অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ছোটলোক কোকারাম - সজল কুমার পোদ্দার

    শীতের পোশাকে পরিপাটি ডিরেক্টরসাহেব দুবাহু প্রসারিত করল উড়ন্ত বাজের ডানার মত। দুই বগল থেকে যেন দুটো আলোর রশ্মি আছড়ে পড়ল পলাশ বনের ছায়াতলে। ম্লান হল কাষ্ঠ প্রজ্জ্বলিত লেলিহান শিখার। উদ্ভাসিত হলো কৃত্রিম আলোর স্বপ্নলোকে বিরাজিত দুটি নবযৌবনে উচ্ছলিত নর-নারী। মুখোমুখি তারা চেয়ে আছে, মাঝখানে বন-ফায়ারের অগ্নিশিখা। পরিচালক ডান বাহু নামিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠে বললেন, সাইলেন্ট। অ্যাকশন-----
     চারিদিকে নিস্তব্ধ! তিনজন মানুষ স্ট্যান্ডের ওপরে বসানো ক্যামেরায় পিছনে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিকাররত বকের মত। অদূরে পলাশ গাছের আড়ালে শীতের অযোগ্য দৈন্য পোশাকে বগলে হাত গুজে সন্ত্রস্ত চোখে লুকিয়ে কোকারাম। দেহ ভরা তাঁর শীত আর মন ভরা আশঙ্কা। ক্ষণিকের মধ্যে বিরক্ত বিজড়িত কন্ঠে পরিচালক মহাশয় বললেন,কাট!
     কোকারামের বুকটা কেঁপে উঠলো। অন্ধকার থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট তীরের ফলার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এবার কি হবে কি জানি? ওহ্হো! পরিচালক নিজের ঊরুদেশ চাপড়ে আবার আক্ষেপ আর রাগ মিশ্রিত কন্ঠে পলাশ বন কাঁপিয়ে বললেন, হচ্ছেটা কি!? কোকারাম ধুলোয় দু-পা ছড়িয়ে বসে পড়ে হতাশায়। কাজে গাফিলতির জন্য নিশ্চয়ই আজ রাতের খাবারটা থেকে বঞ্চিত করবেন ম্যানেজারবাবু। আগাম খিদের যন্ত্রণায় বুকটা নীরবে আর্তনাদ করে উঠলো। এবারের শুটটাও যদি মাটি হয় তাঁর জন্য! এমনি মনে হওয়ার কারণ, বনফায়ারের দায়িত্বে ছিল কোকারাম। পলাশবাড়ীর অদূরে বড়ন্তির ড্যাম পেরিয়ে ছোট্ট পাহাড়ের পাদদেশে অকাল বিধবা ফুলমণির একমাত্র দশবছরের হতভাগ্য পুত্র কোকারাম। পলাশবাড়ীর এই কটেজে সে কাজ করে পেটে ভাতে। নগদ অর্থ বলতে তাঁর আতিথিয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে যদি কোন গেস্ট কিছু পাইপয়সা  বকশিস দেন। সেখান থেকে আবার অর্ধেক বখরা নেন ম্যানেজারবাবু। আজকের রাতে বাড়তি আশায় বুক বেঁধে আছে  কোকারাম,যদি শর্ট ফিল্মের পর্দায় তাঁর এক ঝলকে স্থান হয়। সন্ধ্যা থেকে শুটিং শুরু হয়েছে। তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও কাজ তেমন এগোয়নি। যতবার কাট হয়েছে তার দায় নিয়েছে কোকারাম। এবারও নায়ক সিন মার্ডার করেছে। গিটার হাতে নায়ক ধূম্র জনিত চোখের কৃত্রিম জল মুছে বললো, স্যার আগুনের ফুলকি চোখে পড়েছে।
