আমি খুনি - শিবব্রত গুহ
দুপক্ষের উকিলের সওয়াল - জবাব শোনার পর, ভিড়ে ঠাসা আদালত কক্ষে চূড়ান্ত রায় শোনানোর আগে, আসামী নিবেদিতা প্রামাণিকের দিকে তাকিয়ে বিচারক বললেন, "তোমার কিছু বলার আছে? বলার থাকলে বলতে পারো।"
নিবেদিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে অশ্রুসজল চোখে বলে, "আমি মনে করি, আমি কোন দোষ করিনি। এর পেছনে অনেক কারণ আছে।"
বিচারক বললেন, "কি কারণ? আমি জানতে চাই।"
নিবেদিতা ভাবলেশহীন মুখে বলে, "সে অনেক কথা। অনেক সময় লাগবে বলতে।"
বিচারক বললেন, "তা লাগুক। আমি শুনবো, তুমি বলো।"
নিবেদিতা বলে চলে, "আমার জন্ম হয় উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির সেবক রোডে। আমার বাবা শিলিগুড়ির এক হাইস্কুলের শিক্ষক। আমার মা সুগায়িকা। মা একজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। আমাদের বাড়িতে মা একটি গানের স্কুল খুলেছিলেন। তার নাম ছিল ‘সুরের ভুবন’।
আমরা তিন বোন। আমি সবার বড়। আমার দুই বোনের নাম হল পারমিতা ও সুচরিতা। আমাদের তিন বোনে মিল খুব। তবে, ঝগড়া যে হয় না, তা নয়। তবে, সেটা সাময়িক। আমাদের তিন বোনকেই আমাদের বাবা-মা খুব যত্ন করে মানুষ করেছেন। আমাদের সংসার ছিল সুখের সংসার।
বেশ আনন্দে কাটছিল দিনগুলো। তখন আমি কলেজে পড়ি। চোখে অনেক স্বপ্ন, মনে অনেক আশা। কলেজে পড়তে পড়তে একটা ছেলের প্রেমে পড়লাম। ছেলেটার নাম চন্দন আগরওয়াল। দেখতে একদম রাজপুত্রের মতো। নাক - চোখ টানাটানা। কলেজে প্রথম দর্শনেই আমি ওর প্রেমে পড়লাম।
আমার গায়ের রং কালো। দেখতে মোটামুটি আমি। তবে, অনেকে বলে, আমার চেহারাতে নাকি একটা আলাদা শ্রী আছে। যেটা নাকি অনেক ছেলের বেশ পছন্দ। জানি না, বাপু, অতশত, সব লাজলজ্জার মাথা খেয়ে, কলেজের নবীনবরণের দিন, আমি নিজে থেকে ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিলাম। ও কিন্তু, সাথে সাথে রাজী হয়ে গেল। যা ছিল আমার কল্পনার অতীত।
এরপর থেকে, আমার দিনগুলো যেন স্বপ্নের মতো কাটতে লাগল। আসলে, জীবনের প্রথম প্রেম তো, তাই। প্রেমের সাগরে আমি খেতে লাগলাম হাবুডুবু। চন্দনের বাবা - মা কেউ নেই। ও মামারবাড়িতে মানুস। ওর মামারবাড়ি শিলিগুড়িতেই অরবিন্দ কলোনীতে। ও এর আগে স্কুল- লাইফে, একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। তার নাম ছিল স্বপ্না। মেয়েটা ওর সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে। সেই আঘাত ও এখনো ভুলতে পারেনি।
চন্দনকে আমি যত দেখতে থাকলাম, ততই অবাক হতে লাগলাম। ছেলেটা এত ভালো! এত সুন্দর ছেলে আমার মতো কালো মেয়ের কপালে ছিল, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। অনেক কিছু ভাবতে শুরু করলাম আমি চন্দনকে নিয়ে। আমার মন প্রাণ জুড়ে শুধু চন্দন আর চন্দন।
