অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
মহাপ্রাচীরের মহামৌনতায় – চিরঞ্জীব সরকার

চায়না ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইউনিভার্সিটিতে দুসপ্তাহের একটা কোর্সে অংশগ্রহণের সুযোগ পাই ২০০৮ সালে। চীন দেশে যেতে পারব শুনে বেশ আনন্দিত হলাম। প্রাচীন সভ্যতার দেশ চীন। হিউয়েন সাং, ফা-হিয়েন নামক চৈনিক পর্যটকদের নাম ছোটকালে ইতিহাসের বইয়ে পড়েছি। সেই প্রাচীনকালে তারা ভ্রমণের নেশায় এ অঞ্চলে এসেছিল এবং তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয়ের তথ্য তাদের ডায়রীতে লিখে গেছেন। তখনকার সময় ভ্রমণকারীরা রাজানুকূল্য ও সম্মান পেত। অনেক সময় তারা রাজদরবারের অতিথি হয়ে প্রাসাদে থাকত। বাংলার বিক্রমপুরের ব্রজযোগিনী গ্রামের জ্ঞানতাপস অতীশ দীপঙ্করও তিব্বতে গিয়েছিলেন। কনফুসিয়াসের দেশ চীন। চীনাদের নির্মিত গ্রেটওয়াল প্রাচীন সপ্তাচার্যের একটি। গানপাউডারের আবিস্কারকও এ দেশটি, অবশ্য তাদের আবিস্কৃত এ গানপাউডারই আবার ব্যবহৃত হয়েছে তাদের পরাজিত করার জন্য সাম্র্যাজ্যবাদী শক্তির হাতে।

ড্রাগন এয়ারওয়েজে টিকিট কাটলাম। হংকং হয়ে বেইজিং। হংকং এর গগনচুম্বী অট্টালিকার ছবি অনেক দেখেছি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে। চীনের এক দেশ দুই নীতি অর্থাৎ হংকং এর জন্য আলাদা শাসনব্যবস্থা, এগুলো ইকোনোমিক ম্যাগাজিনের তৎকালীন সময়ের ক্যাচওয়ার্ড। বাসায় যখন আমার চীন ভ্রমণ সংক্রান্ত আলোচনা হচ্ছিল মেয়ে ফিজি তখন থেকেই বলছিল সে আমার সাথে যাবে। আমি ওকে সান্তনা দিবার জন্য বললাম “মা, ঠিক আছে, তুমিও আমার সাথে যাবে।” ছোটরা বড়দের কথা বিশ্বাস করে, কারন বাস্তব জীবনের জটিলতা ও কলুষতা থেকে ওরা মুক্ত। ফিজি ওর মত ব্যাগ গুছানো শুরু করল।

যেদিন রওনা হব সেদিন মেয়ে আমার চেয়েও আগে ঘুম থেকে উঠেছে। জামা কাপড় আর ওর ব্যাগ গুছিয়ে ও রেডি। আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। আমারও ওকে ফেলে কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না। ফিজিকে বললাম, “আমি এয়ারপোর্টে যাচ্ছি, তোমার টিকিট কিনে আনার পর তোমাকে নিয়ে রওয়ানা হব।” ও রাজী হল, আমি সমস্যা থেকে সাময়িক মুক্তি পেলাম। মাইক্রোবাসে খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। তেজগাঁও সাতরাস্তা পার হওয়ার পর মোবাইল বেজে উঠল। ফিজি জিজ্ঞেস করল বাবা টিকেট কেনা সম্পন্ন হয়েছে কিনা। এবার আর মিথ্যা বলতে হল না। বললাম মা, এখনো এয়ারপোর্ট পৌঁছাইনি। ড্রাগন এয়ারওয়েজের প্লেন হংকং এর উদ্দেশ্যে উড়াল দিল। আমি প্লেনের সিটে বসে বার্ডস আই ভিউতে ঢাকাকে দেখছি। পিছনে পড়ে রইল মেয়ের মুখটি।