     -----shut up(চুপ করো)! A bad workman quarrel with his tools.(নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা) কোকারাম কিছুই বুঝতে পারলো না। আলোর রশ্মি থেকে নিজেকে আরও বেশি গভীর অন্ধকারে আত্মগোপন করার চেষ্টা করলো। কলকাতার চ্যাটার্জী সাহেবের লিজ নেওয়া পলাশবাড়ী কটেজের ম্যানেজারবাবু ভীষণ রগ চটা মানুষ। সব সময় তাঁর ওপর দোষ চাপিয়ে দায়মুক্ত হয়। ঝি'কে মেরে বউকে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সমস্ত কিছু কোকারাম মেনে নেয়। সাতসকাল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত অতন্দ্র প্রহরীর মত খেয়াল রাখে কটেজে আগত গেস্টদের ওপরে। কুকারামের অতিরিক্ত অতিথিপরায়নতার একটা কারণ আছে। ঘরে আছে তাঁর অসহায় অসুস্থ মা। তিনি সারাদিন কোকারামের অপেক্ষায় থাকেন। কিচেনের কোনে বেসিনের পাশে রাখা আছে তাঁর এ্যালুমিনিয়ামের ভাঙা-বাঁকা কেটলি। এঁটো প্লেট ধুতে এসে উচ্ছিষ্ট খাবার তাতে মজুত করে।গভীর রাতে কটেজের সমস্ত কাজ সেরে কেটলি ভর্তি খাবার নিয়ে বাড়ি ফেরে। এর জন্য অবশ্য কোকারাম কয়েকবার খাবার চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। শুধু মালিকের দৌলতে এখনো কোকারাম টিকে আছে।
     এবার কিন্তু কোকরামের জীবন জীবিকার প্রশ্ন। শুটিং পার্টি এসেছে চ্যাটার্জী সাহেবের খোদ বন্ধুর। বিন্দু-বিসর্গ ত্রুটি হলে ম্যানেজারের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হবে। তাই সে কটেজের অতিথি আপ্যায়নের পাশাপাশি শুটিংয়ে বনফায়ারের বাড়তি দায়িত্ব নিয়েছে। সাধারণ গেস্টদের সামনে রাতের আগুন জ্বালাতে হলে কোন ভয় থাকত না কিন্তু আজকে যে বনফায়ারের শুটিং হবে। তাই কোকারাম ভীষণ সিরিয়াস। এমনিতে পৌষের শেষ,সামনে পৌষ সংক্রান্তি, তাঁদের বছরকার মূল উৎসব। শীত আছড়ে পড়েছে। কয়েকদিন আগেও পথ-পড়শী পলাশবন মোরাম ধুলোয় আপন হরিত্ব হারিয়েছিল। চার দিন আগে বর্ষিত জলধারায় বাতাস বন মোরাম-ধুলো মুক্ত হয়েছে। মেঘমুক্ত উত্তরের হিমেল হাওয়ায় জঙ্গলমহল শীত যন্ত্রনায় কাহিল হয়েছে। বৃষ্টির জল এখনো চেলাকাঠের গা ছাড়েনি। বনফায়ারের দায়িত্বে থাকা আধবয়সি গঙ্গাধর গংকে আত্মসমর্পণ করে সাতসন্ধ্যায় পলাশবাড়ীর কটেজ ছেড়েছেন। শুটিং তো বন্ধই হয়ে যেত কোকারাম না থাকলে।ম্যানেজারবাবু আর পরিচালকের কথোপকথনের মাধ্যমে কোকারাম বুঝতে পেরেছে, আগুন ঠিক মত জ্বালাতে না পারলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ কমপ্লিট করা যাবে না। আগামীকাল দিনেও হাতেঠাসা কর্মসূচি। পরশুদিন কটেজ বুকিং আছে অন্যদের। অতএব চেকিং টাইমে কটেজ ছাড়তে হবে শুটিং পার্টিকে। সুতরাং আজ রাতে বনফায়ারের শুটিং নাহলে এই অসম্পূর্ণ কাজের জন্য আবার আসতে হবে এখানে। তাতে সময় এবং অর্থ দু-দিক দিয়েই ক্ষতি হবে।
