঙ্গে চলছিলাম। ইটালির ব্যস্ততম বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য।
     হঠাৎ পাশের থেকে একজনের হাঁক শোনা গেলো-
     আমেরিকান পাসপোর্ট যাদের, তারা বাঁদিকের লাইনে চলে এসো।
     সিকিউরিটি অফিসার পাসপোর্ট চেক করতে গিয়ে সংশয়ভরা চোখে তাকালেন-
     তোমরা রোমে কখন এসেছিলে? পাসপোর্টে কোনো এন্ট্রি সিল দেখছি না তো!
     আমরা ফ্রান্স থেকে ট্রেনে করে এসেছিলাম। ঘোষ সোজাসুজি উত্তর দিলো।
     ওঃ তাই বলো!
     ট্রেনের টিকেট অবশ্য সঙ্গে রেখেছি। দেখতে চাও?
     নাঃ ঠিক আছে। বলেই অফিসার পাসপোর্টের পাতায় সিল মেরে দিলেন।
     বুদ্ধিটা কণিষ্কই দিয়েছিল-
     ট্রেনের টিকেটগুলো নষ্ট করো না মেসো। এয়ারপোর্টে কাজে লেগে যেতে পারে। ইউরোপে ফ্রি মুভমেন্টের জন্য টেরোরিজম বাড়ছে। আজকাল তাই এয়ারপোর্ট কাস্টমসও বেশ কড়া হয়েছে।
     সত্যিই তাই। ইউরোপে অবাধ চলাচলের ক্ষেত্রে টান্সপোর্ট সিস্টেমের ইতিবাচক দিক যতই থাক এর সবচাইতে বড় নেতিবাচক দিক হলো, মুক্ত চলাচল পদ্ধতির জন্য জঙ্গিদের পক্ষে খুব সহজে ইউরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। সেই কারণেই জঙ্গি আমদানি বাইরে থেকে যতটা না হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি জন্মানো হচ্ছে স্বয়ং ইউরোপের মাটিতেই। প্লেনে ঢোকার প্যাসেজটা মোটেই সুবিধের নয়। অসম্ভব বদ্ধ জায়গায় রাজ্যের লোক ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে। অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। এক অবোধ শিশু কাঁদতে আরম্ভ করে দিলো। ফিসফিসানি শোনা গেলো শুচির গলায়-
     ও ঠিকমতো ব্রিথ করতে পারছে না! সবার ওকে একটু স্পেস দেওয়া উচিৎ!
     ওর মা ওকে একটু উঁচু করে ধরলেই তো পারে! দেশে হলে আমিই তুলে ধরতাম! কিন্তু এখানে তো সেসব চলবে না!
     পাশে দাঁড়ানো ব্রিটিশ তরুণের কথায় বিরক্তি ঝরে পড়লো-
     লাইন মুভ করছে না কেন? ফ্লাইট কি এখনো রেডি হয়নি? দিস ইজ টেরিবল! তার হাতে বাঁশির মতো দেখতে একটি ছোট্ট চাইনিজ মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট।
     পনেরো মিনিট রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পরে প্লেনের ভেতরে প্রবেশ করা গেলো। বাইরেটা যতখানি অস্বস্তিরই হোক আসনে বসার পরে মাথার ওপর মৃদু হাওয়ার পরশ পেয়ে স্বস্তি ফিরে এলো। আজ অবশ্য সূর্যস্নাত ঝলমলে দিন নয়। আকাশ জুড়ে থোকাথোকা ধূসর নীল ফুলের মতো গুচ্ছগুচ্ছ মেঘ ছড়িয়ে রয়েছে। জানালা দিয়ে চোখে পড়ছে চারপাশটা সবুজ স্নিগ্ধতার বদলে কঠিন, পাণ্ডুর। ডানপাশের ভদ্রমহিলা বিরামহীন লিখে যাচ্ছেন একটি ভারি ডায়েরির পাতায়। সেটা এমনই অখণ্ড মনোযোগে যে, চারপাশের কোনো কিছুর অস্তিত্বেই আগ্রহ নেই তার।
     কেবিন ক্রু অ্যালিজান্ডর প্রচলিত তথ্যনির্দেশগুলো যাত্রীদের শুনিয়ে চলেছেন একের পরে এক। হঠাৎ বললেন-
     প্লেনে ইলেকট্রনিক সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ।
     শুনেই মনে পড়লো স্কটল্যাণ্ডের রাজপথের সেই দৃশ্য। যুক্তরাজ্যের মধ্যে স্কটল্যাণ্ডে ধূমপায়ীদের সংখ্যা সর্বাধিক কিনা জানি না। তবে সেখানেই বেশি ভিখারি আর পোড়া সিগারেটের জড়ো করা টুকরো চোখে পড়েছিল আমাদের। কয়েকতলা উঁচু বিল্ডিং-এর পাশ দিয়ে শুচির জননীর সঙ্গে সেদিন হাঁটছি, হঠাৎ সে বললো-
     একটি আজব দৃশ্য তোকে দেখাচ্ছি, ওই দ্যাখ!
