বঙ্গবন্ধু ও স্মৃতিকথা - ইরানী বিশ্বাস
ঠিক মনে নেই কবে কখন প্রথম শুনেছি। গল্পচ্ছলে শুনে শুনে বেড়ে ওঠা। গ্রীষ্মের জোছনা রাতে প্রায়ই আমরা মাদুরপেতে উঠানে বসতাম। যৌথপরিবারে জন্ম, তাই কাকাতো, জেঠাতো মিলে অনেকগুলি ভাই-বোন ছিলাম আমরা। ঠাকুরমা মাঝখানে বসতেন একটা তালপাখা হাতে। আর আমরা ছোটরা তাকে ঘিরে বসতাম। শুরু হতো গল্প বলা। প্রতিদিন গল্প হতো। তবে মাঝে মাঝে গল্পের বাঁক বদল হতো। কোন কোন দিন মহাভারতের গল্প হতো, রামায়ণের গল্প হতো, রাক্ষসের গল্প থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীনের গল্প সবই বলতে থাকতেন ধীরে ধীরে।
দিনের বেলা চান্দার বিলে সকলে লুকিয়ে থাকতো। আর এই ফাঁকে রাজাকার বাহিনী এসে আমাদের ঘর লুট করেছিল। তারপর আর অপেক্ষা না করে পায়ে হেটে যশোহর হয়ে ভারতের লবন হ্রদ ক্যাম্পে গিয়েছিল। ক্যাম্পে কাটানো কঠিন সময়গুলির সাথে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর গল্পও বলতেন। কেন ফিরে এলেন বা কবে ফিরে এলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে পরবর্তীতে পেয়েছি অবাক করা কথা।
১৬ ডিসেম্বর। আজকের সল্টলেক (লবন হ্রদ) ক্যাম্পের আকাশ বাতাস মুখরিত জয়বাংলা শ্লোগানে। সকলেই নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছেন স্বাধীণ দেশে ফেরত আসার জন্য। ঠিক তখন ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষনা দিলেন, যারা যারা থেকে যাবেন ভারতে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কথাটা শুনে আমার ঠাকুর দাদা ও বড় জ্যেঠামশায় রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু আমার বাবা, এবং ঠাকুরমা রাজী হলেন না। কারণ বাবা সম্ভবত তখন এমএ পরীক্ষার্থী। সেই অবস্থায় চলে গেছেন। ফিরে এসে পরীক্ষা দেবার ইচ্ছা আর ছোটকাকা মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। তার সঙ্গে দেখা হয় না। সে কেমন আছে, কোথায় আছে। বাড়ি ফিরে এসে যদি কাউকে না দেখে তখন কি হবে। এই ভেবে ঠাকুরমা অনশন করলেন। যদি দেশে ফেরত না যাওয়া হয়, তাহলে জল স্পর্শ করবেন না। ঠাকুরদাদা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ঘরবাড়ি লুট হয়েছে। এতদিনে ঘর বাড়ি দখল হয়ে গেছে কি না কিছুই জানা নাই। ফিরে গিয়ে কি খাবা? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমাদের দেশের জল খাইয়াও ৬ মাস বাঁচা যায়। আর ঘর যদি না থাকে, গাছ তলায় থাকবো। তবু এই দেশে থাকবো না। অগত্যা ফিরে আসতে হলো।
এসব গল্প শোনা যেন ধীরে ধীরে নেশা হয়ে উঠলো। সম্ভবত ঠাকুরমার মুখের এই গল্প শুনে শুনেই হয়তো আমি আজ গল্পকার হয়ে উঠেছি। প্রায় প্রতিরাতেই বসতো গল্পের আসর। মাঝে মাঝে এই গল্পের আসরে বাড়ির অন্যান্য লোকজন যোগ দিতেন। তারাও ঠাকুরমার সাথে স্মৃতি ভাগাভাগি করতেন। স্বাধীনতার আগে আমার মা দশম শ্রেনীর ছাত্রী ছিলেন। মামা বাড়ি মাদারীপুর তাই তিনি বলতেন সেখানকার মুক্তিযুদ্ধের গল্প। একটা সময় বুঝতে পারতাম এটা শুধু গল্পের আসরই ছিল না। সময় বেড়ে রাত গভীরে প্রবেশ করতো, আর গল্পের আসর হয়ে উঠতো সুখ স্মৃতি হাতড়ে চলা মানুষের হৃদয়ে লালন করা সুখ-দু:খের স্মৃতির মেলা। গল্পচ্ছলে আদান-প্রদান হতো নানান কষ্ট-দু:খ আর স্বাধীনতা অর্জনের গর্বের কথা।
আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি শাখা নদী। এটি মধুমতি ও কুমার নদীর সংযোগ নদী। নদীর এক পাড়ে আমাদের গ্রাম। অন্যপাড়ে সাতপাড় গ্রাম। গোপালগঞ্জ বা ফরিদপুর থেকে সহজেই এই গ্রামে আক্রমন করা যায়। কিন্তু আমাদের গ্রামে আসতে হলে নদী পার হয়ে আসতে হতো। এই নদীতে সারাবছর খেয়া নৌকার ব্যবস্থা ছিল। খেয়া পার না হয়ে আসা সম্ভব ছিল না। তাই বলে বর্বর আক্রমনের হাত থেকে রেহাই পায়নি আমাদের গ্রাম। উজানী বা ভাটিয়া পাড়া হয়ে পাক বাহিনী আসতো আক্রমন করতে।
একদিনের কথা। তখন বোরো মৌসুম। জমিতে ধানের ছড়াছড়ি। সকলের উঠোন ভরা ধান। তবু চোখে মুখে আতংক বেঁচে থাকার জন্য। সারা রাত কেউ ঘুমাতে পারতো না। ঢেকিতে ধান ভানা,রান্না করা অর্থাৎ প্রয়োজনিয় কাজ করতে হতো রাতের আধারে। আর ঘুম থেকে উঠে সকলে চলে যেত চান্দার বিলে। খবর পেলো মেলেটারি আসছে। সকলে বিলের মধ্যে গিয়েছে লুকিয়ে পড়লো। আমার বাবার চাচাতো ভাইয়ের বড় তিন ছেলের পর এক মেয়ে হয়েছে। মেয়ের বয়স ৫ মাস। তাকে কোলে করে অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে নিয়ে তার মা-বাবা ধান ক্ষেতে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। ছোট মেয়েটা গরমে বা পোকার কামড়ে চিৎকার করতে লাগলো। তার বাবা দুই হাত দিয়ে মেয়ের গলা টিপে ধরছে মেরে ফেলার জন্য। কারন এই কান্না শুনলে নিশ্চয়ই মিলিটারী চলে আসবে। আর সকলকেই গুলি করে মারবে। তাই সিদ্ধান্ত হলো বাবা তার তিন ছেলেকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে, আর মা তার মেয়েকে নিয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের গ্রামে আগুন দিয়েছে অনেক ঘর বাড়িতে। আর মানুষ মেরেছে প্রায় ১২০ জনের মতো। পাশ্ববর্তী সাতপাড় গ্রামে ১০৩ জন ভেন্নাবাড়ি ১৩২ জন।
ঠাকুরমার মুখের গল্পগুলি শুনতে শুনতে এক সময় পোড়াপুড়ির বছর, রায়েট, গোলাগুলি, মুক্তিবাহিনী এ শব্দগুলির সাথে খুব পরিচিত হয়েছিলাম। তখন না বুঝলেও পরবর্তীতে এই শব্দগুলির তাৎপর্য বুঝেছি। আমার ছোট কাকা মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে সার্টিফিকেট পেয়েছেন। কিন্তু এরশাদের শাসনামলে কি অভিমান নিয়ে কাউকে না বলে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আর কখনো আসনেনি।
হতে পারে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে জন্ম, হতে পারে গোপালগঞ্জ জেলায় জন্ম, ঠিক কি কারণে শেখ মুজিব নামটা রক্তের সাথে মিশে আছে জানি না। ছোটবেলায় গল্পে গল্পে জেনেছি শেখ মুজিব সম্পর্কে। যতটা রাজনীতির মানুষ সম্পর্কে জেনেছি, তারচেয়ে বেশি জেনেছি একজন জনদরদী হিসাবে। বাড়িতে পারিবারিক গল্পের আসর ছেড়ে স্কুলে গিয়ে কোথাও এই জনদরদী’র কথা লেখা পাইনি। খুব মনে আছে, পাঠ্য বইয়ের ‘সমাজ বই’এ একটা অধ্যায় ছিল যেখানে মুক্তিযুদ্ধের একটা অধ্যায় ছিল। সেখানে স্বল্পপরিসরে শেখ মুজিবুর সম্পর্কে লেখা ছিল। সেখানে ৭মার্চের ভাষণ সম্পর্কে লেখা ছিল। কিন্তু ব্যক্তি মুজিব বা তার আত্মত্যাগের কাহিনী কোথাও পাইনি। হয়তো এ কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী জনগনের মনে বঙ্গবন্ধু নিয়ে কোন আগ্রহ ছিল না। অবশ্য এর যথেষ্ট কারণ ছিল। ওই সময়ে যাদের হাতে দেশ শাসনের দ্বায়িত্ব ছিল তারা শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তা না হলে, যে মানুষটি জীবনের সবটুকু মূল্যবান সময় দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন। অথচ সেই দেশের মানুষ কতোটা অকৃতজ্ঞ হলে সেই ঈশ্বরতুল্য মানুষের বুকে গুলি চালাতে পারে।
