অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
পৃথিবীতে একমাত্র গণতন্ত্রই হচ্ছে দেশ শাসনের সর্বোৎকৃষ্ট শাসন পদ্ধতি - রতন কুমার তুরী

রাস্ট্র শাসনের  বহুল স্বীকৃত ও জনপ্রিয় পদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্র আজ সারা পৃথিবীতে বেশ সমাদৃত। বলতে গেলে পৃথিবী জুড়েই আজ গণতন্ত্রের ঢেউ। প্রাচিন যুগ থেকে মধ্য যুগ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপি রাজা, বাদশা, সম্রাট এবং কোথাও কোথাও গোষ্ঠীগতো শাসন পদ্ধতি প্রচলিতো  ছিলো। আধুনিক যুগেও উপরোক্ত শাসন ব্যাবস্থা পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে এখনও টিকে থাকলেও তা একেবারে নগণ্য। অবশ্য বিশ শতকের প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে জার শাসনের অবসান হলে  মাক্সীয় দর্শনের কমিউনিস্ট শাসন পদ্ধতি মানুষের মনকে বেশ নাড়া দিয়েছিলো। তাও পরবর্তী কালে পৃথিবীর মানুষের কাছে তেমন যুগোপযোগী মনে হয়নি তাই এর জনপ্রিয়তাও কমতে থাকে  যদিও কমিউনিস্ট প্রেমিরা এখনও মনে করেন একদিন পৃথিবীজুড়ে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্টিতো হবে এবং পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষেরা এক হবে।

কমিউনিস্ট শাসন পদ্ধতি বর্তমানেও পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটা দেশে টিকে আছে। পৃথিবীর দেশ সমূহ সুষ্টভাবে সব মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শাসন করার জন্য গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার। এই শাসন ব্যবস্থায় মানুষ তার মতামতকে সহজে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয় বিধায় এই পদ্ধতির জনপ্রিয়তা আজ আকাশচুম্বি। তাছাড়া এই পদ্ধতি ব্যক্তি, গোত্র, সমাজ, রাস্ট্র সব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যায় বলেই জনগণ গনতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল থাকে বেশি।  তাই আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর ১৯৫টি স্বাধীন রাস্ট্রের মধ্যে ১২২টি গণতান্ত্রিক রাস্ট্র। অদূর ভবিষ্যতে এই তালিকায় আরো রাস্ট্র যোগ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ চায় স্বাধীনভাবে চলতে, ফিরতে এবং স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে  আর তাতে বাঁধা পড়লেই মানুষ প্রতিবাদি হয়ে ওঠে। এসমস্ত প্রতিবাদি মানুষদের প্রতিবাদ থামাতে অগণতান্ত্রিক দেশ সমূহে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শক্তির প্রয়োগ ঘটানো হয় এমনকি জনগণের ওপর অত্যাচার চালিয়ে তা থামানোর চেষ্টা করা হয় অনেক সময় এসব প্রতিবাদি মানুষদের বিভিন্ন ভয় ভীতি দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশ সমূহে তা করা সম্ভব হয়না কারণ গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে এ সকল প্রতিবাদি মানুষদের এসমস্ত কিছু করার অধিকার দেয়াই আছে। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে অনেক সময় গণতান্ত্রিক দেশেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরন করে হয়, মানুষের বিভিন্ন   অধিকারকে কেড়ে নেয়া হয় যা পুরোপুরি গণতন্ত্রের বিপরীত। এমন দেশের সংখ্যা কম হলেও এসমস্ত দেশে বসবাসকারি মানুষ অনেক সময় গণতন্ত্রের প্রতি ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে। এসব দেশ সমূহে এমন পরিস্থিতির মূল কারণ হচ্ছে তাদের দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহ শক্তিশালী না হওয়া।  দুর্বল গণতান্ত্রিক কাঠামো দিয়ে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্টানিক রূপ দেয়া অনেক সময় বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে ।  

প্রকৃতপক্ষে তাত্ত্বিক বিষয়গুলো বোঝতে খুব বেশি লেখা পড়া জানার প্রয়োজন না হলেও এই বিষয়গুলো প্রাতিষ্টানিক রূপ দিতে একদল জ্ঞানী মানুষের খুব বেশি প্রয়োজন হয়। গণতন্ত্রের ব্যবহারিক বিষয়গুলো সাধারণ জনগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে  মানুষের মুখে শুনে কিংবা ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখেই শিখেছে যদিও কোনো দেশে শিক্ষিতো মানুষের সংখ্যা বেশি থাকলে সে দেশে গণতন্ত্র কখনও বিপদগামি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে তথাপি দেশ সমূহের তৃণমূল থেকে রাস্ট্রের ওপরের লেভেল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্টান সমূহ স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার আওতায় থাকলে  গণতন্ত্রের ভিত আরো শক্তিশালী হয়। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী মাত্র তাদের অধিকার বিষয়ে সচেতন আর গণতন্ত্র এবিষয়ে মানুষকে ব্যাপক স্বাধীনতা দিয়েছে। চিন্তার স্বাধীনতা এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা মানুষকে সৃজনশীল করে তোলে আর এমন স্বাধীনতা শুধুমাত্র গনতান্ত্রিক বিশ্বে দেখা যায়। এসব স্বাধীনতার ক্ষেত্রগুলোকে সুনিশ্চিত করার জন্য পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে বেশকিছু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্টান রয়েছে , প্রতিষ্টান সমূহ সবসময়  স্বাধীন এবং নিপেক্ষভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্টায় কাজ করে যায়। এসব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্টানের কোনো কাজকেই দেশের সরকার হস্তক্ষেপ করেননা। এমন অসংখ্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্টানের মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ইত্যাদি। 

