অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
শিউলি ঝরানো বোল - প্রিয়রঞ্জন পাল

লাকাটি একসময় পরিচিত ছিল ঢাকিপাড়া বা নট্ট পাড়া নামে। এখন অবশ্য সে নামে খুব কম লোকই ডাকে। শহরের প্রান্তসীমায় অবস্থিত, জাতীয় সড়ক সংলগ্ন এপাড়ার এখন পোশাকি নাম নতুন উকিলপাড়া।  সেখানে ফিরছে কানু, রোজই যেমন ফেরে। সারাদিনের খাটুনি শেষে বাড়ি ফেরার সময় সবাই ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পরে, পারলে দেহ ছেড়ে দেয় কিন্তু বিপরীতে ও যেন একটু বাড়তি শক্তি পায়। প্যাডেলে অপেক্ষাকৃত বেশী চাপ পড়ে। প্যাডেলের সঙ্গে গিয়ারের সংঘর্ষে তৈরি হয় খ্যাঁট খ্যাঁট শব্দ। কানুর কানে শব্দটি বাজে ঢ্যাগ না ঢ্যা ঢ্যাং এর মত।

আজ খানিকটা বেশী টাকার ভাড়া মেরেছে কানু। পূজোর মরসুম শুরু হচ্ছে, কেনাকাটা করতে মানুষ বেরচ্ছে, মুখ ফুটে চাইলে দু চার টাকা বেশীও মিলছে।

তবু পূজোর মরসুম এলে একটা চিনচিন করা মন খারাপ শুরু হয় কানুর। মনে পড়ে ঠাকুরদাদার কথা। ওর ঠাকুরদা নিত্যগোপাল নট্ট এ তল্লাটে বিখ্যাত ছিল নেত্য ঢাকি নামে। ঠাকুমার কাছে কানু গল্প শুনেছে যৌবনে নেত্যঢাকি নাটোরের রাজবাড়িতে ঢাক বাজিয়ে সোনার মেডেল পেয়েছিল। সে মেডেল অবশ্য কানু চোখে দেখে নি। শুনেছে সে মেডেল বেচেই কানুর বাপ বুধু নট্ট রিক্সা কিনেছিল। স্বামীর এমনতর স্মৃতি বিক্রির সময় কানুর ঠাকুমা হরিদাসি আপত্তি করে নি তা নয় গলা ছেড়ে কাঁদতেও বসেছিল। তবে নেত্য ঢাকির ছেলে 'পষ্ট'  কথায় বলেছিল '' শুধু ঢাক বাজায় আর মেডেল গলাত ঝুলায় পেট ভরবিন না।''

সেই থেকে পেশান্তর ঘটেছিল নেত্যঢাকির পরিবারে। '' অত নামডাকঅলা ঢাকির ছেলে কিনা রিক্সা চালাবে?'' - পড়শিদের কেউকেউ একথা বলেছিল বটে কানু গা করে নি। পরে অবশ্য বুধু কে অনুসরণ করে অনেকেই ঢাকি থেকে রিক্সাঅলা হয়েছে।

বুধু বাপের ঢাক বাজায় নি। তা বলে ঢাকটা নষ্টও করে নি। মাঝে মধ্যে সেটাকে রোদে দিয়েছে। বারকয়েক গাবও খাইয়েছে। কানুর মা মানে বুধুর বৌ কয়েকবার বলেছে, ''মাঝে মদ্যে বাজালেও তো পার! কিন্তু বুধু কখনও ঢাকের কাঠি হাতে তোলে নি। বুধুর এহেন আচরণের কারণ আর কেউ না জানলেও ওর মা ঠিকই জানতো ঢাকের উপর ছেলের অভিমান আছে। ঢাক বাজিয়ে নেত্য ঢাকি মান পেলেও ধন পায় নি। তাই সংসারে লক্ষ্মীও আসে নি কখনো। ঢাক কাঁধে নিয়ে সেই যে বেরত নিত্য ফিরত দুতিন মাস বাদে। ফেরার সময় ঝুলিতে অনেক কিছু থাকলেও মাঝের দিনগুলো বুধু আর ওর মা কাটাতো নিদারুণ কষ্টে। তাছাড়া কোনও কারণে বুধুর ধারণা হয়েছিল বাবা ওর থেকেও বেশী ভালোবাসে ঢাকটিকে। বাড়ীতে থাকলে সর্বক্ষণ ঢাক নিয়ে মেতে থাকা ছিল নেত্যঢাকির অভ্যাস। ছাউনি পরানো, চাক ঠিক করা, বদু লাগানো, কুশি টানা সহ নানা কাজ ছাড়াও রেওয়াজ ছিল নেত্যঢাকির নিত্য কাজ।

