পুরুষ এবং পুরুষ -প্রকাশ চন্দ্র রায়
খুব কষে প্রথম থাপ্পড়'টা মারা'র পর দ্বিতীয় থাপ্পড় মারা'র আর কোন সুযোগ পেল না সুনীতা। হঠাৎ প্রচন্ড ঝাঁকি দিয়ে টলে উঠলো চলন্ত বাস গাড়িটা। তারপর ডোরছেঁড়া ঘুড়ি'র মত টালমাটালভাবে দুলতে দুলতে তিন উল্টান দিয়ে গড়িয়ে পড়লো রাস্তার নীচের জমিতে।
পূজার বোনাসসহ প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে লোকাল বাসে চড়ে বাড়ি ফিরছিল সুনীতা সরকার। বাসে প্রচন্ড ভীড় থাকায় বাধ্য হয়ে ভীড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতে হল তাকে। দু'পাশে দাঁড়ানো মহিলা পুরুষের চাপে দমবন্ধ অবস্থায়ও ভ্যানিটি ব্যাগে রাখা টাকার প্রতি বিশেষ নজর রেখে আসছে সে। এমতাবস্থায় ভীড়ের ফাঁকে কে যেন কনুই দিয়ে বারবার গুতো মারছে তার ডান স্তনে। প্রথম প্রথম মনে করেছিল ভীড়ের চাপে কোন মহিলার কনুই হতে পারে কিন্ত একাধিকবার একই ঘটনা ঘটায় আড়চোখে তাকিয়েই চিনে ফেলল সে লোকটাকে। ঠিক বখাটেও বলা যাবে না তাকে, পোশাকে আশাকে চেহারা সুরতে মোটামুটি ভদ্রলোক'ই বলা যায় লোকটাকে। বয়স আন্দাজ পয়ত্রিশ চল্লিশ হবে। ঘৃণায় রি, রি, করে উঠল সমস্ত দেহমন তার। ভাবলো, শুধু টাকা নয় নিজ দেহকেও আগলে রাখতে হবে তাকে। এসব ভাবনার মাঝেই এবার আর কনুই নয় সরাসরি হাত চালিয়ে দিল কথিত ভদ্রলোক, বিধায় রাগে অন্ধ হয়ে খুব কষে প্রথম থাপ্পড়টা মেরেছিল সে।
পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরে পেল সুনীতা। মাথার পিছনে ব্যথা বোধ করায় হাত বুলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলো হাতে স্যালাইন পুশ করা আছে, সঙ্গে ব্লাডও দেওয়া চলছে। অনুভবে বুঝল মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ততক্ষণে মনে পড়েছে গতকালের গাড়ী এ্যাকসিডেন্টের ঘটনা। ধ্বক ধ্বক করে লাফাতে লাগলো হৃৎপিন্ড। সর্বনাশ! তার ভ্যানিটিব্যাগে তো অনেকগুলো টাকা ছিল, সে ব্যাগ কোথায়! মোবাইল ফোনটাই বা কোথায়! বাড়ীতে মা, বোনদের খবর কি! ইত্যাদি ভাবনার অত্যচারে অস্থির হয়ে উঠলো সুনীতার মন। আড়চোখে পাশে তাকাতে দেখল মেঝেতে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে জীর্ণ শীর্ণ চেহারার এক বয়স্ক পুরুষ লোক। ঘুমন্ত পুরুষ লোকটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আবার ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল সে। মনে পড়লো চলন্ত গাড়ীর সেই বিকৃত রুচির অসভ্য লোকটার মুখমন্ডল। সমস্ত পুরুষ জাতটার উপড় এক বিজাতীয় ধারনা'য় ছেয়ে গেল মন তার। চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল নার্সের কথায়...। কি আপামণি, এখন কেমন বোধ করছেন? এতক্ষণে বুঝতে পারলো সে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে আছে।
নার্সকে জিজ্ঞেস করলো সুনীতা, আমি এখানে কিভাবে এলাম সিস্টার? ঐ রিক্সাওয়ালা গরীব লোকটাই আপনাকে এখানে এনেছেন ম্যাডাম। বেচারা আপনাকে নিজ দেহের একব্যাগ রক্তও দিয়েছেন। আপনার দেহে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন ছিল খুব কিন্ত দাতা গ্রুপ "ও" পজেটিভ রক্ত হাসপাতালের সংগ্রহে না থাকায় ঐ চাচা নিজ ইচ্ছায় তার শরীরের 'ও' পজেটিভ রক্ত আপনাকে দিয়েছেন,, ঐ রক্ত না পেলে হয়তো আপনাকে বাঁচানো সম্ভবই হত না। অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছিল আপনার। নার্সের কথায় পুরুষজাত সম্পর্কে সমস্ত ধারনাই ওলট পালট হয়ে গেল সুনীতা'র। ধড়ফড় করে উঠে বসার চেষ্ট করলো সে কিন্ত নার্সের নিষেধে আবার শুয়ে পড়তে বাধ্য