বৃদ্ধাশ্রম নয়, নিজেদের ঘরই হোক মা-বাবাদের জন্য আনন্দাশ্রম - রতন কুমার তুরী
বৈষয়িক চিন্তা-ভাবনা মানুষের মননশীলতায় এতো বেশি জায়গা করে নিয়েছে যে, এখন মানুষ যেনো ধন- সম্পদ ছাড়া আর কিছু চিন্তাই করতে পারছেনা। মানুষ প্রতিনিয়তই টাকা - পয়সা ধন সম্পদের পেছনেই ছুটে চলেছে। এর বাইরেও যে একটা পৃথিবী আছে এটা যেনো বেশিরভাগ মানুষই আজ ভুলে গেছে। স্নেহ - মায়া - মমতা যেনো আজ বড় বেশি গৌণ হয়ে গেছে। অনেক আদর ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করা নিজ সন্তানটি পর্যন্ত আজ তার মা- বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে নিরিবিলিতে তাদের সংসার করে চলেছে। অন্যদিকে অনেক মা-বাবা সন্তান সন্ততি থাকার পরও তাদের অবহেলায় নিজ থেকেই বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। কেন এমন হলো আমাদের বাঙালি সমাজ ব্যবস্থা? নিকট অতীতেও তো এমন ছিলনা?
তাহলে কোথায় গলদ ঢুকে পড়েছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়? দূর অতীতে আমরা লক্ষ্য করেছি যৌথ পরিবার বিদ্যমান ছিল সব সমাজে। কোনো অসুখ বিসুখ হলেই সবাই একসাথে চিন্তা করতো। পরিবারের সব কাজ সবাই মিলে মিশে করতো। বাবা- মা পরিবারের কর্তা ছিল। তাদের কথাই ছিল শেষ কথা। তাদের প্রতি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ছিল প্রশ্নাতীত।
মা-বাবা, চাচা, জেঠা সবার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল সমাজের অন্যতম পালনীয় কর্তব্য। এই বিষয়টি তখন কাউকে শিখিয়ে দিতে হতোনা সবাই নিজ থেকেই এই দায়িত্ব ভক্তি সহকারে পালন করে যেতো। বর্তমানে মানুষ অর্থনৈতিক প্রয়োজনে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, মা- বাবার খবর পর্যন্ত নিতে পারছেনা।
আধুনিক সমাজে যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে অনেক আগেই। পরিবার ভাঙতে ভাঙতে এখন শুধু দু'জনে এসে দাঁড়িয়েছে অর্থাৎ স্বামী আর স্ত্রী। এই ছোট্ট সংসার নিয়েই বর্তমান সভ্য সমাজের মানুষ খুশি। যাদের মা- বাবা আছে তারা তাদের মা- বাবাকে গ্রামের বাড়িতেই রেখে এসেছে। বৃদ্ধ মা- বাবাকে সন্তান হয়তো বছরে একবার দেখতে যায়। অনেক সময় অবশ্য অর্থনৈতিক টানাপোড়েনও সম্পর্কগুলোকে বড় বেশি আলগা করে ফেলছে। তবে এক্ষেত্রে যাদের অর্থ সম্পদ বেশি রয়েছে তাদের বাবা - মা'দেরই বেশি অবহেলার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে একা একা জীবন কাটাতে হচ্ছে। যদিও বৃদ্ধাশ্রমের বিষয়টি বাংলাদেশে এখনও সীমিত পর্যায়ে রয়েছে তথাপিও মাঝে মাঝে এমন খবর আমাদের বড় বেশি বেদনা দেয়। যখন শুনি মেলায় এবং কোনো রেল স্টেশনে কোনো ছেলে তার বৃদ্ধ মা' কে রেখে এসেছে শুধু দু' বেলা খেতে দিতে হয় বলে, তখন মানুষ হিসেবে নিজেকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া আর কোনো ভাষা থাকেনা। আবার যখন দেখি ছেলে লাখ লাখ টাকা আয় করার পরও মা'কে একটি পুরনো ভাঙা ঘরে থাকতে হয় আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তার বালিশের ভেতর থেকে লাখ লাখ অবৈধ টাকা তল্লাশি চালিয়ে বের করে। তখন নিজেদের বড় বেশি অর্থহীন মনে হয়।
