অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
চালতা গাছে গাব - রানা জামান

     মন্ত্রী মহোদয় ক্ষেপে গেছেন ভীষণ রকম। কী করবেন স্থির করতে পারছেন না। টেবিল থেকে পেপারওয়েট তুলছেন আর নামাচ্ছেন। এসময় অফিস সহায়ক হাশেম ধূমায়িত কফি নিয়ে ঢুকলো চেম্বারে। কফির কাপটা সামনে রাখতেই মাননীয় মন্ত্রী কাপটা তুলে ছুড়ে মারলেন।
     অফিস সহায়ক হাশেমের গগনবিদারি আর্তচিৎকারে পুরো মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিবৃন্দ ছুটে এসে মন্ত্রীর চেম্বারের দরজার সামনে এসো জড়ো হলো। সবাই নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করছে: হাশেমকে মারপিট করা ঠিক হয়নি; ও ভুল করলে বা অন্যায় করলে সাসপেন্ড করতে পারতেন অথবা তেতুলিয়া বদলি করে দিতে পারতেন, ইত্যাদি।
     মন্ত্রী মহোদয়ের একান্ত সচিব রবীন্দ্র নিয়োগী এসে সোজা ঢুকে গেলো মন্ত্রীর চেম্বারে। একটু পর-ই হাশেমকে বাম হাতে জড়িয়ে রেখে চেম্বার থেকে বের হয়ে দ্রুত বললো, হাশেমের মুখে গরম কফি পড়েছে! ওকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে নিয়ে যান। কিভাবে ওর মুখে কফি পড়েছে ও সুস্থ হলে ওর কাছ থেকে জেনে নিয়েন। জলদি ওকে নিয়ে যান! জলদি! আমি বার্ণ ইউনিটের প্রধানকে ফোনে বলে দিচ্ছি।
     অফিস সহায়ক হাশেমকে ওখানে রেখে রবীন্দ্র নিয়োগী দ্রুত ঢুকে পড়লো নিজ চেম্বারে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ব্যস্ত হয়ে পড়লো হাশেমকে নিয়ে। ওর মুখে ফোস্কা না পড়লেও লালচে হয়ে গিয়েছে। 
     মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব জহর আলী মোল্লা বললো, মুখের তেমন ক্ষতি হয় নাই। মলম লাগাইলেই সাইরা যাইবো। আমিই ওরে হাসপাতালে নিয়া যাইতাছি। 
     মন্ত্রীর একান্ত অনুগত জহর আলী মোল্লা কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাশেমকে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে গেলো লিফ্টের দিকে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনীর কয়েকজন কর্মচারি পিছু নিলো ওর।
     ওদিকে এই দূর্ঘটনার সংবাদ সচিব আবুল কদ্দুস মাখনের কানে পৌঁছলে সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে কী মনে করে ফের বসে পড়লেন। তাকিয়ে আছেন সামনে সিলিং-এ ঝুলানো টেলিভিশনের দিকে। বিটিভি ওয়ার্ল্ড দেখতে হচ্ছে। সম্প্রতি আদেশ হয়েছে যে অফিসের টিভিতে বিটিভি ছাড়া অন্য কোন চ্যানেল দেখলে খবর হয়ে যাবে! 
     আব্দুল কুদ্দুস মাখন বারবার তাকাচ্ছেন ইন্টারকমের দিকে। মন্ত্রী মহোদয় না ডাকলে সচিব মন্ত্রীর চেন্বারে যান না। যে সংবাদ পেয়েছেন তাতে মন্ত্রীর চেম্বারে নিশ্চয়ই কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সামাল দেবার জন্য তাকে ডাকতেই হবে! ইন্টারকম বেজে উঠতেই রিসিভার তুলে কানে ঠেকিয়ে ওদিকে শুনে বললেন, এক্ষুণি আসছি স্যার!
     সচিব আব্দুল কুদ্দুস মাখন কক্ষ থেকে বের হতেই অফিস সহায়ক হারুন পিছু নিলো। মন্ত্রীর চেম্বারের সীমানায় আসতেই হারুন এগিয়ে গেলো সামনে। কর্মচারিদের সরিয়ে সচিবকে নির্বিঘ্নে মন্ত্রীর চেম্বারে ঢুকার ব্যবস্থা করে দিলো। 
     সচিব আব্দুল কুদ্দুস মাখন চেম্বারে ঢুকে দেখলেন মন্ত্রী হেকমত আলী বসে আছেন মাথা নুইয়ে। আব্দুল কুদ্দুস মাখন মন্ত্রীর মুখোমুখি চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলেন, এই অপকর্মট ক্যামনে করলেন স্যার? 
     মন্ত্রী হেকমত আলী বললেন, গোস্যায় আমার মাথা ঠিক আছিলো না।
     কী নিয়া গোস্যা আপনার স্যার? 
