অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
মধ্য এশিয়ার খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে - চিরঞ্জীব সরকার

০০১-এর জুনে উজবেক এয়ারে চড়ে ঢাকা থেকে চাকুরী সুবাদে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে যাই। ছিলাম ২০০৪ সাল পর্যন্ত। এর আগে ঢাকায় থাকতাম টিকাটুলির ইলিশিয়াম ভবনে। নতুন পরিবেশে যাচ্ছি তাই স্বাভাবিকভাবেই একটা অজানা ভয় এবং একি সাথে অপরিচিত জায়গা দেখার রোমাঞ্চ ভিতরে ভিতরে কাজ করছিল।

ইলিশিয়ামের পাট চুকিয়ে তল্পিতল্পাসহ রওহনা হই কোন এক প্রভাতে মধ্য এশিয়ার এ দেশটিতে হাওয়াইযানে চড়ে। হুমায়ুন আহমেদের একটা লেখায় পড়েছিলাম আমেরিকাতে বসে যেদিন জানালা খুলে প্রথম বরফ পড়া দেখছিলেন সেদিন তিনি এ দৃশ্যটি দেখে খুবই অভিভূত হয়েছিলেন। এটা পড়ার পর আমিও চিন্তা করতে থাকলাম কবে দেখব আকাশ থেকে ঝরে পড়া পেজা তুলার মত বরফ। শুনেছি তাসখন্দে বরফ পড়ে। সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছি আর মানসপটে ভাসছে বরফবৃষ্টির এক কল্পিত চিত্র।

তাসখন্দ এয়ারপোর্টে নেমে দেখি উজবেক এয়ারওয়েজের প্রচুর বিমান সারা এয়ারপোর্টে। ধারনা হল প্লেন এদেশে তৈরী হয়। তা না হলে এত প্লেন তাঁরা কিভাবে আমদানী করে। পরবর্তীকালে দেখেছি উজবেকিস্তানে রয়েছে প্লেন তৈরীর বিশাল কারখানা। উজবেক এয়ারওয়েজের প্লেনে “ওয়াদা” অর্থাৎ পানি খেয়ে কেমন জানি কষ কষ লাগছিল। ভাবলাম ওদেশের পানির যদি এরকম টেষ্ট হয় তাহেল অন্য খাবারের অবস্থা কিরকম, ওদের পানির মতই এরকম বিস্বাদ হবে কিনা। এয়ারপোর্ট থেকে ‘ওরজু’ নামক একটি হোটেলে উঠলাম। ছোট্ট হোটেল কিন্তু বেশ ছিমছাম। হোটেলের জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি রাস্তাঘাট বেশ পরিস্কার। দুধারে প্রচুর গাছপালা ও মাঝে মাঝে দুএকজন লোক হাঁটছে। খাওয়া দাওয়া শেষে সুন্দর একটি ঘুম দিলাম। 

তাসখন্দে আমি এসেছি জনাব লুৎফর রহমানের জায়গায়। উনি অবসরে চলে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের সাথে মাত্র সপ্তাহখানেক দেখা হল। খুবই অমায়িক এবং সরল প্রকৃতির। ওনার দুমেয়ে আমেরিকায় পড়াশোনা করে। বাবা-মার সাথে দেখা করতে তাসখন্দ এসেছে। এক মেয়ের ডাকনাম আমানী, অন্যজনের নাম লাবনী। দুবোনই নিরামিষভোজী। তাদের নিরামিষাশী হওয়ার কারন বেশ মজার। একবার তারা আমেরিকা থেকে বেড়াতে এল বাংলাদেশে। আত্নীয় স্বজনদের বাসায় মাছ-মাংস দিয়ে দাওয়াত খেতে খেতে মাছমাংসের প্রতি অতীব বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাঁরা অবশেষে নিরামিষাশী হয়ে গেছে। যথারীতি দূতাবাসে থার্ড সেক্রেটারি হিসাবে জয়েন করলাম। ফাস্ট কুনায়েভা স্ট্রীটে তখন বাংলাদেশের দূতাবাস। সুন্দর একটা একতলা বাড়ি। ভিতরে আনজির (ডুমুর) সহ আরও কিছু ফলের গাছ। দূতাবাসের সামনেও সবুজ গাছের ছায়া। একটা শান্ত শান্ত ভাব। আমার বাসা দূতাবাসের একেবারেই কাছে। পদব্রজে অফিস করছি। বাসার কাছেই মিরাবদ্ নামে বিশাল একটি বাজার। খুব পরিচ্ছন্ন এ বাজারটি। সকাল বেলা যখন বাজারটি বসে তখন মনে হয় যেন উৎসব হচ্ছে। নানা রংবেরংয়ের পোষাক পড়া উজবেক মহিলারা তাদের পন্য নিয়ে হাজির হন এখানে। কেউ মালাকু বা দুধ, কেউ সবজি, কেউ ফল ইত্যাদি বাহারী পন্য নিয়ে হাজির হয় তাঁরা। 