প্রকৃতপক্ষে যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের বিচার বিভাগ হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্টান। এই বিভাগের প্রতিটি কর্মকান্ড একটি আইন সঙ্গত আদর্শের ভিত্তিতে চলে। এই প্রতিষ্টানটি থেকে দেশের সব মানুষ ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করে। আমরা এই প্রতিষ্টানকে যতবেশি স্বাধীন রাখবো ততবেশি মানুষ সুফল পাবে। বিচার বিভাগের ওপর কোনো সরকার হস্তক্ষেপ করলে মানুষ তার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।  তাই এই গগণতান্ত্রিক প্রতিষ্টানটিকে সব হস্তক্ষেপের উর্ধে রেখে একে একটি শক্তিশালী কাঠামোয় রূপ দিতে হবে।   অপরদিকে গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাশন কমিশনকে বলা হয়ে থাকে গণতন্ত্রের প্রাণ কারণ গণতন্ত্রের পুরো বিষয়টা এই প্রতিষ্টানটি চর্চা করে থাকে। দেশের যেকোনো নির্বাচন এই প্রতিষ্টানটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তাই এই প্রতিষ্টানটি সব দেশেই অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। নির্বাচন কমিশন অনেক সময় সরকারের চাইতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে গণতান্ত্রিক বিশ্বের দেশ সমূহে সেই স্বাধীনতা এই প্রতিষ্টানটিকে দেয়া হয়েছে। অনেক দেশেই আমরা দেখতে পাই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন সংস্থাটির ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করে গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে যা গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। মূলত দেশের সকল স্তরে গণতন্ত্রের চর্চা ছাড়া গণতন্ত্রের ভিতকে শক্তিশালী   করা প্রায় অসম্ভব।

গণতন্ত্রের ভিতকে শক্তিশালী করতে হলে দেশের গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্টানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া উচিত। একটি অর্থবহ জনকল্যাণ মূলক গনতান্ত্রিক রাস্ট্র প্রতিষ্টা করতে হলে দেশ পরিচালনায় একদল গনতন্ত্রমনা মানুষের প্রয়োজন, এদের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং জনগনের জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধা গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে পারে। মূলত কোনো একটি দেশে একটি শক্তিশালী গনতন্ত্র অব্যাহত রাখতে চাইলে দেশটির বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই পারে গণতন্ত্রের ভাষা বুঝতে এবং তাদের অধিকার সমূহ গণতান্ত্রিক পন্থায় আদায় করে নিতে। কারণ গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিতে আইন শাসন প্রতিষ্টার ব্যাপারে বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। এধরণের আইনের শাসন প্রতিষ্টা করতে হলে দেশে শিক্ষিত মানুষের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। পুরো দেশের মানুষদের শিক্ষিত করে তুলতে পারলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও মজবুত হবে। প্রকৃতপক্ষে 'গণতন্ত্র' বিষয়টি বেশ ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়। 

বাংলা ভাষায় 'গণতন্ত্র' কথাটি পরিভাষিক ইংরেজি Democracy থেকে এসেছে। শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ Demokratia থেকে। Demokratia শব্দটির উৎপত্তি Demos  ও  Kritos থেকে। গ্রিক শব্দ Demos অর্থ হলো জনগণ আর Kritos  অর্থ হলো শাসনক্ষমতা বা কর্তৃত্ব। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। অর্থাৎ সরকার বা শাসন ব্যবস্থা যখন সংখ্যা গরিষ্ঠের মতামত নিয়ে পরিচালিত হয় তখন তাকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বলে। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম গণতন্ত্রের সূচনা হয় গ্রিসের নগর রাস্ট্র এথেন্সে। আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিসে সলোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন । এজন্য তাকে গণতন্ত্রের জনক বলা হয়। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে সংসদীয় আধুনিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয় ১২১৫ সালের ১৫ জুন ম্যাগনাকাটা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। এর জনক জন লক। জন লক কর্তৃক প্রবর্তিত আধুনিক গণতন্ত্রই আজ বিশ্বে সমাদৃত। 

রতন কুমার তুরী । চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