অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
আমাদের অসহিষ্ণু সমাজ (দ্বিতীয়) – সুপ্তা বড়ুয়া

স্বাধীনতা বিষয়টি নিয়ে বারে বারে আমি সন্দিহান হয়ে পড়ি। আমরা মূলত দেশের স্বাধীনতা বলতে একটি দেশের রাজনৈতিক মুক্তিকেই প্রধান মনে করি। কিন্তু স্বাধীনতা অনেকগুলো বিষয়ের সমষ্টি। একটি দেশ কখনোই কি স্বাধীন হতে পারে, যখন তার জনগণের কথা বলার অধিকার রহিত হয়? স্বাধীনতা শব্দটি একটি একক শব্দ, কিন্তু এটার বিস্তৃতি এত বিশাল এবং বহুল যে, স্বাধীনতাকে শুধু ভাত-কাপড়ের সংস্থানেই সীমাবদ্ধ করা যায় না। সামগ্রিক উন্নয়ন এবং সামষ্টিক মুক্তিতেই এটার ব্যপ্তি।

একজন শরীয়ত রয়াতিকে রাষ্ট্র গ্রেফতার করেছে আইসিটি মামলায়। তার অপরাধ সে ধর্ম বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে ক্ষমতাবানদের উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলেছে। অনেকেই এই বিষয়টি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়েছে। অনেকেই এটা বোঝাতে চেয়েছে তার বক্তব্য কতটা সঠিক, আর এক পক্ষ এসেছে তার বক্তব্য কতটা বেঠিক সে বিচার করতে। আমি শুধু বুঝতে পাই না, আপনি যখন বক্তার বক্তব্যকে বিচার করবেন তার উপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের মানদন্ড হিসেবে, হলফ করে বলে দিচ্ছি আপনিও ভুল বলছেন। ‘বয়াতি এটা বললো’ ‘আবরার ওটা লিখলো' ‘অভিজিৎ ধর্মকে অপমান করলো' তার উপর ভিত্তি করে তার উপর জুলুম করা যায় না। একজনের বক্তব্য মিথ্যা, তার মাপকাঠি কি? একজনের বক্তব্য সত্য, তারই বা মাপকাঠি কি?

একজন যদি ভুল বলেন, তার সেই বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে তাকে হত্যা করা, ভয় ভীতি দেখানো, রাষ্ট্র কর্তৃক তাকে জেলে প্রেরণ এগুলো তো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের বহিঃপ্রকাশ। রাষ্ট্র একজন শরীয়ত বয়াতির কথায় এতটা ঘাবড়ে যায় যে, তাকে জেলে না ঢোকালেই নয়। কোনদিন রাষ্ট্র বলবে তুমি কবিতা লিখেছো, সেটার বিষয়বস্তু নিয়ে রাষ্ট্রের শান্তি বিনষ্ট হয়েছে ,তুমিও জেলে চলো। রাষ্ট্র নির্ধারণ করে দেবে আমরা কতটুকু বলবো, কতটুকু লিখবো, তাহলে কেউ তো কিছু বলতেই পারবে না, জনগণের বোবা-বধির হয়ে যেতে হবে। আর এই রূপটাকে স্থায়িত্ব দিয়েছি আমরাই। আমরা নিজেরাই বিশ্বাস করি, কোন একজন তোমার মতের বাইরে একটা কথা বলেছে, তাকে হামলা-মামলা দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া যায়। কিভাবে, কারণ আমরা অন্যায়টার প্রতিবাদ না করে, খুঁজতে গেছি কি কারণে তার প্রতি অন্যায়টা হয়েছে।

শরিয়ত বয়াতি যদি ভুল বলে থাকে, সেই ভুলকে কি যুক্তি দিয়ে খন্ডন করার মতো কোন মানুষ নেই বাংলাদেশের এত এত ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে? যদি থাকে, তাহলে তারা উত্তর দিক। আর যদি না থাকে, তাহলে তার কথার উত্তর দেওয়ার জন্য যথাযথভাবে শরিয়ত বয়াতিকে প্রমাণ হাজির করতে বলুন। গত এক সপ্তাহ আগেও শরিয়ত বয়াতিকে কেউ চিনতো না। আর এখন শুধু মাত্র একটি কথার জন্য, শরিয়ত রয়াতি জেলে আর তার পরিবার আছে সামাজিক হুমকির মুখে। তার সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তার পরিবারকেও নানা ভয়-ভীতিও দেখাচ্ছে স্থানীয় ক্ষমতাশীল ব্যক্তিরা। এই আইসিটি আইনটি মূলত ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের হাতে আরেকটি অস্ত্র দূর্বলকে অত্যাচার করার। পত্রিকায় খবরে প্রকাশ, বয়াতি বাউল গান গাইতো বলে স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা তাকে পছন্দ করতো না। বার বার বয়াতিকে হুমকি দিয়ে আসছিলো এসব ধর্মীয় নেতারা এবং ধর্মীয় ভিত্তি দেখিয়ে গান-বাজনা বন্ধ করতে বলা হয়েছিলো। আর সেজন্যই বয়াতি ধর্মীয় বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে তার গান-বাজনার ভিত্তি সঠিক প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন আর তাতেই ধর্মীয় নেতারা পেয়ে গেলেন হাতে উপকরণ, বয়াতিকে জেলে প্রেরণের।