উজবেকিস্তান ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ। বিশাল মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরউদ্দিন বাবর এসেছেন বর্তমান উজবেকিস্তানের ফারাগান প্রদেশের আন্দিজান অঞ্চল থেকে। ফারাগান একটি সুন্দর সবুজ জায়গা। একপাশে পাহাড়, অন্যদিকে সমতল। বাবরের জন্মদিন উপলক্ষে উজবেকিস্তানের বাবর ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে একটা অনুষ্ঠানে একবার ফারাগান গিয়েছিলাম। বাবরের স্মরণে সেখানে চমৎকার একটা মনুমেন্ট বানানো হয়েছে। জহিরউদ্দিন বাবরের কাবুলের কবর থেকে একটুখানি মাটি এনেও ওখানে রাখা হয়েছে। বাবররা ছিল সতিৎকার অর্থেই যাযাবর ও যোদ্ধা। ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য স্থাপনের পর তাঁরা আর আন্দিজানে ফিরে আসেনি। যেখানে তাঁরা গিয়েছে সেখানকেই তাদের আপন ঘর করে নিয়েছে। ১২২০ সালে চেঙ্গিস খান ও তাঁর যাযাবর মঙ্গোল বাহিনী মধ্য এশিয়া আক্রমণ করে এর সমৃদ্ধ শহরগুলিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ১৩৬৩ সালে মঙ্গোল বাহিনীকে হটিয়ে দেয় উজবেকদের বীর আমির তিমুর। তিমুর সমরখন্দকে রাজধানী করে তার সাম্রাজ্যের শাসনকার্য চালাতেন। এই আমির তিমুরেরই বংশধর জহিরউদ্দিন বাবর।



বৃহত্তর সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে মধ্য এশিয়ার যে দেশগুলি স্বাধীনতা লাভ করে তার অন্যতম হল উজবেকিস্তান।  প্রায় সারে চার লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ দেশটি স্বাধীনতা পায় ১৯৯১ সনের ৩১ আগষ্ট। লোকসংখ্যা তিন কোটি ত্রিশ লক্ষের কাছাকাছি। জনসংখ্যার আশি ভাগই জাতিগত উজবেক। বাকীরা রাশান,তাজিক,  কাজাক, তাতার এবং কারাকালপাক্স। এ দেশটি পৃথিবীর অন্যতম একটি তুলা উ্যপাদনকারী দেশ। তুলা ছাড়াও তাঁরা স্বর্ন, প্রাকৃতিক গ্যাস ও ইউরেনিয়াম বাইরের দেশে রপ্তানী করে।

আমাদের দেশের লোকেরা কাউকে একটু অস্বাভাবিক আচরণ বা পোষাক পড়তে দেখলে তাঁকে কখনো কখনো উজবুক বলে সম্বোধন করে। উজবেকিস্তানে তিন বছর থাকাকালে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করেছি এবং মোটামুটি যে ধারনাটা জন্মেছে এ নামকরনের ব্যাপারে তা বেশ পজিটিভ। উজবেকদের পোষাক এতই রঙ্গীন ও চকচকে যে বহুলোকের মাঝখানেও তাঁদেরকে ঝকঝকে পোষাকের জন্য সনাক্ত করতে অসুবিধা হয়না। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ,সোনালী যে রঙ্গেরই হোক না পোষাকগুলি উজ্জ্বল হওয়া চাই উজবেকদের। এছাড়া আরও একটি ব্যাপার বেশ লক্ষণীয়। অধিকাংশ উজবেক নাগরিকরা দন্ত চিকিৎসার সময় তাঁদের দাঁতে সোনালী কোটিং করে। তাঁরা যখন কথা বলে তখন অনেকেরি দেখা যায় তাঁদের অন্তত দুএকটি দাঁতের কালার সোনালী। তাসখন্দের উপকন্ঠে চরসু নামক একটি বিশাল মার্কেট আছে। ওখানে গেলে যেকেউ প্রানভরে কিনতে পারে উজবেকদের রঙ্গীন ট্রাডিশনাল পোষাক। এ পোষাক পড়লে যে কাউকেই রাজা বা রানী বলে মনে হবে অল্প সময়ের জন্য হলেও।

