অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
দিনাজপুর নাট্যসমিতির 'কনক সরোজিনী' – প্রিয়রঞ্জন পাল

পার বাংলার দিনাজপুর শহরের সঙ্গে আমাদের রায়গঞ্জ শহরের দূরত্ব মেরেকেটে 40 কিলোমিটার। কিন্তু তার মধ্যেই উচিয়ে আছে কাঁটাতারের বেড়া উচিয়ে আছে বন্দুক- সংগীন। সেসব উপেক্ষা করে আমাদের চলাচল তাই সহজ নয় । তাই আমরা হাজার কিলোমিটার দুরে গেলেও দিনাজপুরে যাই না, দিনাজপুরের নাটক দেখি না। কিন্তু সে নাটক  দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল ছন্দম। শতবর্ষীয় দিনাজপুর নাট্যসমিতির  'কনক সরোজিনী' নাটকটি গতকাল দেখলাম ছন্দম মঞ্চে ।

আমি নাট্য বিশ্লেষক, সমালোচক পরিচালক-অভিনেতা এমনকি নিয়মিত দর্শক পর্যন্ত নই। কিন্তু এই নাটকটি দেখে এই নাটক সম্পর্কে লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না । একটি অনবদ্য নাটক আমাদের গতকাল উপহার দিয়েছে দিনাজপুরের নাট্য সমিতি। মাহমুদুল ইসলাম সেলিমের লেখা এই  নাটকে আমরা অবিভক্ত বাংলার সেই সময়ের ছবি দেখতে পেয়েছি যখন ঢাকায় সবে নাট্যচর্চার সূত্রপাত ঘটেছে। পরিচালক নয়ন বার্টেল মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সে কাহিনিকে নাট্যায়িত করতে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের  পারদর্শিতা সেতো তুলনাহীন। অভিনেতা -অভিনেত্রী -পরিচালক- নাট্যকার এবং নেপথ্য কর্মীদের সম্মিলিত প্রয়াসে গতকাল একটি সার্থক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল রায়গঞ্জের ছন্দমে সন্দেহ নেই।

 আমরা দেখলাম উনবিংশ শতকের শেষার্ধে একজন অভিনেত্রীর জীবনের বিভিন্ন দিক। পূর্ববঙ্গের ঢাকা কে কেন্দ্র করে নাট্যচর্চার সূত্রপাতের সময় কেমন ছিল অভিনেতা- অভিনেত্রী এবং থিয়েটার মালিকদের ভূমিকা এই নাটকের মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে। গিরিশচন্দ্র ঘোষের দ্বারা প্রশংসিত বাঈজি কনক অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির হাত ধরে কলকাতা থেকে পৌঁছেছিলেন ঢাকাতে, সেখানে জমিদার রাখাল চন্দ্র বসাকের তৈরি ক্রাউন থিয়েটারে তিনিই হয়ে ওঠেন প্রধান অভিনেত্রী। তার সৌন্দর্যে ও অভিনয়  দক্ষতায় ধীরে-ধীরে সেখানে ভিড় জমাতে থাকেন নাট্যমোদি দর্শকেরা। গড়ে ওঠে একটি নাট্য সংস্কৃতি ।

কিন্তু অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত জীবনে টানাপোড়েন চলতে থাকে। সে টানাপোড়েনের ছবি নাটকে বারবার ধরা পড়ছে।  সুঅভিনেত্রী হয়েও সামাজিক মর্যাদার বিচারে সরোজিনী থিয়েটার মালিক তথা জমিদার রাখাল চন্দ্র বসাকের রক্ষিতার বদলে স্ত্রীর পরিচয়ে পরিচিত হতে পারেননি। বাংলা নাটকের অন্যতম  শ্রেষ্ঠ অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক একই সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার সম্পর্ক পরিস্ফুট হয়েছে এই নাটকটিতে । অতীত এবং সুদূর অতীতের বিভিন্ন দৃশ্য  চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নাটকটিতে ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ফ্ল্যাশব্যাক। (আমার জানা নেই আর কোন পরিভাষা নাটকে ব্যবহৃত  হয়?) 

সাজাহান নাটকের খন্ডাংশ যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা এক কথায় অনবদ্য । সব মিলিয়ে এই নাটকটির নির্মাণ-রচনা- নির্দেশনা সমস্ত কিছুই বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার ।
এই নাটকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সম্পর্কে আলাদা করে বলার দরকার আছে। প্রধান চরিত্রের  চরিত্রাভিনেত্রী সুপ্রিয়া অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পরে যখন জানা গেল এই নাটকেই তার প্রথম অভিনয় তখন বিস্মিত না হয়ে পারা গেল না, একই সঙ্গে প্রত্যাশা তৈরি হল ক্রমশ পরিশীলিত হয়ে তিনি কোন উচ্চতায় পৌছবেন   তা ভেবে। একই রকমভাবে সম্বিত সাহা নানা মাত্রায়  নাটকের প্রধান পুরুষ চরিত্র (রাখাল চন্দ্র বসাক) টি  সফলভাবে চিত্রিত করেছেন। তার  অভিনয় দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু শারীরিক কাঠামো জমিদার সুলভ নয়,(ভূরিভোজের মাত্রা বাড়িয়ে ভুড়িওয়ালা হয়ে উঠুন তিনি)। স্বল্পপরিসরেও তোতা মিয়া বা কাদের সরদারের চরিত্রাভিনেতারা যথেষ্ট দক্ষতায় কমিক রিলিফ দিয়েছেন। অভিনয় দক্ষতায় আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখেন বয়স্কা অভিনেত্রী রেণু আরা। বকিরাও কি কম? ছোট চরিত্রগুলোর অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও অভিনয় নিয়ে যথেষ্ট যত্নবান ।দৃশ্যান্তরের ক্ষেত্রে আলো ও সঙ্গীতের প্রক্ষেপণ যথাযথ মনে হয়েছে।
তবে দারোগা গোলাম মাওলার সঙ্গে বুড়িগঙ্গার তীরে সরোজিনীর হাওয়া খেতে যাওয়ার দৃশ্যটি  অপ্রয়োজনীয়, আলাদা করে কোনো বিশেষত্ব নেই বলেই মনে হয়েছে। তাছাড়া সরোজিনীর কাছে দুটি পিস্তলের বিষয়টিও শেষ পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয়। কারণ দারোগার কাছ থেকে ফেরত পাওয়া পিস্তলের গুলিতেই শেষপর্যন্ত তিনি আত্মঘাতী হয়েছিলেন।

আবার বিনয়ের সঙ্গে জানাই যে আমি নাট্য বিশেষজ্ঞ নই সে কারণেই হয়তো অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা বললাম। ক্ষমা প্রার্থনা করছি। নাট্য সমিতির আরো নাটক দেখার প্রত্যাশা নিয়ে শেষ করছি। দিনাজপুর ঐক্য দীর্ঘজীবী হোক,দিনাজপুরীয় নাট্যচর্চা দীর্ঘজীবী হোক।

প্রিয়রঞ্জন পাল । উঃ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