ইতিমধ্যে, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, যে, চন্দনের জীবনে যা কষ্ট আছে, তা সব আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে দূর করবো। এটা সত্যি, যে, আমি আমার জীবনের থেকেও চন্দনকে বেশি ভালোবাসতাম। ওকে ছাড়া বাঁচার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কখনো।
চন্দন আর আমি, দুজনে হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে, জীবনে যতই ঝড় - ঝাপটা আসুক না কেন, কেউ কাউকে ছেড়ে যাবো না। আমার দুই বোন আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে সব জানতো। ওদের চন্দনকে খুব পছন্দ হয়েছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে, আমাদের কলেজে পড়াশোনা শেষ হলেই চন্দন একটা ভালো চাকরি পেলেই আমরা বিয়েটা সেরে ফেলবো। আমি চন্দনকে পুরোপুরি নিজের করে পেতে চাইছিলাম।
পরিকল্পনামতো, কলেজের পড়াশোনা শেষ করে চন্দন একটা মাল্টি - ন্যাশনাল কোম্পানিতে একটা ভালো চাকরি পেল। আমার আনন্দ আর ধরে না, আমি খুশিতে ডগমগ হয়ে গেলাম। আমার এতদিনকার স্বপ্ন এবার সত্যি হবে। আমাদের বাড়িতে খুব কড়া শাসন ছিল। আমাদের বাড়িতে কোন পুরুষ বন্ধুর প্রবেশাধিকারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমার বাবা - মা কেউই প্রেম - ভালোবাসা করে বিয়েটাকে পছন্দ করতেন না। তারা এর ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।
এতকিছু সত্ত্বেও, আমি একটা ঝুঁকি নিলাম। এরকম এত বড় ঝুঁকি এর আগে আমি এজীবনে কখনো নিইনি। এক রবিবারে, হঠাৎ করে, আমি, চন্দনকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম। বাবা-মা তো আমার সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু, মুখে তারা কিছু বললেন না। আমি বাবা - মায়ের সাথে চন্দনের আলাপ করিয়ে দিই।
আমি বলি, "বাবা, জানো, চন্দন খুব ভালো ছেলে। ও তোমাদের কিছু বলতে চায়।"
বাবা বললেন, "কি কথা?"
আমি আগ্রহের সাথে বলি, " মানে, মানে..."
মা আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, "সবকথা যদি তুমিই বলবে, তাহলে ও কি বলবে? ওকে কিছু বলতে দাও।"
এবার চন্দন বলে, " আমি আপনাদের মেয়েকে ভালোবাসি। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। আপনাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।"
বাবা রেগে বললেন, " সবকিছু ঠিকঠাক করে এসেছো একেবারে। তোমার সাহস তো কম নয় ছোকরা। আমার মেয়ের বিয়ে কোথায় হবে? তা আমি আর ওর মা ঠিক করবো। তুমি কে হে? বেরোও এখান থেকে।"
চন্দন অবাক হয়ে বলে, " এসব কি বলছেন আপনি? আমি তো অবাক, হয়ে যাচ্ছি। আমি তো আপনার মেয়েকে ভালোবেসেছি। এটা কি অন্যায়?"