     কোকারাম কারোর অনুমতি বা হুকুম ছাড়াই দেড় কিলোমিটার দূরে ভাঙ্গা মোরাম রাস্তা মাড়িয়ে বাড়ি থেকে শুকনো শাল-কাঠের জ্বালানি নিয়ে আসে। কোকারাম নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে বন ফায়ারের। আগুনের কোন খামতি নেই। কিন্তু কখনো অ্যাক্টর-অ্যাক্ট্রেসের (নায়ক- নায়িকা) গাফিলতি,কখনো ক্যামেরাম্যানের ব্যর্থতা,কখনোবা লাইট-ম্যানের অক্ষমতায় পরিচালক রিটেক (পুনরায় শুট করা) নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু সব দোষ কোকারামের! সেই রবি ঠাকুরের কথায়, "যাহা কিছু হারায় গিন্নি বলে, কেষ্টা বেটাই চোর!" কোকারাম যেন,আজ রাতের রবিঠাকুরের কেষ্টব্যাটা। যাকে দোষ দিয়ে দায় এড়ানো যায় কিন্তু সে না থাকলে কারোর কোন কেরামতিই থাকে না।
     যা-ই হোক সন্ধ্যা থেকে পরিচালক মহাশয় বার ত্রিশেক সাইলেন্ট,অ্যাকশন,বলেছেন। ক্যামেরা- আলো-নায়ক-নায়িকা সাজসরঞ্জাম সব ঝলসে উঠেছে। পরিচালক বাবু কেবল দুইবার বলেছেন, এক্সেলেন্ট, নেক্সট। বাকি সব সময় বলেছেন রিটেক। অতএব বোকারাম বুঝে গেছে শুটের সফলতা ও বিফলতার পরিভাষা।
     তাই কোকারামের আর বুঝতে বাকি নেই যে, এই শুটটাও পন্ড হয়েছে! ভয়ে  ভয়ে  কোকারাম আঁধার থেকে বেরিয়ে এলো ক্রম ম্রিয়মাণ কাঠের আগুনের দিকে। নিঃশব্দে সে প্রায় নিভে যাওয়া অগ্নিকুন্ডে অবশিষ্ট চারটি চেলাকাঠ এগিয়ে দিল। আগুনকে লেলিয়ে দেওয়ার জন্য ঝুঁকে ফুৎকার দিতে লাগল। তারপরে আবার ক্যামেরার অন্তরালে লুকিয়ে পড়ল কোকারাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, কালকে দেখিয়ে দেবে কেমন করে অভিনয় করতে হয়। একশুটে বাজিমাত। ডিরেক্টর সাহেব যে তাকে কথা দিয়েছেন,আগামীকাল দিনের বেলায় শুটিংয়ে তাঁর অংশগ্রহণ করতে হবে। সাঁওতালি ছেলে হয়ে মহুয়ার বোতল নায়কের হাতে তুলে দিতে হবে। এই টুকুই। এটাই বা কম কিসের। কোকারাম মনে মনে ভাবে, শাল জঙ্গলের দেশে অনাদরে বেড়ে ওঠা একরত্তি অনাথ আদিবাসী ছেলেকে সিনেমার পর্দায় দেখবে সবাই! এটাতো কম কথা নয়। হোক না-ই-বা একঝলক। আশায় বুক বেঁধে আছে কোকারাম। মনে ক্ষীণ শঙ্কা, মহুয়ার বোতলটা তাকে যোগাড় করতে হবে। শীতের দিনে কমবেশি মহুয়া রসের আকাল পড়ে। তাতে কি? গঙ্গাধর গংকের বাড়ি শুকনো মহুয়া ফুল মজুত থাকে। সেখানে গেলে নিশ্চয়ই মিলবে। একথা ভাবতে ভাবতে কাঠের আগুন আবার ক্ষিপ্র গতিতে জ্বলতে থাকে। ডিরেক্টর সাহেব অতি কষ্টে আরো দুটি শুট নিল। তবু কিছুটা বনফায়ার অসমাপ্ত থেকে গেল। রাত অনেক হয়েছে চেলাকাঠও ফুরিয়ে গেছে। বাকি অংশ কালকে রাত্রে হবে বলে শুটিংয়ের আসর ভেঙ্গে গেল। কোকারাম খাবার পরিবেশনের গুরুদায়িত্ব পালন করে মায়ের জন্য খাবার নিয়ে বাড়ির দিকে ছোটে শীতের গভীর রাতের বুক চিরে।কণ্ঠে তাঁর ধ্বনিত হতে থাকে সুললিত আদিবাসী রাখালিয়া সুর।