     একটা বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছিলাম আপনাকে। মন্ত্রীর চেয়ারে বসলাম আজ একমাস পার হচ্ছে। কিন্তু আজো ঐ বিষয়ে কোন খোঁজ পেলাম না।
     সচিব আব্দুল কুদ্দুস মাখন একবার জোড়হাত করে বললেন, সরি স্যার! আপনার এক শ দিনের কর্মসূচির টেন পার্সেন্ট বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। বাকি নাইনটি পার্সেন্ট পাঁচ বছরের মধ্যে হয়ে যাবে স্যার! ইট ইজ ফর সিউর স্যার! আপনি কোন বিষয়ে খোঁজ করছিলেন, একটু স্পেসিফিক করে বলতেন যদি স্যার!
     মন্ত্রী হেকমত আলী একটু স্বর চড়িয়ে বললেন, গেলো বার যখন আমি প্রতিমন্ত্রী ছিলাম তখন কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার একটা স্কুলে একটা গাব গাছ লাগাইছিলাম। গাব গাছটায় গাব ধরছে কিনা জানতে চাইতাছি। আমি এর আগে কখনো গাবগাছ লাগাই নাই কিনা! এই দশ বচ্ছরে নিশ্চই গাব ধরছে। কী কন আপনে সচিব সাব?
     সচিব আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে বললেন, ডোন্ট অরি স্যার! এক সপ্তাহের মধ্যে ঐ গাবগাছের গাব এনে আপনাকে খেতে দেবো স্যার! ইট ইজ ফর সিউর স্যার! আপনার মতো আমারও ধারনা এই দশ বছরে নিশ্চয়ই গাব ধরে গেছে গাছটায়। না ধরলেও আমরা ধরিয়ে ফেলবো!
     আমি এটাকে আমার সরকারের একটা সাফল্য হিসাবে দেখাইতে চাইতাছি। গাব আনলে পরথমে আমি নিজ হাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে খেতে দেবো।
     ডোন্ট অরি মাননীয় মন্ত্রী স্যার! আগামী দুই দিনের মধ্যে যাতে আপনি গাব পেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করছি স্যার! আমি এখন আসি স্যার? আগে কাজ, পরে গল্প।
     রাগের মাথায় হাশেমের মুখে গরম কফি ছুইড়া মারছি। কামডা ঠিক হয় নাই। অহন কী করা যায় কন তো সচিব সাব?
     হাশেমকে নিয়ে আপনি চিন্তাই করবেন না স্যার । ওর ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। যতদিন সুস্থ না হবে ততদিন ও ছুটিতে থাকবে। এই ছুটি ওর বার্ষিক মোট ছুটি থেকে কর্তন করা হবে না। এবং সেসাথে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণও দেয়া হবে। আমি এখন যাই স্যার? 
     মাননীয় মন্ত্রী ইতিবাচক মাথা নাড়লে আব্দুল কুদ্দুস মাখন নিজ চেম্বারে ঢুকে ইন্টারকমে অতিরিক্ত সচিব প্রশাসন-১-কে এক্ষুণি আসতে বললেন। 
     হন্তদন্ত হয়ে অতিরিক্ত সচিব আবদেল আনাম ঢুকতেই আব্দুল কুদ্দুস মাখন ক্ষেপে গেলেন ওর উপর, কী করো তুমি সারাদিন? অ্যা?
     অতিরিক্ত সচিব আবদেল আনাম ভড়কে গেলেও সামলে নিয়ে বললো, সরি স্যার! বুঝতে পারছি না!
     মন্ত্রী গরম কফি হাশেমের মুখে মারে নাই, মেরেছে আমাদের মুখে!
     মাননীয় মন্ত্রী এই কাজটা ঠিক করেন নাই। শুনে এলাম মন্ত্রীর এই অপকর্মের বিচার না হলে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিরা স্ট্রাইকে যাবে।
     মন্ত্রীর অপকর্মের বিচার করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তোমাদের বিচার আমাকে করতে হবে এখন!
     ব্যাপারটা এখনো বুঝতে পারি নাই স্যার! মাননীয় মন্ত্রী ক্ষেপলেন কেনো?
     মাননীয় মন্ত্রীর এক শ দিনের কর্মসূচির মধ্যে একটা ছিলো একটা গাবগাছের চারার খোঁজ নেয়া।
     হা হা মনে পড়েছে স্যার! এই রকম একটা কর্মসূচি আছে এক শ দিনের কর্মসূচির মধ্যে।
     কী অবস্থায় আছে গাবগাছের চারাটা বলো। 
     সরি স্যার! আপডেট তো নেয়া হয় নি। আমি এখনই ডিভিশনাল কমিশনারের সাথে কথা বলে আপডেট নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম স্যার।
     শোন, আমি মাননীয় মন্ত্রীকে বলে এসেছি আগামী দুই দিনের মধ্যে গাব খাওয়াবো উনাকে। এটা মাথায় রেখে কাজ করো। যাও! 