উন্নত বিশ্বে বৃদ্ধাশ্রম বিষয়টি এক ধরনের সামাজিকভাবে নির্ধারিত হয়ে গেলেও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ায় এটা নিয়ে এরা তেমন মাথা ঘামায়না। সেখানে ছেলে মেয়েরা বড় হলেই যে যার যার মতো করে জীবন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। অনেক সময় স্বয়ং রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তাদের বৃদ্ধ মা বাবাকে দেখা শোনা করে। কিন্তু আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ব্যবস্থা সেই অনাদিকাল থেকেই ভালোবাসা এবং মায়ামমতায় পরিপূর্ণ। এখানে মা-বাবা, ভাই -বোন, এবং অন্যান্য আত্মীয়রা একসাথে মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ থেকেছে যুগ যুগ ধরে। তাই মা-বাবাদের একটু অবহেলা সমাজে বড় বেশি প্রভাব বিস্তার করে। তাছাড়া ভারতবর্ষের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে অসংখ্য মানুষের বসবাস হওয়ায় এদের মধ্যে মায়ার বাঁধনটা বড় বেশি শক্ত পোক্ত হওয়ায় তাদের কাছে বৃদ্ধাশ্রমের ধারণাটা খুব বেশি বেদনাদায়ক। একসময় ভারতবর্ষে কোনো অভাব ছিলনা। গোলা ভরা ধান, পুকুরে ভরা মাছ আর মানুষের মনে ছিল আনন্দ আর আনন্দ। তখন পিতা মাতাদের অঢেল সম্পত্তি ছিল। এ সম্পত্তির সিংহ ভাগই তারা ছেলে মেয়ে এবং আত্মীয় স্বজনদের পেছনে খরচ করতো।
বর্তমানে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান মানুষকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করলেও মানুষ যেনো দিন দিন তার আবেক, মায়া মমতা হারিয়ে ফেলছে। বর্তমান সমাজে কিছু কিছু মা-বাবা তাদের সন্তানদের শত দুঃখ কষ্টে মানুষের মতো মানুষ করার পরও সে সন্তান বাবা - মা'র কোনো খোঁজই রাখছেনা বড় জোর তাদেরকে একটা বৃদ্ধাশ্রমে কিছু টাকা দিয়ে রেখে আসছে। এদিকে বাবা- মা তাদের সন্তানদের বৃদ্ধাশ্রম থেকে হৃদয় বিধারক চিঠি লিখলেও সন্তানদের যেনো কোনো মায়াই হচ্ছেনা। এমন একটা সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে অনেক বাবা - মা' ই কেবল হতাশাই প্রকাশ করে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সমাজ বিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণ এভাবে রক্তের বাঁধন গুলো আলগা হয়ে গেলে সমাজ এক সময় ভেঙে পড়বে। সমাজে ঢুকে পড়বে অন্যায় অবিচার। একজন সন্তানকে বড় করে তুলতে পিতা মাতাকে কি অপরিসীম কষ্ট সহ্য করতে হয় তা অনেক সন্তানই বোঝেনা, যদিও সন্তান বড় হয়ে পিতা মাতাকে রাজ সুখে রাখবে এমন চিন্তা থেকে কোনো বাবা মা'ই তাদের সন্তানকে প্রতিপালন করেনা। তারপরও পিতা মাতারা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যাওয়ার পর তাদের দেখ ভাল করা প্রতিটি সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব। এমন দায়িত্ব যুগ যুগ ধরে সন্তানেরা পালন করে আসছে। কিন্তু ইদানিং কিছু সন্তানদের তাদের পিতা মাতাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে।
