আমাদের অসহিষ্ণু সমাজ (তৃতীয়) – সুপ্তা বড়ুয়া
গতকাল সকালেই ‘আশ্রম’এর জন্য ‘আমাদের অসহিষ্ণু সমাজ’-এর দ্বিতীয় পর্ব লেখছিলাম, তখনও আমি জানতাম না বাংলাদেশে আরো ভুরি ভুরি অসহিষ্ণুতার কাহিনী ঘটে চলেছে। লেখাটা পাঠানোর ২০-৩০ মিনিট পর ছোট্ট একটা লেখা চোখে পড়লো। মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর ‘শনিবারের বিকেল' মুভিটা সেন্সর বোর্ড থেকে ছাড়পত্র পায় নি। কারণ, এই মুভিটির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এসেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা জ্ঞাপন করেছি। কিন্তু এই লেখাটা লিখতে বসেছি অন্য একটা কারণে।
সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছি, ফারুকী'র ‘ব্যাচেলর’ মুভিটা বাজারে তখন। হুমড়ি খেয়ে সবাই দেখছে। আনিসুল হক'এর লেখা আর ফারুকীর পরিচালনা। নব্য শহুরে সংস্কৃতির এক ঝলকে যেন আমাদের মফস্বলেও শিফট করলো। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অসততা, শহুরে সমাজের একাকী জীবন, বিশ্বরাজনীতির প্রভাব আমাদের দেশে, একটি সম্পর্কে স্থির না থাকা মানুষদের গল্প। আমাদের মফস্বলেও এই শহুরে উদ্ভট সংস্কৃতি যেন রাতারাতি প্রবাহিত হতে লাগলো। রাত দুপুরে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন, বন্ধু’র হাত থেকে পেয়ে গেছে অন্য একজন আমার নাম্বার। কত কত কাহিনী সেসব নিয়ে। ফারুকী'কে আমারও ভালো লাগতো নাটক-সিনেমায় ভিন্নতা আনার জন্য। যা হোক, মাঝখানে অনেক বছর কেটে গেলে। সেই আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃদু রোদের মায়া ছাড়িয়ে বরফ শীতের কানাডায় চলে এলাম। কত কিছু দেখছি, কত কিছু জানছি। নিজেকেই যেন এক একবার ভুল মনে হতো।
ফারুকী আমাদের চোখে উন্নত শহুরে সমাজ ব্যবস্থা বলতে যে চিত্র দিতে চেয়েছিলো, যা কেবল বাহ্যিক চাকচিক্যময়। কানাডায় এসে জানলাম, মানুষের উন্নয়ন কিসে, মানুষ সভ্য হয় আসলে কিভাবে, মানবিক জীবন উন্নত হয় কোন ধারায়। বই পড়লাম, নিজেকে জানলাম, নিত্য নতুন মতামতে ভরে উঠলো জীবন। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আরে জীবনের আনন্দ তো বহুমাত্রিকতায়, মিশেল সমাজে। মাঝখানে অনেক সময় কেটে গেলো। আমি ভিন্নই ছিলাম, কিন্তু কানাডার সমাজ ব্যবস্থা আমাকে শেখালো কিভাবে মানুষকে সম্মান করতে হয়, ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধা করতে হয়।
ফেসবুকের জমানা চলে এলো। আর এই ফেসবুকের জমানায় মানুষ নাটক সিনেমার বাইরেও নিজের মতামত দিতে শুরু করলো ফেসবুকের দেওয়াল জুড়ে। কে ভেবেছিলো সেই দেওয়াললিপিতেই একদিন হারিয়ে যাবো হাজার হাজার সম্ভাবনাময় তরুণ, নতুন করে রচিত হবে বাংলাদেশের ইতিহাস। অভিজিৎ খুন হলো, আমাদের জমানাতেই। হূমায়ন আজাদকেও আঘাত করা হয়েছিলো এই মত প্রকাশের কারণে। কিন্তু অভিজিতের খুনীদের সাফাই গাইতে এসেছিলো ফারুকী। আমি খুব সামান্য মানুষ। আমার মতামতে কি আসে যায়। ফারুকীকে সেদিন থেকে আর সহ্য করতে পারছিলাম না। যারা সমাজের বিবেক, সমাজকে নাড়া দেবে তাদের সৃষ্টিকর্মে, এসব কি সেইসব মানুষ, কিভাবে এরা যুক্তি দিচ্ছে মানুষ মারার স্বপক্ষে? আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল, আর আজ বুদ্ধিজীবীর নামে সেসব স্থান দখল করে আছে কারা? ফারুকীর নাটক দেখা বন্ধ করেছি অনেক আগেই। তার বিগত সিনেমাটি নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তারপরও ফারুকীর সিনেমা বন্ধ করে দেওয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানাই।
ফারুকী কি বুঝতে পারছে, যে অসহিষ্ণুতা সে একদিন ভিন্নমত হওয়ার জন্য অভিজিৎ-এর হত্যাতে দেখিয়েছিলো, অভিজিৎদের শিক্ষা এমনই দীপ্ত যে সেই অপপ্রচারকারীদের পাশে দাঁড়াতেই উদ্ধুদ্ধ করে? মেডিকেল প্রফেশনে বলে, সবচেয়ে প্রিয়জনের খুনী কিংবা পিতা-মাতার খুনীও যদি রোগী হয়ে আসে, তাকে মেডিকেল প্রফেশনালদের সেই একই সম্মান আর মর্যাদার সাথে সেবা দিতে হবে সেই খুনীকে। এই একই শিক্ষা তো দিয়ে গেছে হুমায়ুন আজাদ, রাজীব, অভিজিৎ, অনন্তরা। অভিজিৎরা তো মতামত দেখে, ধর্ম দেখে, বর্ণ দেখে মানুষের প্রতি হওয়ার অবিচারের প্রতিবাদ করতে শেখায় নি। তারা মানুষের জয়গান গেয়ে গেছে। নজরুলের মতোই অভিজিৎরা বলেছিলো-
“হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন,
কান্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার”!