কিছুদিন আগে আবরার নামে একটা ছেলেকে খুন করা হলো, শুধুমাত্র তার একটা ফেসবুক পোষ্টের কারণে। তখন মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো সেই খুনের বিচার চাইতে। কিন্তু যারা সেদিন সেই ঘটনার বিচার চেয়েছিলো, তাদের মধ্যে অনেকেই চুপ শরিয়ত বয়াতির প্রতি ঘটে যাওয়া এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ব্যাপারে। আমি বার বার বলি, আজকের এই অসহিষ্ণুতার জন্য মূলত আমরা সাধারণ জনগণই দায়ী। আপনি যখন, কনটেন্ট দেখে, জাত দেখে, ধর্ম দেখে কোন একটা মানুষের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিচার চাইবেন, তখনই বুঝতে হবে আপনি অন্যায়ের বিচার চাইছেন না। আপনি “সুবিধাবাদী প্রতিবাদকারী”! কারো ধর্ম-বর্ণ-জাতের উপর নির্ভর করে তার প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিচার যাওয়া ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট জনগণের কাজ! খারাপ লাগছে শুনতে, কিন্তু এটিই সঠিক। অভিজিৎ, অনন্ত, নীলয়, দীপনদের খুন একদিন জায়েজ হয়েছিলো৷ আজ বয়াতির গ্রেফতারকেও জায়েজ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে কিছু মানুষ। আর সেদিন আবরারের জন্য এরাই কান্নাকাটি করেছিলো। বুঝতে পারছেন গলদটা কোথায়?

আমাদের সমাজ নিয়ে একটা খুব আত্ম অহমিকায় ভোগে কিছু মানুষ। ধর্ম আমাদের মুখে মুখে। মুনীর চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’য় একটি লাইন ছিলো, ‘ধার্মিকের ঈশ্বর থাকে ঠোঁটে আর সংস্কৃতিবানের ঈশ্বর থাকে অন্তরে'। আমাদের সমাজে দেখলে এইটার প্রকৃত উদাহরণ ভুরি ভুরি। আমি এমন মানুষ এত দেখেছি, প্রার্থনালয় থেকে বেরিয়ে মানুষকে গালি গালাজ করতে, দশদিনের বিদর্শন ভাবনা করে এসে নিজের স্ত্রীকে মারতে দেখেছি। ধর্মটা কই এখানে? কাদের হাতে ধর্ম? প্রতিদিন ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র গুলোতে হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে শিশু অত্যাচারিত হচ্ছে। তখন কোথায় ধর্ম? ধর্মীয় আলোচনা সভার নামে সারারাত অন্য ধর্মের প্রতি বিষোদগার, তখন কোথায় ধর্ম? আর আজ বয়াতির একটি মাত্র কথায় রাষ্ট্রের ভিত্তি নড়ে গেলো, রাষ্ট্র পড়িমরি করে গ্রেফতার করে ফেললো গরিব লোকটাকে। আর এই আইন এখনো বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে, রাষ্ট্রের আর ধর্মের ভিত্তি যখন টুনকো হয়, তখন তাকে সুরক্ষার জন্য নতুন নতুন অস্ত্র তৈরির প্রয়োজন হয়। জনগণকে সুশাসন দিতে পারে না রাষ্ট্র, উল্টো সামান্য কথার ভিত্তিতে একটি নিরীহ-অসহায় পরিবারকে নানা সমস্যায় ফেলে রাষ্ট্র আর ধর্ম প্রমাণ দিলো কতটা নড়বড়ে তাদের এই ক্ষমতার প্রাসাদ।

শরিয়ত বয়াতি মুক্ত একজন মানুষ, অতি গরিব এবং নিরীহ হলেও ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার মূলে সে আঘাত হানতে পেরেছে। আমরা যারা শিক্ষিত-সুশীলরা ড্রয়িংরুমে বসে আত্মগর্বে আস্ফালন করি, তাদের চেয়ে এরকম একজন রয়াতি’র এ দুটো লাইন শত শত মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করবে। কিছু মানুষের হলেও চোখের কালো পর্দাটা সরিয়ে দেখিয়ে দিলো রাষ্ট্র আর ধর্মের অপরিসীম অক্ষমতাকে। মনে রাখবেন, অক্ষমরাই সামান্য কথায় ক্ষেপে যায় বেশি, ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্ত অস্ত্র নিয়ে। শরিয়ত বয়াতিকে হাজার প্রণতি, এই অক্ষমদের ঘুণেধরা শক্তির মূলে আঘাতটা তিনি করতে পেরেছেন। শরিয়ত বয়াতির মুক্তি চাই!

সুপ্তা বড়ুয়া । অটোয়া, কানাডা