তাসখন্দ একটি ভেলী বা উপত্তকা। সবুজ গাছপালা সমৃদ্ধ শহর। প্রশস্ত রাস্তাঘাট। ট্রাফিক আইন সবাই মেনে চলে। মিলিৎশিয়া অর্থাৎ পুলিশকে এখানে সবাই খুব ভয় পায়। কমিউনিষ্ট শাসনামলের ধারাবাহিকতা এখনও বজায় রেখেছে এখানকার পুলিশ। তাই ভয়ে পারৎপক্ষে কেউ আইন ভাংগতে সাহস করে না। এ শহরটির আবহাওয়াও চমৎকার। শীতকালে বরফ পড়ে, সাদা বরফের আস্তরনে সবকিছু ঢেকে যায়। গাছপালা পত্রহীন হয়ে নির্বাক কঙ্কালের মত দাঁড়িয়ে থাকে। তারপরও এর এক দারুন সৌন্দর্য আছে। গরমে সবুজ পাতায়, ঘাসে ঘাসে ছেয়ে যায় পুরো শহর। আর সাথে আছে মধ্যএশিয়ার খোলা প্রান্তর থেকে ভেসে আসা স্নিগ্ধ বাতাসের অবাধ প্রবাহ। বুক ভরে এখানে বিশুদ্ধ বাতাস নেয়া যায়। গাছের নীচে নীচে বেঞ্চ পাতা আছে। উইকএন্ডে আমি বাসার কাছের এহেন বেঞ্চে শুয়ে শুয়ে অনেক আকাশ দেখেছি আর বুক ভরে নিয়েছি জীবনদায়ী অক্সিজেন। আমার মেয়ে ফিজির জন্ম এ তাসখন্দে। ও যখন খুব ছোট্ট তখন প্রামবুলেটরে ওকে শুইয়ে হ্যান্ডেল ঠেলে ঠেলে ওকে নিয়ে ঘুরতাম। কখনো কোন পার্ক বা গাছের নীচে এসে ওকে পাশে রেখে আমি একটি বেঞ্চে বসে বা শুয়ে থাকতাম। কি সুন্দর সে তাসখন্দের দিনগুলি ছিল এখন মনে হলেই একটা নস্টালজিক ফিলিং অনুভূত হয়।

উজবেকদের প্রধান খাবার রুটি মাংস। রুটি বলতে আমাদের দেশে যেভাবে আটার রুটি তৈরী হয় এ রুটি সেরকম না। তাদের রুটি অনেকটা আমাদের তন্দুর-রুটি টাইপ। লিপুস্কা নামক এ রুটি বেশ ফোলানো। গরম গরম খেতেই এটার স্বাদ বেশী। রুটির মাঝখানে চাপ দিয়ে গোলাকার কতগুলি ছিদ্রের মত করা হয়, চুল্লিতে দেয়ার পর বাকীটা বৃত্তের মত ফুলে থাকে। গরম গরম খেতেই স্বাদ বেশী। উজবেকরা লিপুস্কা টুকরো করে অন্য খাবারের সাথে খায়, বিশেষ করে সুরপা (স্যুপ) ও সাসলিকের (কাবাব) সাথে। তাদের প্রিয় মাংস দুম্বা যা স্থানীয় ভাষায় ‘বারান’ নামে পরিচিত। বারানের মাংসের ফালির সাথে সাথে চর্বির টুকরা দেয়া থাকে, তারপর তা কয়লার আগুনে ঝলসানো হয়। অনেকটা অর্ধেক মাংস, অর্ধেক চর্বি এ হিসাবে মাংস-চর্বি শিকে ঢুকানো হয়। উজবেকদের চর্বি ভক্ষন দেখলে যে কেউ ভিরমি খেয়ে পড়বে। এরকম চর্বি খেলে হার্টের সবকটি নালী সপ্তাহখানেকের ভিতরই বন্ধ হওয়ার কথা।