বেইজিং যাওয়ার পথে কয়েক ঘন্টার জন্য হংকং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যাত্রাবিরতি। প্লেনের উইন্ডো থেকে বাইরে চেয়ে দেখি এয়ারপোর্টটি সমূদ্রের তীরে। সমূদ্রের নীল জল দেখা যাচ্ছে, সাথে নানা সাইজের রং বে-রং এর বোট। সমূদ্রের লাগোয়া এরকম সুন্দর এয়ারপোর্ট পৃথিবীতে খুব কমই আছে।বিকেলের দিকে চীনের রাজধানী বেইজিং পৌঁছলাম। বিশাল এয়ারপোর্ট, সাটল ট্রেনে চড়ে বেরোতে হয়। আমার গন্তব্য চায়না ফরেন অ্যাফেয়ার্স ইউনিভার্সিটির ডরমেটরী। মনে মনে ভাবলাম কেউ যদি রিসিভ করতে আসত তাহলে বেশ সুবিধা হত। এয়ারপোর্টের ফর্মালিটি শেষ করে বের হতে যাব এমন সময় একটি মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল “হ্যাভ ইউ কাম ফ্রম বাংলাদেশ?” আমি উত্তর দিলাম ”ইয়েস”। ও তখন বলল “আই অ্যাম স্যানন, আই হ্যাভ কাম টু রিসিভ ইউ, ডিউরিং ইওর কোর্সেস আই স্যাল অ্যাক্ট অ্যাজ কো-অর্ডিনেটর”। আমি তাকে থ্যাংকস জানিয়ে গাড়িতে চড়লাম।

গাড়িতে বসে বেইজিং এর রাস্তাঘাট দেখছি। কিছুদিন আগে বেইজিং অলিম্পিক শেষ হয়েছে। এ অলিম্পিককে কেন্দ্র করে চীনারা এয়ারপোর্ট, রাস্তাঘাট ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারে অনেক টাকা খরচ করেছে। ছয়, সাত, আট লেনের বিশাল চওড়া রাস্তা। রাস্তাগুলির আইল্যান্ডে প্রচুর ফুল ফুটে আছে। এর ভিতর হালকা গোলাপী রঙের স্থলপদ্ম সবার দৃষ্টি কারে। এ স্থলপদ্ম ফুলের সাথে আমার ছোট কালের পরিচয় আছে। আমাদের বাড়ীর দক্ষিণ দিকে একটি পদ্মফুল গাছ ছিল। শরৎকালে গাছটিতে যখন ফুল ফুটত তখন অপূর্ব লাগত। এয়ারপোর্ট থেকে কিছু সময়ের মধ্যে ইউনিভার্সিটির ডরমিটারীতে পৌঁছলাম। কিছু রেনমিন্বি (চীনা মূদ্রা) দেয়া হল হাত খরচের জন্য। সাউথ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকেও কয়েজজন ডিপ্লোম্যাট এসেছে এই কোর্সে অংশগ্রহণ করতে। এর ভিতর আফগানিস্তানের মুহিব বেশ সুঠামদেহী ও রসিক। কোর্স চলাকালীন সময়ে ও হাস্যরসের মাধ্যমে আমাদের অনেক মজা দিয়েছে। এছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, ভূটান ও নেপালের প্রতিনিধিদের সাথেও আমাদের একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল এ কোর্সকে কেন্দ্র করে।

পরের দিনের কোর্স শুরু হল। চীনের নাম করা শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছিলেন, এর ভিতর প্রফেসর ‘ওটোর’ ক্লাস আমরা খুব উপভোগ করতাম। ভদ্রলোক তিব্বতের বাসিন্দা। অসম্ভব সুন্দরভাবে ক্লাস নিতেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত তার লেকচার শুনতাম। আমাদেরকে একদিন চৈনিক মার্শাল আর্ট দেখানোর জন্য একটি থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। মার্শাল আর্ট শিল্পীদের কলাকৌশল দেখে খুবই শিহরিত হলাম। ফেরার সময় ওদের সাথে বেশ কিছু ছবি তুললাম। মার্শাল আর্টিস্টদের সাথে ছবি তুলবার সময় নিজেকে কেন যেন ব্রুসলি ব্রুসলি মনে হচ্ছিল।