     পরেরদিন কোকারাম মায়ের ওষুধের জন্য জমানো পয়সা দিয়ে একটা মহুয়ার বোতল নিয়ে হাজির হল শুটিং প্রাঙ্গণে। আসার সময় সে তাঁর গ্রামের সমবয়সীদের খবর দিয়ে এসেছে, আজ সে শুটিং করবে। শুধু তাঁর সমবয়সীরা কেন, অন্যান্য বুড়ো-বুড়িরা গ্রাম ভেঙে এসেছে কোকারামের শুটিং দেখতে। এমনকি কোকারামের মাও লাঠিভর দিয়ে অতিকষ্টে এসেছেন।
     ম্যানেজারবাবু কোকারামের হাত থেকে মহুয়ার বোতল নিয়ে সগর্বে দিল পরিচালকের হাতে। লাইট ক্যামেরা সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম রেডি। কটেজের অদূরে পলাশ-বনে নায়ক-নায়িকা অপেক্ষায়, কোকারামের আনা মহুয়া পান করে তারা যে আজ মাতাল হবে।
     মহুয়া খেয়ে নায়ক-নায়িকা সত্যি সত্যি মাতাল হল। সত্যি সত্যি সন্ধ্যার মধ্যে শুটিং শেষ হয়ে গেল। শুধু মিথ্যা হয়ে গেল একটি কথা। কোকা রামের শুটিংয়ে অংশগ্রহণ করা হলো না! কোকা রামের পরিবর্তে ম্যানেজারবাবুর ছেলেকে মহুয়ার বাহক করা হলো। গ্রামের লোকের কাছে অপমানে মাথা কাটা গেল কোকারামের। আত্ম গ্লানিতে কৈশোর হৃদয়টা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। লোকের মুখে কোকারাম শুনেছে শুটিং-সিনেমা সব মিথ্যে গল্পকথা। সত্যিই আজ তার প্রমাণ পেল।
     সন্ধ্যার সময় হাল্কা খাবার খেয়ে আবার শুরু হল অবশিষ্ট বনফায়ারের শুটিংয়ের আয়োজন। কোকারাম মনমরা শুকনো মুখে বসে আছে পশ্চিম দিকের মাটির মোটা দেওয়ালের কটেজের বারান্দায়। একদিকে শুটিং করতে না পারার অপমানের জ্বালা, অপরদিকে মায়ের ওষুধ কেনার পয়সার দুশ্চিন্তায় বুঁদ হয়ে আছে। ম্যানেজারবাবু এসে কর্কশ সুরে কোকারামকে হুকুম করলেন,  বনফায়ারের চেলাকাঠ আনতে। চাবি দেওয়া পুতুলের মত বাড়ির দিকে ছুটে চলে কোকারাম বনফায়ারের শুকনো কাঠ আনতে। অনতিবিলম্বে কাঠের বোঝা বনফায়ার প্রাঙ্গণে সশব্দে ফেলে ডিরেক্টর সাহেবের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, বাবু কাঠের পয়সা দিতে হবে না, মহুয়ার পয়সাটা দিন। ডিরেক্টর সাহেব তাকে জানালেন,কাঠ ও মহুয়ার পয়সা তিনি ম্যানেজারবাবুকে দিয়েছেন। ম্যানেজারবাবু সে কথা জেনে সকলের সামনে দু ঘা মেরে দিলেন। কাঁদতে কাঁদতে কোকারাম মিলিয়ে গেল পলাশ বন ছাড়িয়ে শাল জঙ্গলের পথে। কেউ তাকে পিছু ডাকেনি আগুন জ্বালাতে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেলেও কোকারাম ফিরে এলো না। সবাই বসে আছে তাঁর জন্য,কখন এসে চেলাকাঠ দিয়ে আগুন জ্বালাবে। তারপরে শুরু হবে শুটিং। অতি বিলম্বিত হওয়ার জন্য ম্যানেজার বাবু ক্রোধের সহিত বললেন, আজ আসুক ব্যাটা ছোট লোকটা!
     মৃদু আলোর লন্ঠন হাতে এক বৃদ্ধ এসে বললেন, তার আর দরকার হবেক লাইরে বাবু। উঠানের মহুয়া গাছের নিচের ডালে গলায় দড়ির ফাঁস লাগাইয়া মরিছে কুঁড়ি ব্যাটা কোকারাম ছোট লোক!! ক্যানে? না মরে মাওবাদী হতে পারতিস, সত্যি কোকারাম ছোট লোক বট্টে!!!

সজল কুমার পোদ্দার ।  নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