বড় হতে হতে নিজের প্রয়োজনে জানতে চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন বই সংগ্রহ করে জেনেছি, সংবাদপত্রে কাজ করার সুবাদে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার সংগ্রহ তাছাড়া শহীদ পরিবারের সঙ্গে কথা বলা, সাক্ষাৎকার সংগ্রহের সৌভাগ্য হয়েছে। তাদের অনেকের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের বই পেয়েছি। এভাবে আমার মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি সহযোগীতা পেয়েছি ‘কারাগারের রোজনামচা এবং ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার পর। আমার একটা কথাই বার বার মনে হয়, আমার মতো কি অন্য সবাই চিন্তা করে বাংলাদেশের রূপকারকে নিয়ে?
আজকে সবাই বঙ্গবন্ধু নামে জানেন, চেনেন সেই মানুষটিকে আমি শেখের ব্যাটা নামেই চিনেছি প্রথম। আমার ঠাকুরমা তাকে শেখের ব্যাটা বলেই পরিচয় করাতেন। ঠাকুরমার শ্বশুরের অর্থাৎ আমার বাবার ঠাকুরদাদা ছিলেন ব্যাবসায়ী। তিনি মারা যাবার পর আমার ঠাকুরদাদা কিছুদিন লোক দিয়ে ব্যাবসা চালাতেন। কারন তিনি ভীষন সৌখিন মানুষ ছিলেন। ব্যবসা করা তিনি পছন্দ করতেন না। যাই হোক, সে সময় আমাদের বড়বড় নৌকা ছিল। যে নৌকায় পাট এবং ধান কেনা বেচা করা হতো। এই নৌকা যেতো মধুমতি নদীর পাড়ে টুঙ্গিপাড়া। কারণ ওই এলাকায় প্রচুর পাট হতো। এভাবেই শেখ বাড়ি এবং বাড়ির মানুষদের সাথে পরিচয় ছিল আমাদের পরিবারের।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেকার কথা। বলা যেতে পারে যুদ্ধের সূত্রপাত যেখান থেকে। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারী ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশ ব্যাপী ছাত্র আরোদালন শুরু করে। এই আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিনত হয়। ১৪৪ ধারা ও কারফিউ ভঙ্গ পুলিশ-ইপিআর-এর গুলিবর্ষণ, বহু হতাহতের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে আইয়ুব সরকার ১ ফেব্রুয়ারী গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানায় এবং বঙ্গবন্দুকে প্যারোলে মুক্তি দান করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। সকলে মুজিবকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ‘গাড়ি রেডি, প্লেনও রেডি। প্যারোলে মুক্তিতে রাজি হয়ে যান। করাচির বৈঠকে গেলে কোন ক্ষতি হবে না। বাইরে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছে বড় মেয়ে হাচিনা। ভেতরে যাবার অনুমতি পাওয়া গেল না। দুই ঘন্টা ঠায় দাড়িয়ে থাকার পর সে দেখতে পেলো তার আব্বা গেটের সামনে এসেছেন। একটা চিঠি এগিয়ে দিতে গেলেই দুজন সেনা মুজিবকে নিয়ে গেলেন ভেতরে। চিঠিটা দেওয়া গেল না।
বেগম মুজিব নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল। একজন বললেন, সরকারের কথা না শুনলে ফাঁসি হবে, খুন হবে। উত্তরে তিনি বললেন, ফাঁসি হলে হোক, বিধাব হলে আমিই হবো। বাবা হারালে আমার সন্তানেরা এতিম হবে, আপনাদের কি? এই দেশটা পায়ে পিষে তিনি প্যারোলে যেতে পারেন না, এটাই আমার শেষ কথা।
বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তিদান প্রত্যাখ্যান করেন। ২৩ ফেব্রæয়ারী রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে প্রায় ১০ লাখ ছাত্র জনতার সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভুষিত করা হয়।
৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। .. একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। .. জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’ রাখা হলো।
বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়মীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলেন, সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহন করবেন। ১৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে ‘নৌকা’ প্রতীক পছন্দ করেন এবং ঢাকার ধোলাইখালে প্রথম নির্বাচনী জনসভার মধ্য দিয়ে নর্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। ২৮ অক্টোবর তিনি জাতির উদ্দেশে বেতার-টিভিতে ভাষণ দেন। ভাষণে জাতির উদ্দেশ্যে আহ্বান জানান ৬ দফা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়যুক্ত করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান সারাদেশের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল আমাদের অতদঅঞ্চলগুলিতেও। সেখানকার মানুষের মধ্যে নির্বাচনের হাওয়া যেন উৎসব হয়ে এসেছিল। দিন রাত সকলের মুখে শুধু একটাই কথা, বঙ্গবন্ধুকে নির্বাচনে জয়লাভ করতেই হবে।
আমার জন্ম গোপালগঞ্জের প্রত্যন্ত এক জলাভুমি এলাকায়। গ্রামের নাম সিংগা। আমাদের গ্রামের নাম বৃহত্তর ফরিদপুরের মধ্যে বেশ নাম ছিল। একটি গ্রাম, একটি ইউনিয়ন। এ গ্রামে ৯ টি পাড়ায় ৯টি প্রাইমারি স্কুল ও একটি হাইস্কুল আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকলেও শিক্ষা দীক্ষায় ছিল বেশ নাম করা। ’৯৮র আগে পর্যন্ত আমি দেখেছি বছরের ৭মাস জল আর ৫ মাস শুকনা মৌসুম। তাছাড়া বাড়তি পাওনা হিসাবে প্রতিবছর বন্যা হতো। এই এলাকার প্রধান যানবাহন বলতে নৌকাই ছিল। স্বাধীনতার আগে বঙ্গবন্ধু জনদরদী নেতা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। গল্পের মধ্যে ঠাকুর মা বেশ গর্বস্বরে বলতেন, শ্যাখের ব্যাটার সাহস আছে। ভয় পায়না কাউরে। একেবারে ঘাড় ত্যাড়া।
সম্ভবত ’৭০র নির্বাচনের কথা। তখন আশ্বিন-কার্তিক মাস হবে হয়তো। তখনকার দিনে আশ্বিন মাসে দূর্গা পূজার মহালয়ার দিন থেকেই শিশির পড়া শুরু হতো। তাই প্রকৃতিতে শীতের আমেজ। নীচু এলাকা হওয়াতে জল নামতে দেরি হতো। চারিদিকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়েছে। হাটে-মাঠে সব খানেই শুধু নির্বাচনী আলাপ।
আমাদের গ্রামের তৎকালিন চেয়ারম্যান ছিলেন কার্তিক বালা। খুব নাম করা লোক। তিনি আমাদের আত্মীয় হন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করতেন। তার মাধ্যমে খবর পাঠানো হলো, সাতপাড় থেকে উজানী পর্যন্ত যত গ্রাম আছে সব খানেই তিনি যাবেন। উজানীতে ছিলেন রাজনীতিবিদ খায়ের মোল্লা। সম্ভবত এই খায়ের মোল্লাই সঙ্গে ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা করতেন নৌকায় করে। ছইতোলা নৌকার ভেতরে বিছানা-বালিশ নিয়ে উঠতেন। এমনকি খাবার দাবারও রাখতেন। কারণ নৌকার গতি খুবই ধীর। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা যেতে সময় লাগতো অনেক। কখনো একদিন দুই দিন লেগে যেতো। এ কারণে প্রয়োজনীয় উপকরণসহ সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন।
একদিন খবর আসলো শেখ মুজিব মুকসিতপুর যাবেন। তবে আমাদের এলাকার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় কয়েকটি বাড়িতে সকলের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। এ খবর পাওয়ার পর আমাদের এলাকার সকল বাড়িতে শেখ মুজিবরকে স্বাগত জানানোর জন্য সকলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমাদের এলাকা হিন্দু এলাকা। সবাই আমাদের গ্রামকে অযোদ্ধা বলে। কারন এখনো কোন মুসলমান আমাদের ইউনিয়নে বাস করে না। শুধু তা-ই নয়। জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের গ্রাম থেকে কোন আযানের শব্দ শুনতে পাইনি।