উজবেকদের কাছে তাঁদের এহেন চর্বি ভক্ষণের ব্যাপারে আমি জিজ্ঞাসা করেছি। উত্তরে বলে এ চর্বি তাঁদের কোন ক্ষতি করতে পারে না। যেহেতু তাঁরা খাবার সাথে সাথে প্রচুর গ্রীনটি খাচ্ছে তই ওই গরম গ্রীনটি চর্বি গলিয়ে দিচ্ছে। মনে মনে ভাবি হয়ত তাঁদের এ যুক্তির ভিতরে কিছুটা সত্যতাও আছে। বারানের হাড্ডি সিদ্ধ দিয়ে তৈরী সুরপাও তাদের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। উৎসবে উজবেকরা আমাদের দেশের খিচুরীর মত পিলাও নামক একটি খাবার বানায়। এ দেশটি রুটি, মাংস আর ফলে ভরপুর। ওদের আংগুর খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু। ওখানে আংগুর খেয়ে শেষ করা যায় না। লেক ও নদীতে বিশাল আকারের বোয়াল মাছ পাওয়া যায়। কাটা বোয়ালের পিছ্ দেখলে সত্যিকার অর্থেই পিলে চমকে যায়। এছাড়া রুই ও সাজন মাছ নামে এক ধরনের হোয়াইট ফিসও এদেশে প্রচুর পাওয়া যায়। 

তাসখন্দ একটি ছিমছাম স্বাস্থ্যকর শহর। যদিও শীতকালে বরফ পড়ে রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে যায় তারপরও তা সহনীয়। গরমের সময় এত সুন্দর বায়ুপ্রবাহ মনে হয় যেন তা সমস্ত শরীর পরিশুদ্ধ করে দিচ্ছে। তাসখন্দের আবহাওয়া এতই চমৎকার যে সেখানে তিনবছর অবস্থানকালে আমাদের তেমন একটা রোগব্যাধির কবলে পড়তে হয়নি। ভূপেণ হাজারিকার একটি বিখ্যাত গান ‘আমি এক যাযাবর’-এ তাসখন্দের মিনারের কথা উল্লেখ আছে। এছাড়া ইতিহাসেও আমরা তাসখন্দ চুক্তির কথা পাই। আমাদের বাসা ছিল চেকভ রোডে। বাড়িওয়ালী ছিলেন তাতিয়ানা, রাশান-ওরিজিন এক অমায়িক মহিলা। ভদ্রমহিলা আমাদেরকে খুব পছন্দ করতেন। তাতিয়ানার স্বামীর নাম ছিল স্লাভাকা। কিন্তু আমরা যেহেতু রাশান উচ্চারন ও অর্থ প্রথমদিকে তেমন বুঝতাম না তাই তাকে আমরা সাভাকা বলেই ডাকতাম। বাসায় টুকটাক কোন সমস্যা হলে আমাদের উচ্চারিত সাভাকা এসেই মেরামত করে দিত। ও একদিন হাসতে হাসতে আমাদের বলল তোমরা যে আমাকে সাভাকা বল আসলে আমার নামের উচ্চারণ হবে স্লাভাকা। রাশান ভাষায় সাভাকা অর্থ কুকুর। ভীষণ লজ্বা পেলাম। তাঁরাও বুঝতে পেরেছে আমাদের সমস্যাটা কোথায় ছিল। 

তাতিয়ানা খুব মাতৃভক্ত ছিলেন। আমাদের বাসায় যখন আসতেন তখন  দেখতাম তাঁর বৃদ্ধা মা গাড়িতে বসে আছে। মাকে বাসায় ফেলে সে দীর্ঘক্ষণের জন্য বাইরে যেতেন না। তাঁর মা অশীতিপর বৃদ্ধা। তাসখন্দ থেকে আসার কিছুদিন আগে তাতিয়ানাকে দেখি গাড়িতে তিনি একা। জিজ্ঞেস করলে বলল তার মা আর নেই। রুমাল বের করে চোখ মুছছে। আমার মানসপটে ভেসে উঠতে থাকে গাড়িতে বসে থাকা একজন বৃদ্ধার মুখচ্ছবি। ওখান থেকে আসার পর লুদা নামক আরও একজন বৃদ্ধার মৃত্যুর কথা জানতে পারি। তাসখন্দ নিবাসী জনৈক হিমাংশু ভৌমিকদার বাসায় লুদা কাজ করতেন। আমরা ওনাদের বাসায় বেড়াতে গেলে লুদা খুব খুশী হতেন। রাশান সালাদ বানিয়ে মহা আনন্দে আমাদের পরিবেশন করতেন। কোথায় আজ সে তাতিয়ানার বৃদ্ধা মা আর হিমাংশুদার বাসার লুদা, পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে তাঁদের পদচিহ্ন চিরতরে।