বেজিং এর ফরবিডেন সিটি, টেম্পল অফ হেভেন, তিয়েন আমেন স্কয়ার,বার্ডস নেস্ট স্টডিয়াম যেখানে বেজিং অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলি দেখলাম। এরপর একদিন আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল বাদালিং এ গ্রেটওয়াল দেখাতে। আমরা যেদিন গ্রেট ওয়াল দেখতে গেলাম সেদিন আবহাওয়া বেশ চমৎকার ছিল। রৌদ্রকরোজ্বল দিনের সাথে সুবাতাস বইছিল। আমি গ্রেটওয়ালের দেয়ালের উপরে উঠে কিছুক্ষণ শুয়ে ছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম চীনাদের এ মহাপ্রাচীর নির্মাণের আত্মত্যাগের কথা। কত জঙ্গল, পাহাড়, চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে নির্মাণ করতে হয়েছে এ প্রাচীর। এখানে উল্লেখ্য যে, মঙ্গোলীয়দের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য চীনারা বছরের পর বছর ধরে এ প্রাচীর নির্মাণ করেছে। প্রাচীরের সিঁড়ির কিছুদূর পরপর সামরিক চৌকির মত ঘর। চীনা কৃষকদের ফসল তোলা মৌসুমে মঙ্গোল যাযাবররা অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে তাদের ফসল, সম্পদ লুটে নিত। প্রাচীর নির্মাণের পরও তারা ল্যাডার বা মই নিয়ে এসে এটা টপকিয়ে কখনও কখনও এপাশে ঢুকে পড়ত। চীনাদের ঘামে ও ত্যাগে নির্মিত এ গ্রেটওয়াল পৃথিবীর অন্যতম এক মনুষ্যসৃষ্ট বিষ্ময়। মহাপ্রাচীরকে দেখে মনে হয়েছে সে যেন মহামৌনতায় পর্যবেক্ষন করছে মহাপৃথিবীকে কাল থেকে কালান্তরে।

একদিন বেজিং শহরে একটি অতি পুরাতন মোটা বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় দেখলাম একজন বৃদ্ধা বড় একটি কাপড়ের থলিতে কি যেন বিক্রি করছে দর্শনার্থীদের মাঝে। কিছুসময় পর বৃদ্ধা আমার দিকে তাঁর বোচকাসহ এগিয়ে আসছিলেন।এমন সময় দেখলাম কোথা থেকে এক যুবক পুলিশ এসে তাঁর পন্যের ঝোলাটিকে কেড়ে নিবার জন্য টানাটানি করছে। বৃদ্ধাও আপ্রান চেষ্টা করছে তার সম্বলটুকু আঁকড়ে ধরতে। আমার নিজেকে কেমন জানি অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে মনে ভাবছি আমার দিকে এগিয়ে আসার কারনেই সে হয়ত এ ভয়াবহ বিপদে পড়েছে। একটা পর্যায়ে বৃদ্ধাটি কেঁদে ফেললেন।তাঁর গায়েতো এত শক্তি নাই যে একজন যুবক পুলিশের সাথে টানাটানি করার।আমি শুধু ভাবছি এতো কমিউনিস্ট দেশের মহাশক্তিশালী পুলিশ। তাঁর পন্যও যাবে আবার গাড়িতে উঠিয়েও নিতে পারে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে হাতজোড় করে বৃদ্ধা তাঁর নাতির বয়সী যুবা পুলিশটিকে অনুরোধ করছে তাঁর থলেটাকে ফেরত দিতে। আমি প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম ডিউটিরত একজন পুলিশ তাঁর দায়িত্ব পালন করছে আর একজন সমাজের অসহায় প্রান্তিক মানুষ তাঁর জীবন ও জীবিকার জন্য গায়ের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে লড়াই করছে। যুবক পুলিশটির কেন জানি শেষে দয়া হল।বৃদ্ধার কাপড়ের থলেটা ফেরত দিল। আমার মনে হল পৃথিবীটা এখনো পুরোপুরি রোবট হয়ে যায়নি।

গ্রেটওয়াল ছাড়াও চীনদেশের প্যান্ডা, চাইনিজ ফুড, চাইনিজ ট্রাডিশনাল মেডিসিন, আকুপাংচার চিকিৎসা পদ্ধতি সারা পৃথিবীর কাছে পরিচিত। যদিও চীনের ট্রাডিশনাল মেডিসিনের বিশাল অবৈধ বাজারের কারনে এশিয়া ও আফ্রিকার হাজার হাজার গন্ডার, বাঘ ও হাতি পোচারদের হাতে প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরন করছে। স্বল্প খরচে পন্য উৎপাদনে চীনকে এখনো কেউ পিছনে ফেলতে পারেনি। এ কারনে চীন আজ বিশ্বের ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে পরিনত হয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বদৌলতে তারা আজ কৃত্রিম দ্বীপ,বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল ও হাইপারসনিক মিসাইল তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। প্রাচীন সিল্ক রুটের ট্রেইল ধরে সড়ক ও রেললাইন তৈরী করছে। তিব্বতের মত উঁচু মালভূমিও আজ তাঁদের রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায়। রাশিয়া, কানাডা ও আমেরিকার পর আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ (ছিয়ানব্বই লক্ষ বর্গকিলোমিটার) চীনে বসবাস করে একশ চল্লিশ কোটি মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লোক কথা বলে চাইনিজ ম্যান্ডারিন ভাষায় যার সংখ্যা নব্বই কোটির উপরে।

