অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে – সুপ্তা বড়ুয়া

শ্রদ্ধেয় ইমতিয়াজ মাহমুদকে ফেসবুকে ফলো করি অনেক বছর ধরে। উনার লেখা পড়ে এত এতভাবে সমৃদ্ধ হওয়া যায়। তো কিছুদিন আগে উনার একটা লেখা পড়ছিলাম, যদিও পুরো লেখাটা পড়তে পারি নি, তবে ওই লেখায় একটি ভারতীয় মুভিকে আলোকপাত করে উনি লিখেছিলেন। মুভিটির নাম ‘ষাঁন্ড কি আঁখ'। ইদানীং ভারতীয় মুভিগুলো ভিন্ন ধারার বাণিজ্যিক ছবি তৈরিতে বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ঋত্বিক রোশন গণিতের মতো একটা খটমটে বিষয় নিয়ে অনেক সুন্দর একটা মুভি করেছে, ট্রেইলর দেখলাম। তো, লেখাটা পড়তে শুরু করলেও মাঝপথে কিভাবে যেন হারিয়ে গেলো, কিন্তু মুভির নামটা মনে রয়ে গিয়েছিল। পরে মুভিটার ট্রেইলর দেখতে বসি। মুভিটার ট্রেলর দেখেই ভীষণ ভালো লাগলো। দু'জন ষাটোর্ধ মহিলার শুট্যর হওয়ার কাহিনী। বায়োপিক, চন্দ্র তোমর আর প্রকাশ তোমর। ট্রেলর শেষ হওয়ার সাথে সাথে অটোমেটিক তাদের নিয়ে ৭-৮ বছর আগে করা সত্যমেব জয়তো'র একটা পর্ব চলে এলো ইউটিউবে। 

কি দুর্দান্ত এক একটা কাহিনী। ওই পর্বে বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে এমনই সব গল্প হচ্ছিল। মহারাষ্ট্রের নারায়ণ মহাজন, যিনি ওই সময় ৯১ বছর বয়েসী৷ ওই বয়সেই উনি ৩৫০০ ফুট উঁচু পাহাড়ে উঠলেন। উঠেই ক্ষান্ত দিলেন না, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে গেলেন র‍্যপলিং-এর মাধ্যমে। নারায়ণ মহাজন বললেন, ‘বৃদ্ধ বয়সে আমাদের যেন জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি থাকে। আর এই সন্তুষ্টির জন্য মৃত্যুর জন্য আমরা যেন অপেক্ষা না করি শেষ বয়সে’। বৃদ্ধ মানেই সব খুয়ে বসে থাকতে হবে, এমন ধারণাকে আমাদের উপমহাদেশেও যে চ্যালেঞ্জ করছে, ভাবতেই ভালো লাগছে। ওই এ্যাপিসোডে সুন্দর একটা কথা বলা হয়েছে। বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর, রিটায়ার্ড হওয়ার পর আমরা যেন আমাদেরকে আমাদের ছোট ছোট শখ আহ্লাদগুলো পূরণের সুযোগ দেই, যেগুলো এত বছর পরিবার আর সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা পূরণ করার কোন সুযোগ পাই নি। আজকাল মানুষ সহজেই ৭০-৮০ বছর জীবনকাল পাচ্ছে, রিটায়ার্ডম্যান্টের পর আমরা যেন শুধু ধর্মকর্ম আর টেলিভিশন দেখে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করি। আমরা যেন বয়সের সীমারেখায় নিজেদের আবদ্ধ না করি। We don’t need people retired, but rewired!