     দেখি একটি দশাসই গাছের গায়ে হাতের নাগালের মধ্যে গামলার মতো সিরামিক পাত্র আটকে রাখা হয়েছে। আর সেটি থেকে উপচে পড়ছে শত সহস্র পোড়া সিগারেটের খণ্ডবিখণ্ড টুকরো। শুচির মা ফের বলতে শুরু করলো-
     আজকাল এখানে টোবাকো সিগারেটের পরিবর্তে অনেকেই ইলেকট্রনিক সিগারেট খাচ্ছে। তাতে নাকি তামাকের ভেতর যে ধরনের ক্ষতিকর টক্সিক কেমিক্যাল থাকে, সেটা থাকে না।
     সত্যিই?
     নিকোটিন থাকে না। কিন্তু ক্ষতিকর কেমিক্যাল তো থাকেই! আমেরিকায় এখনও F.D.A (ফুড এণ্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) এই সিগারেট অনুমোদন করেনি!
     সহযাত্রিনী এতসময় পরে সিটবেল্ট খুলতে গিয়ে আমার মুখে সহাস্যে তাকালেন। সুযোগ হাত ছাড়া না করে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলাম-
     তুমি বুঝি লেখিকা?

     সে রকম কিছু নয়। তবে ডায়েরি লিখতে ভালোবাসি। পেশায় সাংবাদিক। ভেনিসে গিয়েছিলাম প্রোজেক্টের কাজে। তাই সব বিস্তারিত লিখে রাখছি।
     ভেনিস? আমরাও তো ভেনিস থেকে ফিরছি। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না।
     কী?
     দেড় হাজার বছর আগে কোন প্রযুক্তিতে জলের ভেতর এভাবে শহর তৈরী করা সম্ভব হয়েছিল?
     প্রচুর কাঠ ফেলে তার ওপর মাটি দিয়ে প্রথমে ফাউণ্ডেশন তৈরী করা হয়েছিল। তারপর ঘরবাড়ি হয়েছে।
     কাঠ ফেলে? কিন্তু সে কাঠ কি পচে যায়নি এতদিনে?
     নাঃ! সেটাই বিরাট রহস্য! তবে ভেনিস ধীরে ধীরে তলিয়ে গেছে প্রতি একশো বছরে নয় ইঞ্চি করে! বলা হচ্ছে, আর একশো বছর পূর্ণ হবার আগেই ওটা তলিয়ে যাবে!
     প্রতি একশো বছরে মানে? তার মানে শুরু থেকেই..?
     হ্যাঁ। কারণ এখানকার দ্বীপগুলো প্রত্যেকেই ভাসমান! নিচের জলের প্রেসারে এদের ভেসে থাকা। কিন্তু যখনই তাতে ওজনের চাপ বেড়ে গেছে তখন তো আর সেটা সম্ভব নয়।

     ভেনিসের আগাগোড়া ইতিহাস এরপরে বিস্তারিতই জানা হলো। ছোট ছোট ১০০টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত ভ্যানিটো অঞ্চল অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের এক উপদ্বীপ। এই অঞ্চলের তলিয়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ নাকি, আশেপাশের অঞ্চলের শিল্পকারখানার কাজে প্রচুর পরিমাণে মাটির নিচেকার জল ব্যবহার করা। আণ্ডারগ্রাউণ্ডে সঞ্চিত জলের পরিমাণ কমতে থাকায় নিচ থেকে আসা জলের প্রেসার কমে যায়। ফলে ভেনিস আরও বেশি জলনিমগ্ন হয়ে পড়ে। গত কয়েক যুগ হলো মাটির নিচেকার জলের ব্যবহার কমিয়ে আনা হয়েছে।
     যাই হোক, ভ্যানিটো অঞ্চলের সবগুলো দ্বীপরাজ্যের রাজধানী হচ্ছে ‘ভেনিস’। খ্রীষ্টিয় পঞ্চম শতাব্দীর গোড়ায় ইটালি আক্রান্ত হলে রোমরাজত্বের পতন শুরু হয়। অজস্র সাধারণ মানুষ প্রাণভয়ে পালিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপদ্বীপ অঞ্চলে। কিন্তু এ স্থান বসবাসের উপযোগী ছিল না। তাই প্রথমে বড় বড় ক্যানাল তৈরী করে জলমগ্ন অঞ্চল থেকে কিছুটা জল সরানো হয়। তারপর প্রচুর কাঠ ফেলে ক্যানালের মাটি দিয়ে উঁচু করে গড়ে তোলা হয় জনপদ। গভীর ক্যানালের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থায় গাড়ি চলাচল নেই। নৌকো অথবা জল ট্যাক্সিই (স্থানীয় ভাষায়, মোটোস্কাফি) একমাত্র বাহন। দু’চারটি দ্বীপে ফুটব্রিজও ব্যবহৃত হয়।
     সাংবাদিকের নাম ভার্জিনিয়া কারসন। স্কটল্যাণ্ডের মানুষ। সদ্য স্কটল্যাণ্ড ঘুরে এসেছি জেনে খুশি হয়ে জানতে চাইলো-
     ওখানে কোথায় কোথায় ঘুরলে?