হিমাংশুদার স্ত্রী ঝর্না বৌদী বরিশালের মেয়ে। দাদার বাড়ী কুমিল্লাতে। ওনাদের একছেলে,একমেয়ে। ছেলে জয় ও মেয়ে নব। আমরা যখন প্রথম জয়কে দেখি তখন ও ছোট্ট একটি ছেলে। খুব আদুরে ভাষায় কথা বলত জয়। একদিন জয় কোথায় যেন হারিয়ে যায়। দাদা ও বৌদি জয়কে খুঁজতে খুঁজতে পাগলপ্রায়। সন্ধ্যার দিকে দেখা গেল জয় বাসার কাছেই একটি বিল্ডিং-এর সিঁড়িতে বসে আছে। ও সুন্দর রাশান বলতে পারত। জয় এখন অনেক বড় হয়েছে আর নব আমেরিকাতে পড়াশোনা করছে। তাসখন্দের অদূরেই দাদার একটি ‘ডাচা’ বা সামার হাউজ আছে। শনি-রবিবার উইকএন্ডে আমরা মাঝে মাঝে ওখানে বেঁড়াতে যেতাম। ডাচায় যাওয়ার পথে গাড়ি থামিয়ে কোন রেস্তোরাতে গরম সাসলিক, লিপুস্কা আর চা-এর সাথে জম্পেস আড্ডা চলত। সামার হাউজের ভিতরে আনজির(ডুমুর), এপ্রিকট, প্লাম(আলুবোখারা), বড় গোলাপসহ নানান জাতের গাছ ছিল। আমি ওখানে গেলে ভিতরের একটি এপ্রিকট গাছের নীচে সবুজ ঘাসে খোলা বাতাসের একান্ত সান্নিধ্যে অনেকক্ষন শুয়ে থাকতাম। ডাচাটির নিকটেই একটি স্বচ্ছ জলপ্রবাহ। ওখানে নেমে অগভির পানিতে শুয়ে থাকতাম আর টলমল জলরাশি শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যেত। ফেরার পথে হাইওয়ের পাশ থেকে লেকের তাজা মাছ কিনে আনতাম। আজ সে দিনগুলি সবই স্মৃতি।

তাসখন্দে আমাদের অফিসের ম্যাসেঞ্জার হিসাবে কাজ করত খায়রুল্লা। অত্যন্ত ভদ্র ছেলে। আমাদের তখনকার দূতাবাসটির ল্যান্ডলর্ড ছিল ওর বাবা। ওর বাবার আরও অনেকগুলি বাড়ি আছে। কিন্তু খায়রুল্লার ভিতর কোন অহংকার ছিল না। দূতাবাসে চাকুরী করে যে টাকা পেত তা দিয়েই ও তাঁর সংসার চালাত। তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল বিরল। সে ছিল খুবই সৎ, সরল ও কর্তব্যপরায়ন। আমি একদিন খায়রুল্লাকে জিজ্ঞেস করি তুমি কেন এত কষ্ট করে চাকুরী করছ, তোমার বাবার তো অনেক প্রপার্টি। খায়রুল্লা জবাবে বলল আমি আমার নিজের পরিশ্রমলদ্ধ পয়সায় জীবন নির্বাহ করতে চাই। বাবার সম্পত্তির ব্যাপারে আমি আমি কখনো চিন্তা করি না। আমি তাসখন্দে থাকতেই ও একটি কন্যা সন্তানের জনক হয়েছিল।

তাসখন্দে আমাদের এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে থাকত ইওলারা। ইওলা একটি চার বছরের বাচ্চা মেয়ে। ওর মা বাবা মাঝে মাঝে ওকে আমাদের বাসায় রেখে বাইরে যেত। রৌদ্রকরোজ্বল এক ছুটির দিনে কোথা থেকে যেন বাসায় ফিরছি। আমাদের বিল্ডিং-এর সামনে ফুটবল মাঠের মত খোলা জায়গা ছিল। বাচ্চারা সেখানে প্রানভরে খেলাধুলা করত। গ্রীস্মে সবুজ ঘাসে ছেয়ে যেত মাঠটি। সেদিন হঠাৎ করে আমাকে দেখে ইওলা একমুঠো ঘাস ছিড়ে এনে আমার দিকে দৌড়ে এল। হাসতে হাসতে ও ওই একমুঠো ঘাস আমার হাতে গুজে দিয়ে আবার মাঠের দিকে দৌড় দিল। ছোট্ট ইওলার ওই একমুঠো ঘাস এখনো আমার স্মৃতিকে তাড়িত করে।