কোর্সের অংশ হিসাবেই আমাদের আরো কয়েকটি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। বেজিং থেকে উড়োজাহাজে চড়ে হানজুতে আসলাম। হানজু চীনের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। চীনা অধ্যাপকরা যারা আমাদের ক্লাস নিতেন তাঁরা এমনই ধারনা দিলেন। হানজু আসার পর সত্যিই দেখলাম অদ্ভূত সুন্দর এ জায়গাটি। এখানে একটা প্রশস্ত নদীর উপর সুন্দর একটা ব্রীজ। ব্রীজটা অতিক্রম করে হানজু শহরে পৌঁছলাম। এখানকার মূল আকর্ষণ ওয়েষ্টলেক নামক একটি লেক। লেকে লঞ্চে চড়ে ইচ্ছেমত ঘুরলাম। আমরা যখন লেকে চড়ছি তখন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছিল। সবাই লঞ্চের কেবিনে গিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আশ্রয় নিল, আমি করেছি উল্টো। আমি লঞ্চের সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমত ভিজলাম। অন্যরা বলল নিশ্চিত তুমি জ্বরে ভুগবে। আমি জানি, কিছুই হবে না। বৃষ্টির পানি অত্যন্ত বিশুদ্ধ পানি। এতে অবগাহন করলে শরীর ও মন দুটোই শুদ্ধ হয়। যদিও আমি দুবার অন্যের কথা না শুনে মাত্রাতিরিক্ত সময় পানিতে ভিজে প্রচন্ড জ্বরের কবলে পড়েছিলাম। একবার টেকনাফের ‘নাফ’ নদীতে জামা-কাপড় ও জিন্সের প্যান্ট পড়ে প্রায় ঘন্টা খানেক পানিতে নেমে ছিলাম টেকনাফ থেকে কক্সবাজার আসার পথে। সেবার জ্বরে সপ্তাহখানেক ভুগেছিলাম। আর একবার পতেঙ্গা সমূদ্র সৈকতে রাতে অনেক সময় সমূদ্রে নেমে ছিলাম। সেবারও হাঁড় কাঁপানো জ্বর এসেছিল।

হানজুর ওয়েষ্টলেকের কোল ঘেঁষেই অনেক লম্বা একটি প্যাগোডা। প্যাগোডার শীর্ষে দাঁড়িয়ে সেদিন বৈকালিক লেককে পর্যবেক্ষণ করছিলাম এবং ভাবছিলাম শাক্যবংশীয় রাজা শুদ্ধধনের পুত্র মহামতি বুদ্ধের কথা যিনি আধ্যাতিকতার কথা ভেবে একদিন স্ত্রী ও রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। তার সে বাণী পেীঁছে গিয়েছিল দূর্গম পর্বত পেড়িয়ে সুদূর এই চীন দেশেও। হানজু লেকের কাছে সুউচ্চ এ প্যাগোডা তো তারি স্বাক্ষী দিচ্ছে। বাল্যকালে মহামতি বুদ্ধ সিদ্ধার্থ নামে পরিচিত ছিল। বালক সিদ্ধার্থ একদিন একটি লেকের কাছে বসে একঝাক রাজহাঁসের জলকেলী উপভোগ করছিলেন। এমন সময় সে দেখল জলকেলীরত একটি রাজহাঁসকে কে যেন তীরবিদ্ধ করেছে। তীরবিদ্ধ রাজহাঁসটি যন্ত্রনায় ছটফট করছে। বালক সিদ্ধার্থ পরম মমতায় আহত রাজহাঁসটিকে কোলে তুলে নিয়ে তাঁর ডানা থেকে তীরটি তুলে নিজের পরিধেয় কাপড় থেকে এক টুকরো ছিড়ে ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দেন। এমন সময় তাঁর হিংসুটে কাজিন দেবদত্ত এসে রাজহাঁসটিকে সিদ্ধার্থের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। দেবদত্তের দাবী যেহেতু সে রাজহাঁসটিকে তীর মেরেছে সেহেতু এক্ষনে এটির মালিক তিনিই। সিদ্ধার্থ দেবদত্তের এ দাবীকে প্রত্যাখ্যান করে বললেন যেহেতু সে এখন আমার আশ্রিত তাই তাঁকে আমি তোমার হাতে তুলে দিতে পারব না। বাদানুবাদের একটা পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হল এ বিবাদের মিমাংসার ভার তাঁদের গুরুর কাছে ন্যস্ত করবেন। গুরু দুজনার যুক্তি তর্ক শুনে শেষে বললেন যেহেতু সিদ্ধার্থ হাঁসটির জীবন রক্ষা করেছে সেই এখন এর প্রকৃত মালিক। জীবনকে যে ভালবাসতে পারে সেই জীবের মালিক হবার যোগ্য। রাজহাঁসটিকে সুস্থ করে সে এটি আবার মুক্ত নীল আকাশে উড়িয়ে দেয়। সেদিনের সিদ্ধার্থই একদিন বোধি লাভ করে মহামতি বুদ্ধ হয়েছিলেন।