ঢাক বাজায় নি বুধু। নিজের শহর এমন কি দূরের শহরেও রিক্সা চালিয়েছে সে। কিন্তু ঘরের অভাব ঘোচেনি  বরং রিক্সা চালানোর মেহনত, শারীরিক অনিয়ম এসবের জেরে টিবি ধরেছিল। মরার আগে কি এক খেয়ালে ঢাক কাঁধে নিয়েচিল ও। উঠোনে নেচে নেচে ঢাকের বোল তুলে জানান দিয়েছিল রিক্সা চালালেও আসলে সে নেত্য ঢাকির ছেলে। লোকে বলে সেদিন নাকি বুধুর মরণ বিকার উঠেছিল।

বুধু যখন মারা যায় তখন কানুর সবে গোঁফের রেখা গজিয়েছে। সংসারের হাঁ মুখে খাবার ঢালতে সে বয়সেই ওকে চড়ে বসতে হয়েছিল বাপের রিক্সায়। ঠাকুরদার ঢাক কাঁধে তোলার ফুরসত পায় নি। সেই থেকে নেত্যঢাকির নাতির হাতে ঢাক বাজে না বাজে রিক্সার হর্ন।

কানুদের পাড়ায় এখনও কয়েকঘর ঢাকি আছে যারা জাতব্যবসা ধরে রেখেছে। যদিও উৎসবের দিন বাদ দিলে ওরাও অধিকাংশই রিক্সা টানে। উৎসব শেষে ওরা যখন ফের রিক্সা টানার কাজে ফেরে তখন স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে হিসেব এবং নানা আলোচনা হয়। পূজোর দিনগুলোতে কানুও ওদের থেকে খুব কম কিছু রোজগার করে না। কিন্তু ওরা যখন সুনামের কথা বলে, ওদের ঢাকের বোলে মানুষের নেচে ওঠার কথা বলে তখন কানু নিইয়ে যায়।

গত বছরও কানু ভেবেছিল পুজোয় ঢাক বাজাবে। কিন্তু ঢাকের পেছনে খরচ খরচার কথা শুনে শেষমেশ পিছিয়ে এসেছিল। কিন্তু এবছর ওকে যেন ঢাকের বোল ওকে যেন তাড়া করে ফিরছে। পয়সা খরচ করে ঠাকুরদার ঢাকে নতুন ছাউনি পড়িয়েছে। ওর খুব ইচ্ছে ঠাকুরদার মত ঝালোট লাগায়, পায়ে ঘুঙরু বাঁধে। বৌয়ের টিটকিরিতে সে ভাবনাও ত্যাগ করেছে। কিন্ত পুজোয় ঢাক বাজানোর সিদ্ধান্তে এখনো অবিচল ও। বৌ কিছু বললে সটান জবাব দিয়েছে, জানো আমি নেত্য ঢাকির নাতি?

আজ বাড়ি ফিরে কানু পাড়ার চায়ের দোকানে টিভি দেখতে গেল না। ঠাকুরদার বাঁধিয়ে রাখা পায়ের ছাপে প্রনাম সেরে গাব খাওয়ানো,  রোদে স্যাকা টনটনে ঢাকটি নিয়ে নেমে গেল উঠোনে। তারপর শরতের হিম মাখানো সেই সন্ধ্যায় নেত্যর নাতি তার কাঁঠিতেই বোল তুললো, '' ঢ্যাগ না ঢ্যা ঢ্যাং,  ঢ্যাগ না ঢ্যা ঢ্যাং, ন্যাক টা ন্যা টাং ...।''  ধীরেধীরে যতই বাজনার জড়তা কাটতে থাকলো ততই হরিদাসির গালবেয়ে গড়াতে থাকলো জল। মহড়া শেষে কানু দেখতে পেল ওদের বাড়ীর উঠোনে নিজে থেকেই জন্মানো গাছটি থেকে ঝরে পড়েছে অনেকগুলো কমলা বোঁটার সাদা ফুল।

প্রিয়রঞ্জন পাল । উঃ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