তাসখন্দ এয়ারপোর্টে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জনাব এ বি এম আবদুস সালাম স্যারকে বিদায় জানাতে এসেছি। বোর্ডিং পাস নেয়া শেষ, ভিআইপি লাউঞ্জে বসে আছি। প্লেনে উঠার অপেক্ষা মাত্র। এমন সময় শোনা গেল এ এয়ারপোর্টে একটু আগে ল্যান্ডিং-এর সময় উজবেক এয়ারওয়েজের অভ্যন্তরীন একটি ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়েছে। স্যার বললেন, দেখ এখন আমার আবার প্লেনে উঠতে হবে,এটা কি এখন ভাল লাগে। ঐ বিধ্বস্ত প্লেনের নিহত যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন জাতিসংঘে কর্মরত রিচার্ড ক্রনি নামে এক ভদ্রলোক। ওনার ফিউনেরাল সেরিমনিতে পরেরদিন আমি যোগ দিয়েছিলাম।

সাংহাই কোঅপারেশন অর্গাইজেশের একটি সামিট মিটিং চলছে তাসখন্দে। এ অর্গানাইজেশনের সদস্যভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানরা তখন এ শহরে। তাদের সন্মানে রাষ্ট্রীয় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় বিশাল একটি হলঘরে। রাষ্ট্রদূত তখন ছিলেন না, তাই বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে আমিই সেখানে যাই। একে একে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রবেশ করছেন। হঠাৎ দেখি কে যেন হলঘরে প্রবেশ করা মাত্রই সবাই জোরে হাতে তালি দেয়া শুরু করল এবং এ তালি অনেকক্ষণ চলল। উৎসুক হয়ে খেয়াল করলাম এ চাঞ্চল্যের কারণ পুতিনের আগমন। পুতিন তখন এ অঞ্চলে নাগরিকদের মাঝে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন যাকে তাঁরা তখন রোল মডেল মনে করত।  

উজবেকিস্তানের নামের সাথে সমরখন্দ নামক প্রাচীন একটি শহরের নাম জড়িয়ে আছে। এটি উজবেকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। সমরখন্দ একসময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, বানিজ্যে সমৃদ্ধশালী জনপদ ছিল। খ্রিস্টীয় চৌদ্দ শতকে আমির তিমুর সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল সমরখন্দ। ঐতিহাসিক সিল্ক রোড সে সময় এ শহরকে দিয়েছিল প্রানচাঞ্চল্য। উজবেকিস্তানের জাতীয় বীর আমির তিমুর যিনি আমাদের উপমহাদেশে তৈমুর লং ণামে পরিচিত, সমরখন্দ শহরেই তার সমাধিসৌধ যার স্থানীয় নাম গুর-এ-আমির। বিবি খানম এর কবর,রাগিস্টান স্কোয়ার, উলুগবেগ অবজারভেটরি এ শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। তাসখন্দ থেকে সমরখন্দ যাবার পথে পড়ে ইমাম বোখারীর মাজার। এখানেও প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হয়। উজবেকিস্তান খোলা আকাশ আর বিশাল প্রান্তরের দেশ। সমরখন্দ যাওয়ার পথে একদিন গাড়ি থামিয়ে শুষ্ক তৃনগুল্ম ও ক্যাকটাসের প্রান্তরে মধ্যএশিয়ার বাতাসের সাগরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি দূর থেকে আমির তিমুরের অশ্বারোহী বাহিনী শো শো করে আমার দিকে ছুটে আসছে।

২০০৪ এর সেপ্টেম্বরে আমি ওখান থেকে বদলী হয়ে রেড রিভারের দেশ ভিয়েতনামে চলে আসি। কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে মনে হয় মধ্য এশিয়ার ভরা দুপুরের তীব্র বাতাস আমাকে বলে সবকিছু ফেলে চলে আয় সীল্ক রোডের যাযাবরদের কোন এক কাফেলায়। 

চিরঞ্জীব সরকার । অটোয়া, কানাডা