রহস্যের মায়াজাল (দুই) - সুজিত বসাক
পুরো গেস্ট হাউসটা দেখার পর রাকিব চলে গেল পিছন দিকটায়। এখানে অবশ্য শব্দটার অস্বিত্ব পাওয়া গেল না। এ দিকটায় সচরাচর কেউ আসে না। আগে এখানে টেনিস খেলার মাঠ ছিল। মহারাজা বীরেন্দ্র প্রতাপের মেজভাই ধীরেন্দ্র প্রতাপ দারুন টেনিস খেলতেন। বড় বড় সাহেব খেলোয়াড়রা তার সাথে পেরে উঠত না। হঠাৎ করেই তার অকাল প্রয়াণ ঘটেছিল। তারপরে এই রাজ পরিবারের কেউ এই খেলাতে আগ্রহ দেখায়নি। মাঠটাও অনাদরে, অযত্নে রূপ হারিয়েছে। মাঠের ওপাশে ফুলের বাগান। বাগান পেড়িয়ে মস্ত একটা ঝিল। বহু কাল আগে এই বংশের এক রানি দীপশিখা ঝিলটা তৈরি করিয়েছিলেন। তাই ঝিলটা র নাম হয়ে গেছে “ দীপঝিল”।
দীপঝিল পেড়িয়ে ওপাশে গভীর বনাঞ্চল। এখন এই রাজ্যেরই অংশ। আগে ওদিকে বনাঞ্চল পেড়িয়ে অন্য একটা রাজ্য ছিল। হেতমগড়। আরাকানদের আক্রমনে সেই হেতমগড় রাজ্যটি ধ্বংস স্তূপে পরিনত হয়। আরাকানরা ঐ রাজ্যের সীমানা পড়িয়ে এ রাজ্যে ঢোকার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু শোনা যায়, কোনো অজানা কারণে ঐ জঙ্গলে আরাকানদের বহু সেনা মারা যায় । তারপর তারা ভয় পেয়ে আর এগোতে সাহস করেনি। ফলে আরাকানদের হাত থেকে বেঁচে যায় এই রাজ্য।যাবার সময় আরাকানরা ঐ জঙ্গলের নাম রেখে যায় “ মৃত্যু বন”। সে নাম এখনও চলছে। ঐ জঙ্গলের দিকে কেউ ভুল করেও মাড়ায় না।
দীপঝিলের বাধানো ঘাটে এসে দাঁড়াল রাকিব। এদিকে ঘন অন্ধকার। অবশ্য কালো মেঘে ঢেকে থাকা একফালি চাঁদ একটু পরেই বেড়িয়ে এল। নিচের দিকে তাকাতেই ভীষণ অবাক হল রাকিব। ঘাটে একটা ছোট নৌকা বাধা থাকে। নানা কাজে ব্যবহার করা হয় সেটা। রাকিব নিজেও সেটাতে চড়ে দীপঝিলের চক্কর খেয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু এখন সেটা এখানে নেই কেন? কেমন করে স্থানান্তরিত হল? স্থানান্তরিত হয়ে গেলেই বা কোথায়? অনেক গুলো প্রশ্ন একসাথে ভিড় করল রাকিবের মনে।
ঠিক সেই সময়, দূরে দীপঝিলের ওপাশে মৃত্যুবনের দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠল রাকিব। ওপাশে ওটা কিসের আলো ? রাকিব যতদূর জানে, ঐ মৃত্যু বন কে এখানকার মানুষ সব সময় এড়িয়ে চলে। ভাল করে লক্ষ্য করে রাকিব বোঝার চেষ্টা করল ওটা কিসের আলো। দেখে মনে হল, টর্চের আলো হতে পারে।
অকারণে কোনো মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঐ বনে যেতে পারে না। রহস্যের পোকা কিলবিল করতে লাগল রাকিবের মাথার মধ্যে। কিন্তু কোন প্রশ্নের উত্তর এই মুহূর্তে পাওয়া যে সম্ভব নয় সেটাও বুঝতে পারল। তবে যে করেই হোক উত্তর তাকে পেতেই হবে।
যুক্তি দিয়ে ব্যাপার গুলো বোঝার চেষ্টা করল। যদি কেউ এপাশ থেকে ওপারে গিয়ে থাকে তাহলে সেই যে নৌকাটি ব্যবহার করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই যদি হয় তাহলে সে অবশ্যই ফিরে আসবে। রাকিব বুঝল, ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে পারলে কিছু একটা উত্তর এই রাতেই পাওয়া সম্ভব।
আফ্রিকার গহন অরণ্যে এরকম পরীক্ষা রাকিব অনেকবার দিয়েছে। মনে পড়ে গেল বন্ধু লুইসের মৃত্যুর সেই রাতের কথা। ওহ, সে এক ভয়ানক রাত গেছে বটে ! লুইসের জন্য বুকের কোথায় যেন একটা ব্যথা টনটন করে উঠল রাকিবের। ভয়কে কেমন করে জয় করতে হয়, লুইসের কাছেই শিখেছে রাকিব। অমন বড় ভাইয়ের মতো বন্ধু এই জীবনে সে হয়তো আর দেখা পাবে না।