হল। বোবা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ছাদের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগল,,, এ দুনিয়ায় সব পুরুষই সমান মানসিকতা'র নয়। পৃথিবীতে মহৎপ্রাণ বলতে অনেকেই আছেন এখনও। মেঝেতে শুয়ে থাকা শীর্ণ দেহী লোকটাকেও চলন্ত বাসের নারীদেহ লোভী কথিত ভদ্রলোকটার শ্রেণীভুক্ত ভাবা'র জন্য খুবই অনুশোচনা বোধ করলো সে মনে মনে। কেমন একটা অপরাধ বোধ জেগে উঠলো অন্তরে তার। গভীর শ্রদ্ধায় গদগদ দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকল সে মেঝেতে ঘুমন্ত মহৎ লোকটার পান্ডুর মুখমন্ডলের দিকে।
ঠিক সেই মূহুর্তেই ক্রিং ক্রিং শব্দে মোবাইলের রিং টোন বেজে উঠলো মেঝেতে শায়িত লোকটার বালিশের নীচে আর সেই শব্দে ধড়ফড় করে জেগে উঠলো লোকটা, তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করে কথা বলা শুরু করলো। অবাক দৃষ্টিতে দেখছে আর কান পেতে শুনছে সুনীতা মহৎ লোকটার কথা। লোকটা বলছে,, হ্যা, হ্যা, যাচ্ছি, এখনই যাচ্ছি, কাল রাতে একটা বিপদে পড়ছিলাম তাই বাসায় ফিরতে পারিনি...ও,! মা'মণির পরীক্ষার ফিসের টাকা জোগার হয়নি এখনও, হ্যা. হ্যা. যাচ্ছি, এখুনিই যাচ্ছি..খরচা পাতিও করিনি তো..আচ্ছা যাই আগে বাড়িতে..। শুধুমাত্র এ প্রান্তের কথাগুলোই শুনলো সুনীতা, তাতে বুঝলো লোকটার মেয়ের পরীক্ষার ফিসের টাকা নেই তার কাছে - বাসায় খাওয়ার খরচ -পাতিও করতে পারেনি সে নিশ্চয় আমার কারণেই। মোবাইলে কথা বলা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো লোকটা তারপর সুনীতার বেডের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার ভ্যানিটি ব্যাগটা আমার রিক্সার বাক্সের ভিতরে রেখেছি দিদিমণি। রিক্সাটা কাছের একটা গ্যারেজে রেখেছি, এখনিই আসছি, বলেই তাড়াহুড়ো করে ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে। সুনীতা ভাবছে, ব্যাগটা হয়তো আছে কিন্তু ভিতরে রাখা টাকাগুলো কি আছে এখনো সেখানে! প্রায় ঘন্টাখানেক পরে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো লোকটা, হাতে তার সুনীতার ভ্যানিটিব্যাগ। ততক্ষণে সুনীতার হাতে লাগানো স্যালাইনের সূঁচ-পাইপ খুলে ফেলেছে নার্স। উঠে বসে নার্সকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল সে, এখন কি বাড়ীতে ফিরতে পারবো সিস্টার? কয়েকটা কাগজে স্বাক্ষর নিতে নিতে সায় জানিয়ে সিস্টার বললেন, তবে বেশী হাঁটাচলা আর পরিশ্রম করবেন না, খাওয়া দাওয়া করবেন ভালভাবে। কাছে এসে ভ্যানিটি ব্যাগটা দিতে দিতে বলল লোকটা, আপনার ব্যগে অনেকগুলো টাকা আর মোবাইল ফোন দেখে, খুব সাবধানে রিক্সার বাক্সে তালা দিয়ে রাখছিলাম দিদি, গুণে দেখুন ঠিক আছে কি-না? অবাক-বিস্ময়ে লোকটার হাত থেকে ব্যগটা নিয়ে চেইন টেনে দেখলো সে, টাকার বান্ডিলটা যেমনভাবে রেখেছিল ঠিক তেমনিই আছে, একচুল এদিক-সেদিক হয়নি। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখেলো বিশটা মিসড কল হয়ে আছে। এই মুহূর্তে কি করা উচিৎ এই মহান ব্যক্তিটির জন্য! ঠাওর করতে না পেরে কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নত হয়ে দু'পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো সে হত-দরিদ্র লোকটাকে। তারপর দৃঢ়চিত্তে বলল, চলুন দাদা, আপনার বাসায় যাই। এ কথায় হতচকিত রিক্সাচালক, থতমতখেয়ে তোতলাতে লাগলো কিন্তু কিছুই আর বলতে পারলো না মুখ ফুটে! শ্রদ্ধায় অবনত সুনীতা ততক্ষণে দু'হাত ধরে ফেলেছে তার। (সমাপ্ত)
প্রকাশ চন্দ্র রায়। কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী
-
গল্প//উপন্যাস
-
07-01-2020
-
-