যা-ই হোক, বঙ্গবন্ধু আসবেন বলে কথা। গ্রাম বাংলার মহিলাদের কৌতুহলের শেষ নেই। এর আগে কখনো এতবড় নেতা তারা চোখে দেখেনি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু নিজেই এজন ঘটনাবহুল গল্পের মতো। জীবনের বাঁকে বাকে জন্ম দিয়েছেন অনেক অবিশ্বাস্য গল্প। হয়তো এ কারণেই তাঁকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কৌতুহলের শেষ নেই। প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে সাজানো হয়েছিল বরণডালা। নতুন কুলায় মঙ্গলঘট, ফুল, তিল, তুলসি, ধান, দূর্বা দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। সকাল থেকে সকলে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
বর্ষাকালে বাড়িগুলি দেখতে ঠিক দ্বীপের মতো মনে হয়। উঁচু টিলার উপরে কিছু ঘর। গাছপালা তেমন ছিল না। কারণ প্রতিবছর বন্যা হয়ে গাছ-পালা মারা যেত। তাই বাড়িতে তেমন কোন গাছ ছিল না। বাড়ির দক্ষিন পাশ ধু ধু করছে জলে। মৃদু বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ খেলা করছে। বাড়ির উৎসুক জনগনের চোখ শুধু সেই ঢেউ খেলা জলের দিকে। কখন সেখানে ভেসে উঠবে বঙ্গ বন্ধুকে বহনকরা নৌকা।
বহু প্রতীক্ষার পর এক সময় নির্বাচনী প্রচারণার নৌকা এসে ভিড়লো আমাদের ঘাটে। বাড়ির সকল মহিলারা এসে বরণডালা নিয়ে উলুধ্বনিতে মুখরিত করেছিল। বঙ্গবন্ধু ছইয়ের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। সকলের উদ্দেশ্যে হাত তুলে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। বাড়ির মহিলারা মিলে প্রচারণা নৌকার গলুইয়ে জল দিয়ে ধুয়ে দিলেন। তারপর সেখানে তেল, সিঁদুর, ধান, দুর্বা, ফুল দিয়ে উলুধ্বনিতে বরণ করেছিল। বঙ্গবন্ধু তখনো অবাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন নৌকায় আর সকলের বরণের দৃশ্য উপোভোগ করেছিলেন। তারপর বঙ্গবন্ধু এগিয়ে আসতেই বাড়ির মহিলারা সেই সুসজ্জিত বরণডালা মাথায় ঠেকিয়ে ধান দুর্বা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আশির্বাদ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন এ দৃশ্য দেখে কোন কথা বলতে পারেননি। আনন্দে চোখ মুছেছিলেন পকেটে থাকা একটি সাদা রুমাল বের করে। আর বলেছিলেন, আমার এই চোখের পানি কান্নার নয়, আনন্দের। এতে আপনাদের ভালবাসা আর আশির্বাদ মিশে আছে। তাই আমি এটা নিয়ে গেলাম। যতœ করে রেখে দিবো। এই কথা বলে রুমালটি পকেটে যত্ন করে রেখে দিলেন। হিন্দু রাজাগণ যখন যুদ্ধে যেতেন তখন বিদায় এবং বরণ করা হতো মিষ্টিমুখ করে। এই মিষ্টিমুখ আসরে থাকে মিষ্টি, দুধ, জল। তাই বঙ্গবন্ধু অবশেষে মিষ্টি, দুধ আর জল খেয়ে বিদায় নিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করার পর প্রথম যখন গোপালগঞ্জ গিয়েছিলেন, সেই জনসভায় আমার বাবা উপস্থিত ছিলেন। এর পর আরো কয়েকবার জনসভায় উপস্থিত থাকার সৌাভাগ্য হয়েছিল।
মাঝে মাঝে গল্পের শেষ হতো ,৭৫ এর ১৫ আগস্টের কাহিনী দিয়ে। তিনি এভাবেই বলতেন, ‘‘একটা মানুষ, সব মানুষরে দেশ দিলো, আর সেই মানুষটারে মারলো! একারে মারলেও একটা কথা ছিল, নির্বংশ করতে হলো?’’ তারপর পিনপতন নিরবতা। শাড়ির আঁচল টেনে চোখ মুছতে থাকতো। আমরা এই কথার কোন অর্থই বুঝতাম না। এমন কি, বুঝতাম না শাঁড়ির আঁচলে লুকিয়ে রাখা স্নেহ মায়ার বন্ধন।
ইরানী বিশ্বাস
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক
ঢাকা, বাংলাদেশ
-
মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিববর্ষ
-
02-03-2020
-
-