জীবন আসলে অনেক বর্ণিল, চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আনন্দ, আমরা বাঙালীরা বিশেষ করে, মনে হয় জন্মেই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করি। ২০১৮ সালে, অটোয়ার বাইওয়ার্ড মার্কেটে হঠাৎই নজরে এলো একটা ছয়-সাতজনের দল। সবাই বয়সে ষাটোর্ধ, নারী এবং পুরুষ, ৩জন নারী, ৪ জন পুরুষ।  সবার পিঠেই ব্যাগ-প্যাক, পোল। পড়নে সর্টস, হাফ হাতা গেঞ্জি, মাথায় টুপি। আর দশটা সাধারণ দলের মতো নয়। বন্ধুরা মিলে সাধারণভাবে বাইরে ঘুরতে যায় এমন নয়। একটা রেষ্টুরেন্টে খেতে বসেছে তারা। ঝটপট খাওয়া। কৌতূহল জাগলো। সাধারণত অপরিচিতজনদের সাথে আগবাড়িয়ে কথা বলতে পারি না আমি। কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিচিত এই দলটির সাথে কথা না বললেও মনে হলো কিছু একটা মিস করবো। তাই সামনাসামনি গিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, Would you mind if I talk to you guys? সঙ্গে সঙ্গে সবাই একটা মধুর হাসি দিয়ে একটা চেয়ার বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘Of course mademoiselle’! জিজ্ঞেস করলাম ওরা কোথা থেকে এসেছে, বললো ইউরোপ থেকে। ফ্রান্স, স্পেন আর সম্ভবত একজন ছিলো সুইডেনের। ওরা সবাই ছিলো চাকরিজীবী, দুজন এখনো চাকরিরত, তবে অনেকটা শেষের পথে। যারা রিটায়ার্ড করেছে তারা দুমাসের জন্য ব্যাগপ্যাকিং করছে। তাই যারা চাকরিরত তারাও যুক্ত হয়েছে।  ওদের এবারের ট্যুর উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা। এর আগেও যারা রিটায়ার্ড করেছে তারা ব্যাগপ্যাকিং করতো, তবে এবার আর দু'বন্ধুও যুক্ত হয়েছে যারা এখনো চাকরি করছে। আর দুবছর পর ওই দু'বন্ধুও রিটায়ার্ড করবে, তখন তারা পুরো গ্রুপটাই সারাবছর ব্যাগপ্যাকিং করার পরিকল্পনা করছে। ওদের মধ্যে কারো কারো সন্তানও রয়েছে, সন্তানরা নিজেদের জীবন গোছাচ্ছে, আর পিতা-মাতারা দায়িত্ব পালন শেষে জীবনের রসটুকু আস্বাদন করছে। এর চেয়ে ভালো কাহিনী আর কি হতে পারে। আমার মনটা বিষন্ন হয়ে উঠলো, আহারে জীবনের আনন্দটা আমরা উপভোগই করতে পারি না। ইচ্ছে করছিলো তখনই নিজেও বেরিয়ে পড়ি পৃথিবীটা ঘুরে দেখতে। কত সুন্দর-আনন্দ যে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু দায়িত্ব আর কর্তব্য যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে আছে।

সেবছরই গরমে অটোয়ার কয়েকটি হাইকিং গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে গেলাম। একটু দ্বিধা তো ছিলোই, কিন্তু তারপরও অন্তত কিছুটা হলেও তো ঘোরাঘুরি হবে। পেয়েও গেলাম দুটো ভালো ভালো এ্যাভেঞ্চারাস গ্রুপ। যারা গ্যাতিনোর কাছাকাছি নানা হাইকিং স্পটে হাইকিং করে। সেপ্টেম্বরের শুরুতে Escarpment Eardley নামে একটি স্থানে যাওয়ার জন্য একটা গ্রুপের সাথে রেজিস্ট্রেশনও করে ফেললাম। যথারীতি গেলাম তাদের সাথে, প্রায় ১৫-২০ জনের একটা গ্রুপ। প্রত্যেককেরই আগে হাইকিং করার অভিজ্ঞতা আছে। একমাত্র আমিই নতুন এবং কম বয়স্ক। ৬০-৬৫ বছরের ছিলো বেশির ভাগই। যারা রিটায়ার্ডড, কিন্তু জীবনে আনন্দ উপভোগ থেকে ওরা রিটায়ার্ডড করলো না। খুব উঁচু আর ঢালু সব রাস্তা, প্রায় দশ কিলোমিটার পাড় হতে আমি হাঁপিয়ে উঠলাম, কিন্তু ওই বয়স্ক মানুষগুলো জীবনের রস আস্বাদনে এতটাই আনন্দে পরিপূর্ণ যে, কোন প্রয়োজনই নেই যেন জীবনের অপূর্ণতাগুলো নিয়ে ভাববার।

সে বছরই সেপ্টেম্বরের শেষে গেলাম মঁ-ট্রামব্লা গেলাম, হাইকিং করতে। এবারের পথ, মঁ-ট্রামব্লায় যেদিকে ইলেকট্রনিক ক্যাবগুলো ওঠে তার নীচ দিয়ে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে পায়ে হেঁটে ওঠা যায় পাহাড়ের চূড়ায়। আবারও ২৫-৩০ জনের একটা দল, মূলত কম-বেশি সবাই অবসরপ্রাপ্ত। আবার একই দশা, সবাই পাহাড় বেয়ে তরতরিয়ে উঠে গেলো, আমি আর দূজন মেয়ে আমরাই পড়ে রইলাম পেছনে। আস্তে আস্তে তারপরও উঠলাম, উদ্যম আর নিয়মিতমাফিক জীবন যাপন না করার ফল। সবাই পাহাড়ের মাথায় উঠে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। পাহাড়ের ওঠার পর প্রকৃতির সে নৈসর্গ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা রোমাঞ্চকর লেগেছিলো, এই পাহাড়টা হেঁটে আমি উঠেছি। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের সাথে অনেকেই ছিলো যারা রিটায়ার্ড। এখানে রিটায়ার্ডম্যান্টের পর মানুষের জীবনের আরেকটা রোমাঞ্চকর দিক শুরু হয়। পাহাড় থেকে ফিরতি পথে নামলাম অন্য একটা দিকে, একই ভাবে পায়ে হেঁটে। সবাই গল্প করছে, কার কি প্ল্যান। সবারই প্ল্যান পরবর্তী এ্যাডভেঞ্চারের। এদের দেখে আদৌ মনে হবে না, এরা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে, বরং মনে হবে এরা বুঝি জীবনের নির্যাসটুকু আহরণে ব্যস্ত।