ফারুকী কি বুঝতে পারছে, আজ তাকে তারই অস্ত্রে বিদ্ধ করছে সমাজ? কিন্তু সেদিন সে যাদের আঘাতপ্রাপ্ত হতে দেখে হেসেছিলো, তারাই প্রথম প্রতিবাদী কন্ঠ হয়ে তার পক্ষে লড়ছে। এখানেই শিক্ষা আর অশিক্ষার ফারাক। এখানে সৎ-অসৎ-এর ব্যবধান। আরো যারা সাধারণ জনগণ আছে, তারা কি বুঝতে পারছে, একদিন সবার সময়ই আসবে?
সাধারণ জনগণ কখন বুঝবে, আপনি যতই নড়নচড়ন বন্ধ করুন না কেন, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র আর তার ধর্ম সকলের টুটি চিপে ধরবো আরো দিনকে দিন। প্রতিবাদের সময় অনেক আগেই চলে গেছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা কখন আসবে নিজেদের সময়, যতই চুপ থাকো না কেন। রাষ্ট্রের ভীত এত নড়বড়ে যে সামান্য একটা ফু'তেই এটা উড়ে যাওয়ার অবস্থা। রাষ্ট্র আর ধর্মকে প্রতিনিয়ত যেন পাহারায় রাখতে হবে। কতদিন পর আপনার হাসি মাপা হবে, কান্না মাপা হবে, আপনার বাড়ির উঠোনের গাছের পাতায় কতটা বাতাস দোল খাবে তাও মাপা হবে। হাতে ফিতা নিয়ে আপনার প্রতি ইঞ্চি, সেন্টিমিটার নিশ্বাস নেওয়াও মাপা হবে। আপনার পাতে কতটা তরকারি পড়বে সেও যাচাই-বাছাই করা হবে। এদিকে স্বাধীনতার পূর্তি হবে। মুক্তিযুদ্ধ সের ধরে বিক্রি হবে। আপনি কিচ্ছুটি করতে পারবেন না।
এই যে এখন, ফারুকীর পথেই হাটবে অনেকে। খাতা কলম নিয়ে ফারুকী কোন দিকে, কতমাত্রায়, কত সমকোণ বিপরীতকোণে ধর্মকে অপমান করেছে এসবের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট করবে। করুন, সবাই মিলে করুন। আপনাদের যদি ফারুকীকে দেখে শিক্ষা না হয়, আপনারাও করুন। কিন্তু সেই এক কথাই আমার, সেদিনও আপনার জন্য দু'কলম এই আমরাই লিখবো। আমার এতটুকু লেখাতেও হয়তো রাষ্ট্রের ভীত নড়েচড়ে উঠতে পারে, হয়তো আমাকেও হুমকি দেওয়া হবে। কারণ রাষ্ট্র তো কারো কথাই শুনতে চান না, দেখতে চায় না কিছুই লেডি জাস্টিসিয়া'র মতো। পাশাপাশি জনগণও। তবে অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ হয়? হয় না। এ সমাজের ভীতমূলে নাড়া দিতে আরো প্রতিবাদ চাই। আসলে তো আমরা সবাই মনে হয়, ‘বাঁচার নামে আছি মরে'! তবুও আশা অবসান হোক সকল শোষণের, সত্যের আর মানুষের জয় হোক!
সুপ্তা বড়ুয়া । অটোয়া, কানাডা
-
নিবন্ধ // মতামত
-
20-01-2020
-
-