বাবা হাত নেড়ে বললেন, " তুমি একজন অবাঙালী ছেলে। আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেবো বাঙালী ছেলের সাথে, কোন অবাঙালী ছেলের সাথে নয়। "
আমি চেঁচিয়ে বলি, " বাবা, তুমি এসব কি বলছো? আমি চন্দনকে ভালোবাসি বাবা। আমি ওর সাথে সংসার করতে চাই, বাবা।"
বাবা রাগতস্বরে বললেন, " বাহ! তোমার তো অনেক উন্নতি হয়েছে। তোমাকে কি আমি এই শিক্ষা দিয়েছি? ছিঃ, ছিঃ, লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য। এই ছেলে তুমি এখনি দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে, আমি আর তোমাকে সহ্য করতে পারছি না। "
চন্দন আমার দিকে তাকিয়ে বলে, " ঠিক আছে, তাই হবে। নিবেদিতা আমি আসছি। তোমার সাথে এইজীবনে আজই আমার শেষ দেখা। ভালো থেকো, সুখী হও।"
আমার বুকে তখন যেন ঝড় উঠলো। আমি বুঝতে পারছি, যে, এবার আমি আমার চন্দনকে সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেলবো। কিন্তু, আমি, আমি যে চন্দনকে বড় ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো কি করে? সঙ্গে সঙ্গে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, যা হয় হবে, আমি চন্দনকে বিয়ে করবো।
আমি একছুটে গিয়ে চন্দনের হাত ধরে বলি, " তুমি একা যাবে না, তোমার সাথে আমিও যাবো।"
চন্দন অবাক হয়ে বললো, " এতুমি কি বলছো? তুমি আমার সাথে যাবে? না না, তুমি তোমার পরিবারের সাথেই থাকো।"
আমি আর কারুর কথায় কান না দিয়ে চন্দনের হাত ধরে সেদিনই আমার বাড়ি ও পরিবার সব চিরকালের মতো ছেড়ে চলে গেলাম। বাড়ীর সবাই আমাকে বারণ করলো। শেষে, বাবা আমাকে হুঁশিয়ারি দিলো, যে, চন্দনকে বিয়ে করলে তাদের সাথে আমার সব সম্পর্ক চিরদিনের মতো শেষ হয়ে যাবে। তাতেও আমি ঘাবড়ালাম না।
এরপর থেকে, শুরু হলো আমার নতুন জীবন, একদম নতুন। একটুও ভয় যে পাইনি, তা নয়। তবে, আস্তে আস্তে তা কেটে যায়। এক্ষেত্রে, চন্দন আমাকে খুব সাহায্য করেছে। আমরা বিয়ে করলাম শিলিগুড়ির এক কালিবাড়ীতে। তারপর, আমরা একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম। আমার দিনগুলো তখন আনন্দে কাটতে লাগলো।
আমাদের বিয়ের একবছর পরে, চন্দন হঠাৎ করে, চাকরীটা ছেড়ে দিল। আমি তো অবাক হলাম ওর এই সিদ্ধান্তে। এবার, ও ব্যবসা শুরু করলো। নতুন ব্যবসা, বেশ উদ্যমে লেগে পড়লো ও। আস্তে আস্তে ব্যবসা জমতে শুরু করলো। এখানে আয় অনেক বেশি। অর্থ রোজগারের নেশা ওকে পেয়ে বসলো।
একবার, এক পার্টিতে, আমাকে নিয়ে গেল চন্দন। আমি সেদিন খুব সেজেছিলাম। ওই পার্টিতে, অনেক নারী - পুরুষ এসেছিল। এরকম পার্টিতে, আমি জীবনে প্রথমবার এলাম। সবাই ড্রিংক করছিল। আমি তো ওই ছাইপাঁশ কোনদিন খাইনি। চন্দনের অনুরোধে, আমি ওই পার্টিতে মদ খেলাম। মদ খাওয়ার পর, আমার মাথাটা কেমন ঘুরে গেল।
তারপর, মদ খেতে ভালোই লাগছিল। শেষে, অনেকটা মদ পেটে যেতেই আমি বেহুঁশ হয়ে যাই। যখন হুঁশ ফিরলো, দেখি, আমি একটা ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। আরে এঘরটা তো আমার নয়। তবে এটা কার ঘর? আমার পাশে শুয়ে আছে একজন পুরুষ। এতো চন্দন নয়। এতো পরপুরুষ। এনাকে তো আমি চিনি না। তাড়াতাড়ি উঠতে গেলাম, হঠাৎ করে, আমার সারা শরীরে এক তীব্র বেদনা অনুভব করলাম। আমার সাজপোশাক সব বিধস্ত হয়ে গেছে। চন্দন কোথায়? চন্দন? কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। আমার সতীত্ব সেদিনই চিরকালের মতো হারালাম আমি।
আসলে, এসব কিছুর জন্য দায়ী আমার স্বামী চন্দন। ব্যবসাতে তাড়াতাড়ি প্রচুর টাকা রোজগারের জন্য ও আমাকে ব্যবহার করে। একটা বড় ব্যবসায়িক কন্ট্রাক পাবার জন্য ও আমাকে ওই পার্টিতে নিয়ে যায়। সেখানে উপস্থিত ছিল বিনোদ জিন্দাল। ইনিই আমার স্বামীকে ওই বড় কন্ট্রাকটা পায়িয়ে দিচ্ছিলেন। তার বিনিময়ে একটু ঘুষ আর কি! একটা রাতের ব্যাপার। একটা রাত শুধু ওনাকে আনন্দ দিতে হতো আমায়। এতো সামান্য ব্যাপার, আজকালকার দিনে ওসব চলে। তাছাড়া, পেটে ভাত না থাকলে কি ইজ্জত দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে জল খাবে?