এরা উচ্চ শিক্ষিত হয়েও তাদের পিতা মাতাদের বৃদ্ধাশ্রম নামের কারাগারে রেখে তাদের মায়া মমতা এবং শ্রদ্ধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সকল সন্তানদের কর্তব্য হচ্ছে প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও তাদের পিতা মাতাদের খোঁজ খবর নেয়া। প্রতিদিন রাতে মা বাবার পাশে বসে তাদের সাথে কথা বলা।
প্রকৃতপক্ষে কোনো সন্তানই তার মা বাবা ঋন কোনো দিন শোধ করতে পারবেনা। পিতা মাতা যদি কোনো সন্তানকে পৃথিবীতে না আনে তাহলে কোনো সন্তানই পৃথিবীর আলো দেখবেনা।
তাই সব সন্তানের উচিত পিতা মাতার প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করা। তাদের যা আছে তা দিয়েই পিতা মাতাকে সন্তানের সাথে এক সঙ্গে রেখে সেবা করে যাওয়া। কোনো দিন কোনো অবস্থাতেই যেনো বৃদ্ধাশ্রম নামের কারাগারে মা বাবাকে না পাঠানো। আমরা এগিয়ে যাবো সময়ের সাথে কিন্তু আমাদের মধ্য থেকে যেনো স্নেহের বন্ধনগুলো আলগা হয়ে না যায়।
আমাদের সবার মনে রাখা প্রয়োজন আমাদের পিতা মাতা আমাদেরকে অনেক আদর, ভালোবাসা এবং মায়ামমতা দিয়ে বড় করেছেন। তারা অনেক সময় আমাদের জন্য তাদের জীবনের সেরা সময়টুকু ব্যয় করেছেন আবার কখনও কখনও আমাদের সুখের জন্য দু' জনই বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন। এমন পিতা মাতাকে আমরা যখন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি তখন আমাদের সবার ভাবা উচিত সত্যিই কি আমরা মানুষ আছি? তা নাহলে যে মাতা পিতা আমাদের তাদের সর্বস্ব দিয়ে মানুষ করেছে তাদের প্রতি আমরা এতো নির্দয় হই কি করে?
যে মা বাবারা তাদের প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে আমাদের শরীর গড়েছে তাদেরকে আমরা কিভাবে এই অমানবিক বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি?
যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে এখনও এই প্রবণতা অনেক কম, তবুও যেভাবে এসমাজে মানুষগুলো মায়া মমতাহীন হয়ে কর্মব্যস্ত দিন কাটাতে শুরু করেছে এবং যেভাবে অর্থের পেছনে সুখ খুঁজে চলেছে তাতে করে আমাদের দেশেও এমন অমানবিক ব্যবস্থা অদূর ভবিষ্যতে স্থায়িভাবে জায়গা করে নেয় কিনা আশংকা হচ্ছে। জাতিগতভাবে আমরা বাঙালি এবং আমার জাতীয় সংস্কৃতিতে অনাদিকাল থেকেই স্নেহ ভালোবাসা মায়ামমতা পিতা মাতার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার প্রথা প্রচলিত আছে। এটা আমাদের জীবন এবং মৃত্যু পর্যন্ত বহমান। তাই আমাদের সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্য করতে বৃদ্ধাশ্রম নামের এমন অমানবিক প্রথা গড়ে ওঠুক এটা আমরা কেউ চাইনা।
তাই আসুন আমরা সবাই মা বাবাদের আর কোনো বৃদ্ধাশ্রমে নাপাঠিয়ে আমাদের নিজেদের ঘরকেই মা বাবাদের জন্য আনন্দাশ্রম হিসেবে গড়ে তুলি।
রতন কুমার তুরী । বাংলাদেশ
লেখক- কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী।
-
নিবন্ধ // মতামত
-
11-01-2020
-
-