     অতিরিক্ত সচিব আবদেল আনাম নিজ কক্ষে এসে চেয়ারে বসে মোবাইল ফোনে রিং করলো ঢাকা বিভাগের কমিশনারকে। বিভাগীয় কমিশনার উলফাৎ আজিজ সাড়া দিতেই বললো, দোস্ত কেমন আছো?
     উলফাৎ আজিজ বললো, সচিব হতে পারবো কী পারবো না এই দুশ্চিন্তায় আছি। 
     কী যে বলো না! তুমি এসেছো পিএম অফিস থেকে। সচিব হওয়া থেকে তোমাকে ঠেকায় কে! এখন আমরা ঠেলা খাচ্ছি হট-টেম্পার্ড মাননীয় মন্ত্রীর।
     বিষয় কী?
     গেলো টার্মে প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার একটা স্কুলে একটা গাবগাছের চারা লাগিয়েছিলেন। এই দশ বছরে গাছটায় গাব ধরার কথা। উনি ঐ গাছের গাব দেখতে চাচ্ছেন। 
     কী বিপত্তি! ডোন্ট অরি ফ্রেন্ড! কিশোরগঞ্জের ডিসির সাথে কথা বলে তোামাকে জানাচ্ছি।
     কোনো জানাজানি না! আগামীকাল সকাল দশটার মধ্যে পজেটিভ রেজাল্ট চাই। ফেল করলে ওএসডি! সচিবের কিছু না হলেও তুমি-আমি স্কেপগোট হবো! 
     ডোন্ট অরি মাই ফ্রেন্ড! গাবের চারাটা না থাকলেও এই দুই দিনে গাবগাছে গাব ধরে যাবে!
     মোবাইল ফোনের লাইন কেটে কিশোরগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসককে রিং করলো উলফাৎ আজিজ। কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাড়া দিতেই বিভাগীয় কমিশনার উলফাৎ আজিজ বললো, জেলায় বসে খালি মিটিং করলেই চলবে, নাকি সরকারের কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করতে হবে, বিকাশ ভদ্র?
     কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক বিকাশ ভদ্র ভড়কে গিয়ে বললো, স্যার! স্যার! আমি প্রতিদিন আমার জেলার আপডেট দেই স্যার। 
     জানি। কিন্তু একটা আপডেট দাওনি আজো। আমিও ভুলে গিয়েছিলাম এই ব্যাপারটা।
     কোনটা স্যার?
     জনকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর এক শ দিনের কর্মসূচিতে একটা ছিলো তোমার জেলার তাড়াইল উপজেলার কোন একটা স্কুলে মন্ত্রী কর্তৃক গেলো টার্মে লাগানো একটা গাবগাছের চারার বর্তমান অবস্থা জানানো। 
     কী বিড়ম্বনা স্যার! দশ বছর আগের গাবের চারা কি এখনো আছে স্যার? গেলো গভমেন্ট ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে এই গভমেন্টের আগের টার্মের সব কাজ বাতিল করে নতুন করে সবকিছু করেছে না স্যার!
     জানি। এই সরকার আগের সরকারের সব বাতিল করে নিজেদের অসমাপ্ত কর্মসূচি পুনরায় শুরু করেছে। বাংলাদেশে এটাই প্রধান সমস্যা। কিন্তু আগামীকালের মধ্যে গাব চাই। মাননীয় মন্ত্রী এই গাছের গাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেবেন।  
     ওকে স্যার। আমি তাড়াইল উপজেলার ইউএনও'র সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করছি। ডোন্ট অরি স্যার! আই উইল ম্যানেজ ইট।
     তাড়াইল উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুনায়েম আজিজ জেলা প্রশাসকের কথা শোনার পর বললো, ডোন্ট থিঙ্ক স্যার। আগামীকাল সকাল দশটার মধ্যেই আমি পজেটিভ রেজাল্ট দিতে পারবো স্যার। 
     বিকাশ ভদ্র বললো, আমি জানি তুমি একটু বেশি কথা বলো। এই গাবের সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জড়িয়ে আছেন। তাই তুমি ফেল করলে থানচি যাবার জন্য রেডি হতে থেকো!
     ইউএনও মুনায়েম আজিজ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে ডেকে নথি ঘেটে স্কুলের নাম বের করে ফেললো। উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে সাথে নিয়ে মুনায়েম আজিজ চলে এলো পুরুরা হাইস্কুলে। স্কুলে আসার সময় মোবাইল ফোনে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির যে ক'জনকে পাওয়া যায় তাদেরকে স্কুলে আসতে বললো। সবাইকে নিয়ে মুনায়েম আজিজ চলে গেলো সরেজমিনে। গাবগাছের চারার বদলে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা চালতা গাছ।

রানা জামান। ঢাকা, বাংলাদেশ