সেই শুরু, তারপর থেকে, কত পুরুষের যে রাতের শয্যাসঙ্গিনী আমাকে হতে হয়েছে তার ঠিক নেই। প্রতিবারই, চন্দন বলেছে, যে, এই শেষবার। তবে, শেষ আর হয়নি। তখন আমি বুঝতে পারলাম, যে, চন্দনের কাছে আমি হলাম ট্রাম্পকার্ড। ওর জীবনে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। ওর জীবনে টাকাটাই সব। ওর জীবনে, আমার কোন মূল্য আগে থাকলেও এখন আর কানাকড়িও নেই। আমার শরীরটাকে রাতের পর রাত পরপুরুষকে ব্যবহারের সুবন্দোবস্ত করে ও একের পর এক ব্যবসায়ের কন্ট্রাক্ট হাসিল করে ও ধনী হতে শুরু করলো।
আর আমি, সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হতে শুরু করলাম। দু- দুবার আমি গর্ভবতী হলাম। কিন্তু, শয়তান চন্দন আমার দুবারই গর্ভপাত করালো জোর করে। আমি ওর অবাধ্য হলে ও আমাকে অমানুষের মতো মারতো। আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারলাম, যে, ও আর মানুষ নেই। ও একটা আস্ত অমানুষে পরিণত হয়েছে। আমি যাকে মন - প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলাম একি সেই আমার ভালোবাসার মানুষ? এরজন্য, আমি আমার ঘরবাড়ি, পরিবার সব ছাড়লাম, তাকি এই দিন দেখার জন্য? আমার বাবা - মা ঠিকই বলেছিলেন। কিন্তু, এখন সে সব অতীত। আর আমার বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। তবে, এভাবে তো আর বাঁচা যায় না। অসহ্য এজীবন। চন্দনের কাছ থেকে সারাজীবনের মতো দূরে চলে যাবো - এমন সিদ্ধান্ত শেষমেষ নিলাম। বাকি জীবনটা একাই কাটাবো। এত বড় পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার জন্য একটু জায়গা তো হবেই।
দিনটা ছিল শনিবার। আমি চন্দনের কাছ থেকে পালানোর একটা শেষ চেষ্টা করি। কিন্তু, দুর্ভাগ্য, ধূর্ত চন্দনের কাছে আমি ধরা পড়ে যাই। তারপর, যখন, আমাদের মধ্যে ধ্বস্তাধস্তি হচ্ছিল, আমাদের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ঘরে, হঠাৎ করে, তখন, আমার নজর পড়ে খাবার টেবিলের ওপরে রাখা ছুরিটার দিকে। আমি সাথে সাথে ছুরিটা হাতে তুলে চরম আক্রোশে চন্দনের পেটে ক্রমাগত আঘাত করে যেতে লাগলাম। যখন থামলাম, তখন চন্দনের দেহে আর প্রাণ ছিল না।
সমাজের চোখে, আমি খুনি। কিন্তু, আপনারাই এবার বলুন, আমি কি সত্যিই খুনি? বলুন না, বলুন না আপনারা?”
শিবব্রত গুহ । গড়ফা, কোলকাতা
-
গল্প//উপন্যাস
-
23-01-2020
-
-