হানজুর পর আমরা গেলাম নিমবো নামক একটি পোর্ট সিটিতে। নিমবোতে আমরা একটা গাড়ীর কারখানা পরিদর্শন করলাম। এর আগে কখনো কোন গাড়ি তৈরীর কারখানা দেখিনি। তাই এটি দেখে বেশ মজাই পেলাম। দুপুরে লাঞ্চ খেলাম শ্রমিকদের সাথে একটা রেস্টুরেন্টে। মুহুর্তের মধ্যে রেস্টুরেন্টের সমস্ত চেয়ার ভরে গেল। বুফে সিস্টেম। আমরাও সবাই প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। চীনা খাবার বেশ সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকরও বটে। সবজির রং অটুট থাকে রান্না করার পরও। ডরমিটারীরর রেস্টুরেন্টেও সুন্দর সুন্দর মেন্যু থাকত। নিম্বো সিটি থেকে অদূরেই একটি জায়গায় সমূদ্রের ভিতরে ব্রীজ তৈরী করা হয়েছে। এটি নাকি পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ ব্রীজ। আমরা ব্রীজের একেবারে কাছাকাছি থেকে ঘুরে এসেছি। ওখানে যাবার পথে দুপাশে মাঠে দেখলাম চীনা কৃষকদের নানা রকম সবজীর ক্ষেত।



নিমবো সিটি ভ্রমণ শেষে আমাদের সাও চিন নামক আর একটি শহরে নিয়ে যাওয়া হল। সাও চিন হল চীনের ভেনিস। আঁকাবাঁকা অনেক ছোট ছোট খালের তীরবর্তী শহরটি। অ্যার্টের জন্যও বিখ্যাত এখানকার গ্যালারীগুলি। বিশেষ করে ক্যালিওগ্রাফি। এহেন কিছু চৈনিক ক্যালিওগ্র্যাফি দেখে সত্যিই আমরা মুগ্ধ হলাম। সাও চীনে থাকাকালীন ওখানে বসেই প্রত্যক্ষ করলাম চীনা মহাশূন্যচারীদের মহাকাশ ভ্রমণ। টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করেছে এ মহাকাশযাত্রা। ১৯৬৯ সালে আমেরিকানদের চন্দ্রাভিযান যাত্রার মত চীনারাও তাদের মহাকাশযাত্রীদের সাফল্যে আনন্দে ফেটে পড়েছিল।

সাতদিন ভ্রমণ শেষে সাও চিন থেকে আবার বেজিং যাত্রা। কোর্সও প্রায় শেষের পথে। ঢাকায় ফোন করলাম। ফিজি বলল, ‘বাবা তুমি তো রোজ রাতে আস, আজ একটু বেশী সময় থাক যাতে আমি ঘুম থেকে উঠে তোমাকে দেখতে পারি’। ফিজির মা ওকে সান্তনা দিবার জন্য বলত বাবা তো রোজ রাতে এসে আবার সকালে চলে যায়। তাই ও আমাকে আজ সকাল পর্যন্ত একটু অপেক্ষার জন্য বলল। টেলিফোনটা আমি ডরমিটারীর বারো তলার ছাদের উপর থেকে করেছিলাম। শো শো বাতাস বইছিল। চোখের কোনে জল এস গেল। মনে মনে ভাবছি চীন ও বাংলাদেশ মাঝে হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব।

চিরঞ্জীব সরকার। অটোয়া, কানাডা