     অনেক জায়গায় ঘুরেছি। তবে বেশি সময় নিয়ে দেখেছি রাজধানী এ্যাডিনবোরার ক্যাসল আর ন্যাশনাল মিউজিয়াম!
     মিউজিয়ামের কথা শুনেই উত্তেজনা ছড়ালো ভার্জিনিয়ার কণ্ঠস্বরে-
     মিউজিয়ামে? তাহলে ওই ক্লোনড ভেড়াটা নিশ্চয়ই দেখেছো? ডলি দ্য শিপ?
     হ্যাঁ, হ্যাঁ! ওর ইতিহাসটাও পড়ে এসেছি!
     ওই সময়টায় মানে ১৯৯৬-র ৫ই জুলাই, ডলির যখন রিপ্রডাকটিভ টেকনোলজিতে জন্ম হয়, রোজ খবরের কাগজে লিখেছি, জানো? সারা বিশ্বে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল!
     সত্যি ভাবা যায় না! ফার্টিলাইজড এগ থেকে তৈরী করা হলেও কথা ছিল! কিন্তু তাই বলে একটা ভেড়ার টিস্যু সেল থেকে আরেকটা ভেড়ার জন্ম নেওয়া? কী সাংঘাতিক ব্যাপার সেটা!
     কথা বলতে বলতে মনে পড়ে গেলো আমাদের অমূল্য সম্পদ মহাভারতের গান্ধারীর শতপুত্রের কথা। তাদেরও নাকি গান্ধারীর দেহের টিস্যু সেল থেকেই গবেষণাগারে জন্ম হয়েছিল। সহস্র সহস্র বছর আগে প্রাচীন ভারতে যেটা হয়েছিল, এখন সেটা পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত হচ্ছে। কিন্তু ডলির জন্মের পরে সৃষ্টিতত্ত্বে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কোনো যুক্তিতেই ‘ক্লোনিং’ পদ্ধতিকে প্রশ্রয় দেননি জগৎহিতৈষী হৃদয়বান মানুষগুলো। কারণ এতে যে কেবল সমাজসংস্কৃতির সুশৃঙ্খল ভাবনাগুলোই প্রচণ্ডভাবে ব্যহত হবে তাই নয়। ভবিষ্যৎ মানুষের জীবনও প্রকৃতির নিয়মের বাইরে দাঁড়াতে গিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে সম্পূর্ণভাবে।

কুড়ি পর্বঃ আজ সবার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় মানসিক পরিস্থিতির চেহারা বাঁক নিয়েছে অন্যদিকে। ইউরোপ ভ্রমণ শেষ করে এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা। আজ বিমানবন্দরে নামিয়ে দিতে শুচির জননী এসেছে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। সিকিউরিটি পার হয়ে চলতে চলতেও শেষবার পেছন ফিরে তাকালাম। নিজের অশ্রুভরা চোখেও ধরা দিলো ওদের জলে ভাসা চোখগুলো। অভিজ্ঞতা বোঝাই হয়ে, স্মৃতির জেমসে অন্তর ভরে হয়তো আরও কয়েকটা দিন এভাবেই চলতে থাকবে স্মৃতি রোমন্থনের পালা। তারপর ফের প্রাত্যহিক জীবনের স্রোতে ভেসে, অভ্যস্ত হয়ে উঠবো প্রতিদিন। এও তো ভ্রমণযাত্রারই আরও একটি মেরুপথ।
     মন বললো-
     জীবন মানেই তো অন্তহীন ভ্রমণযাত্রা। অন্তহীন কাল ধরে বার বার আসা যাওয়া প্রত্যেকের। আর সেখানেও অভিজ্ঞতা বোঝাই হয়ে, বার বার এভাবেই আনন্দ-বেদনার হাত ধরে জীবন থেকে জীবনান্তরে, অন্তহীন পথ চলা! কারণ, জীবনের যাত্রাপথের হয়তো সত্যিই কোনো গন্তব্যস্থল থাকে না! সমাপ্ত

দীপিকা ঘোষ । ওহাইয়ো, আমেরিকা