ফিরে আসি সেই গল্পে, যা দিয়ে শুরু করেছিলাম। নাতনীকে শ্যুটিং-এ ভর্তি করাতে এসে দাদী, উত্তর প্রদেশের চন্দ্র তোমর, প্রথম নিশানাতেই থাক লাগিয়ে দিলো ট্রেইনারের। নাতনীর চেয়ে ট্রেইনার দাদীকেই দলে অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী হয়ে উঠলো বেশি। কিন্তু পরিবারের পুরুষ আর সমাজপতিদের ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে চলতে লাগলো দাদীর ট্রেইনিং। দাদী রাত দুপুরে পানিভর্তি জগ নিয়ে হাতের ব্যালেন্স ঠিক করতে লাগলো। বৃদ্ধ হয়ে গেছে বলেই কি অধ্যবসায় থাকবে না ? ট্রেইনার ফারুক পাঠান দাদীকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আগ্রহী করে তোলেন আর প্রথম প্রতিযোগিতাতেই দাদী সিলভার পদক জয় করে ফেলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো। পত্রিকায় নাম উঠলো, ছবি ছাপলো। কিন্তু আবার সেই পরিবার, সমাজপতিদের ভয়ে পত্রিকা লুকিয়ে রাখলো গ্রামে। তবে আস্তে আস্তে একসময় ট্রেইনারের কথায় একটু দ্বিধাবোধের মধ্যেই দাদী পত্রিকা দেখালো পরিবারকে। চন্দ্র তোমরের সন্তাননেরা মায়ের এমন সাফল্যে একেবারেই অভিভূত হয়ে পড়লো। আর নিজের ঝা-এর এমন সাফল্য দেখে আরেক ঝা-এর, প্রকাশী তোমর, ছেলেরাও তাকে ভর্তি করিয়ে দিলো ট্রেনিং-এর জন্য। শুরু হয় দুজনেরই সমানতালে পদক জয়ের হিড়িক। এখন পর্যন্ত প্রত্যেকে ২৫-৩০টিরও বেশি জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং পদক জয় করেছেন। চন্দ্র তোমর পৃথিবীর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ শ্যুটার হিসেবেও ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছে। বৃদ্ধ বয়সে এসব করে নাতনীকেও অনুপ্রাণিত করলেন দাদীরা। নাতনীও দাদীদের এই পথ অনুসরণ করতে লাগলো, এ কথা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য, দাদীরা যদি এ বয়সে এমন জয় আনতে পারে তবে আমরা কেন পারবো না। আর আমার দাদীরা আমাদের প্রদেশে নারীদের জন্য কিছু আগল ভাঙলো। আমাদের দায়িত্ব সেটা আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। উল্লেখ্য নাতনী সোনিয়া তোমর-ও প্রাদেশিক আর কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পদক জয় করে চলেছে। আমাদের উপমহাদেশের সমাজে নারীদের যেসব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সামনে আসতে হয়, তার বিপরীতে এক নতুন পথও উন্মোচন করলেন তারা। তাদের এ জয় শুধু বৃদ্ধদের সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিই পরিবর্তন করেনি, এমনকি নতুন প্রজন্মকে পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, নারীদের জন্য বাধা-বিপত্তির রাস্তা থেকে আরো কিছুটা বাধাও সরিয়েছে। চন্দ্র তোমরের একটা কথা দিয়েই এ লেখার পরিসমাপ্তি আনা যায়, ‘শরীর বৃদ্ধ হয়, মন নয়’! রবীন্দ্রনাথই তাই আমারও আশ্রয়, ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে’। শুধু আমাদের ইচ্ছেটাই জরুরী এ আনন্দধারা আকন্ঠ পানের।

সুপ্তা বড়ুয়া । অটোয়া, কানাডা