লুইসের ভাবনায় কিছুটা সময়ের জন্য ডুবে গিয়েছিল রাকিব, ক্ষীণ একটা শব্দে সম্বিত ফিরে এল। অস্ফুট ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। নৌকার দাঁড় বাইবার শব্দ। তার মানে সে ফিরে আসছে। রাকিবের রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হল। তার অনুমান মিথ্যে নয়, এপাশ থেকেই কেউ গিয়েছিল ওদিকে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সে। রাকিব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল আঁধার রাতের অতিথির জন্য। ঠিক এই সময় গেস্ট হাউসের দোতলার একটা ঘরে আলো জ্বলে উঠল। রাকিবের বুঝতে অসুবিধা হল না ওটা স্মিথ সাহেবের ঘর। হয়তো উনি বাথরুমে যাবার জন্য উঠেছেন। ওদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাকিব আবার চোখ রাখল দীপঝিলের দিকে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা এখন বন্ধ। সম্ভবত আগুন্তকও ঘরের আলোটা দেখতে পেয়ে চুপ করে আছে।
একটু পরেই নিভে গেল স্মিথ সাহেবের ঘরের আলো। আবার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। ক্ষীণ থেকে স্পষ্ট হতে লাগল। একটু পরেই চোখের দৃস্টির আওতায় চলে এল। নৌকাতে বসে আছে কালো চাদরে ঢাকা একটা ছায়ামূর্তি। এইটুকু আলোতে মুখ দেখে চেনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আরও কাছে আসুক……. অপেক্ষা করতে লাগল রাকিব। ঘাটে নেমে যথাস্থানে নৌকাটাকে বাধল সে। কালো চাদরে ঘোমটার মতো করে মুখ ঢাকা। মুখ না দেখতে পেলেও তার চলার ধরন দেখে সন্দেহ হল রাকিবের। সেই সাথে বিস্ময়ও। এ চলন কোনো পুরুষের নয়, নারীর। কে এই রহস্যময়ী নারী? এত রাতে ঐ ভয়ংকর বনে কেন গিয়েছিল ? ঐ জঙ্গলে অন্য কিছু থাক বা না থাক, হিংস্র জন্তু তো অবশ্যই থাকা সম্ভব। সেসব ভয়ও এর নেই ? কী এমন তাগাদা থাকলে মানুষ এতটা ঝুঁকি নিতে পারে ?
রাকিব আর দেরি করল না। অন্ধকার ফুড়ে বেড়িয়ে এসে সোজা দাঁড়াল তার সামনে। চোখের নিমেষে সরিয়ে দিল তার মাথা ঢেকে রাখা কালো চাদরের আচ্ছাদন। এই মূহুর্তে নারী পুরুষের ভেদাভেদ করার অবকাশ নেই রাকিবের। যেমন করেই হোক রহস্যের শিকড় পর্যন্ত পৌঁছুতেই হবে তাকে। তাই এ সুযোগ হাত ছাড়া করার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
অস্পষ্ট আলো, তবু চিনতে পারল রাকিব। রাজবাড়ির একজন গভরনেস। বেশ কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছে সে এই মহিলার। যদিও কথাবার্তা কিছু হয়নি। বয়স আন্দাজ করা মুস্কিল। চোখে মুখে একটা বয়স্কসুলভ কঠিন্য, যা ওর কঠিন সংগ্রামের ইঙ্গিত দিচ্ছে। রাকিবকে দেখে মহিলাও ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছে। কোনো রকমে বলে – “রাকিব আপনি এখানে?”
রাকিব অবাক হয়ে বলল – “আপনি আমাকে চেনেন?”
“আপনি রাজবাড়ির অতিথি, আপনাকে চিনব না? তাছাড়া আপনার আফ্রিকা অভিযানের কাহিনী আমি পড়েছি। আমি বাঙালি। পেটের টানে এখানে চাকরি করতে এসেছি।”
“এত রাতে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?”
মহিলার আচরণে আচমকাই অসহায় বোধ ফুটে উঠল। হঠাৎ অন্ধকার ঝোপঝাড়ের মধ্যে দ্রুত পা বাড়িয়ে হারিয়ে গেল। রাকিবের মনে হল কোন কিছুতে ভয় পাচ্ছে সে। যাবার সময় শুধু বলল – “ সে অনেক কথা। সুযোগ পেলে সব বলব। তবে আপনার বোধহয় না শোনাই ভাল। রাত করে আর বাইরে থাকবেন না। এখানে অনেক বিপদ…..।”
রাকিব ইচ্ছে করলে ওকে ধরতে পারে। কিন্তু সে চেষ্টা সে করল না। ওকে যখন চেনা গেছে তখন একটু সবুর করা যেতেই পারে। পালিয়ে যাবে বলে মনে হল না। হঠাৎ রাকিবের মনে হল, সে ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে এসেছিল একটা শব্দের সন্ধানে। সেটা আবার কত গভীরে শিকড় বিছিয়ে আছে কে জানে ! আপাতত নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালে রাকিব। একটু পরেই রাজবাড়ির বিশাল ঘড়ি ঢং ঢং শব্দে জানান দিল, রাত দুটো বেজে গেছে। চলবে…
সুজিত বসাক । দিনহাটা, কুচবিহার
-
গল্প//উপন্যাস
-
02-03-2020
-
-