রহস্যের মায়াজাল (এক) - সুজিত বসাক
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল রাকিবের। বাইরে থেকে কিছুটা আলো আসছে, তাই ঘরের ভিতর নিকষ কালো অন্ধকার নেই। একটা ক্ষীণ, কিন্তু তীক্ষ্ণ আওয়াজ আসছে। রাকিব শুয়ে শুয়ে বোঝার চেষ্টা করল আওয়াজটা কিসের! কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারল না। সম্পূর্ণ অচেনা একটা শব্দ। কোথা থেকে আসছে সেটাও ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। উঠে বসল রাকিব। কিন্তু আলো জ্বালল না। নিঃশব্দে বেড়িয়ে এল বাইরে।
বিশাল রাজবাড়ি আধো অন্ধকারে খা খা করছে। কোথাও কোন লোকজনের চিহ্ন নেই। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সদর গেটের সামনের দিকে নিশ্চয়ই পাহাড়াদাররা জেগে রয়েছে, কিন্তু সেটা এখান থেকে অনেকটা দূরে। রাকিবের থাকার ঘরটা দোতলার একদম কোনার দিকে। এটা রাজবাড়ির গেস্ট হাউস। এটার অবস্থান রাজবাড়ির ঠিক পিছন দিক টাতে। আপাতত গেস্ট হাউসে গেস্ট বলতে সে আর অ্যালান্ড স্মিথ রয়েছেন। বাকি ঘরগুলো সব ফাকা।
সামনের দিকে রাজবাড়ির সদর খিলান মায়াবী নগরীর সুরম্য প্রাসাদের মতো সামনের স্নিগ্ধ প্রাকারের জলে তার প্রতিফলন ফেলেছে। রাকিব সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল, টানা বারান্দা নিঝুম, নিশ্চুপ। ধীর পায়ে খুব সাবধানে এগিয়ে চলল সে। সামনেই স্মিথ সাহেবের ঘর। ওঁকে ডাকা কী ঠিক হবে? এতো রাতে ওঁকে ডেকে তোলাটা সমীচীন মনে হল না রাকিবের। আগে শব্দটার উৎস জানা দরকার। তারপর সেরকম কোনো গড়বড় বুঝলে তখন না হয় ডাকা যাবে।
বারান্দা পেড়িয়ে সিঁড়ির মুখে এসে একটু থমকে দাঁড়াল রাকিব। কেউ তাকে অনুসরণ করছে না তো? সমস্ত ইন্দ্রিয় গুলিকে সজাগ রাখার চেষ্টা করল রাকিব। সত্যি কথা বলতে, তার একবারে যে ভয় করছে না তা নয়। তবে ভয়টা অন্যদিকে। দু পেয়ে মানুষের ভয়। সভ্য মানব সমাজের হিসেব নিকেশ একটু অন্য ধরনের! কে জানে হয়তো অজান্তেই সে কোন মানুষের স্বার্থের কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখানে এসে অবধি সে দেখছে মানুষের স্বার্থের অনেক রূপ। অথচ তার পরিপূর্ণ অবয়ব নেই। সেটাই আরও বেশি ভয় করে। কে যে সর্বনাশের চূড়ান্ত রূপ নিয়ে ধূর্ত চিতার মতো ওৎ পেতে আছে ঈশ্বরই জানে। মনে পড়ে গেল মহারাজা বীরেন্দ্র প্রতাপের সতর্ক বানী - “রাত বিরেতে কখনই একা একা ঘর থেকে বেরুবেন না রাকিব।” তখন কথাটার অর্থ বুঝতে পারেনি, কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হল কথাটির কোন গূঢ় অর্থ আছে।
দামাল ছেলে রাকিব। মৃত্যুর মুখ থেকে সে বহুবার ফিরে এসেছে। মৃত্যু ভয়টা তার কাছে বড় কিছু নয়। জীবনের রহস্যটাই অনেক বেশি অর্থ বহ। জীবনের রহস্য উদঘাটনের নেশায় সে ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত।
এই প্রাচীন রাজবাড়ি কে কেন্দ্র করে যে একটা গভীর রহস্য দানা বেঁধে আছে সে বিষয়ে নিশ্চিত রাকিব। কিন্তু কী সেই রহস্য? এই রহস্যের কিনারা তাকে করতেই হবে। একটা যেন নেশায় পেয়ে বসেছে রাকিবকে। মানুষের মন যখন কোন বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে পেয়ে যায় তখন ভয় শব্দটা সত্যি সত্যি অর্থ হীন হয়ে পড়ে। রাকিব বহুবার তার প্রমাণও পেয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল রাকিব। নিচের দিকে কোনার ঘরে দু তিনজন চাকর থাকে। অতিথিদের দেখা শোনা, ফাইফরমাস খাটা, এসবই ওদের কাজ। ওদের ডেকে জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধা হবে বলে মনে হল না। রাকিব নিজেই খুঁজতে লাগল চারদিক। চলবে…
সুজিত বসাক। দিনহাটা, কুচবিহার
-
গল্প//উপন্যাস
-
18-02-2020
-
-