অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
অথ মৃগ কথন –চিরঞ্জীব সরকার

মৃগ বা হরিণ হল খুব সুন্দর একটা নিরীহ  প্রাণী। তাঁর  চোখ দুটি বড়ই মায়াবী। ঘাস, লতাপতা খেয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেয়। কিন্তু তাঁর এ রূপের কারণে মানুষ তাকে ধরে খাঁচায় বন্দী করে রাখে। ময়ূর যেমন তাঁর বর্নবিচিত্র রূপের কারণে বন্দীদশা প্রাপ্ত  হয় হরিণের মায়বী রূপও তাঁকে বন্দী করতে মানুষকে প্ররোচিত করে। এছাড়াও আরও কয়েকটা কারণে হরিণকে বিপদের সন্মুখীন হতে হয়। তাঁর সুস্বাদু মাংসের কারণে বনের অন্য হিংস্র প্রাণীরা আহার হিসেবে তাকে পেতে খুব পছন্দ করে। তাঁকে শিকার করে তাঁর চামড়া দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখত অতীতের রাজারা আর অধুনা এলিট শ্রেনীর শৌখিন শিকারীরা। ডালপালার মত আঁকাবাঁকা তাঁর শিংও তাঁকে মারাত্মক বিপদে ফেলে দেয় কখনো কখনো। বাঘ, সিংহ বা অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীরা যখন হরিণকে ধাওয়া করে তখন বনে দৌড়াতে গিয়ে তাঁর ডালপালার মত শিং ঝোপঝাড়ে আটকে যায়। সে আর তখন ছুটতে পারে না। ধরা পরে নিশ্চিত মৃত্যুকে বরণ করতে হয়। তাইতো বলা হয়,”আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।“ হরিণ যখন ছুটতে থাকে তখন সে মাঝে মাঝে পিছু ফিরে তাঁকিয়ে দেখতে চায় তাঁকে যে ধাওয়া করছে তাঁর অবস্থানটা কোন জায়গায়। এ সময় তাঁর দৌড়ানোর গতি শিথিল হয়ে পড়ে। আর এ সুযোগটির সদ্বব্যবহার করে তাঁকে পশ্চাৎধাবনরত বাঘ বা অন্য কোন জন্তু। অনেক দক্ষ শিকারী আবার এ প্রাণীটির অন্য একটি স্বভাবকে ব্যবহার করে তাঁকে ধরে ফেলে। হরিণের এ স্বভাবটি হল সে সংগীতের সুর খুব পছন্দ করে। এহেন শিকারী হরিণকে দেখতে পেলে গাছের পাতা দিয়ে এক ধরনের বাঁশির সুর তুলে মুখে। হরিণ তখন এ সুর শুনে তাঁর কান দুটি খাড়া করে দাঁড়িয়ে পড়ে। শিকারী তখন দন্ডায়মান এ হরিণকে সহজেই তীরবিদ্ধ করে ফেলে।

অনেক গুন ও রূপ হরিণের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে ধরা দেয়। সাত কান্ডের রামায়ন রচনায় হরিণ এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। সীতা যখন একটা মায়া হরি্ণ দেখে গো  ধরল ওটা তাঁর লাগবেই তখনই তাদের বনবাসের জীবনে নানারকম গন্ডগোলের সূচনা হল। তাকে বলা হয়েছিল এটা সত্যিকারের হরিণ না কিন্তু সীতার মন তা বিশ্বাস করল না। রাম আর লক্ষনকে এ হরিণের পিছনে দূরের বনে ব্যস্ততায় রেখে অবশেষে রাবন তাকে অপহরন করে লন্কায় নিয়ে যায়। লন্কা ছারখার করে অবশেষে তাকে এক রক্তক্ষয়ী যু্দ্ধের মাধ্যমে  উদ্ধার করতে হয়। জনক রাজার কন্যা জানকী বা সীতা স্বেচ্ছায় সব কিছু ছেড়ে স্বামীর সাথে অনুগমন করেছিল বনবাসের জীবনে যেখানে তাদের তৃনশয্যায় রাত্রিযাপন করতে হত, বনের ফলমূলে আহার মিটাতে হত। এরকম একটা ত্যাগের জীবনের মাঝেও একটা হরিণের রূপ তাঁকে এতটাই সন্মোহিত করেছিল যে তাঁর বু্দ্ধি বিচলিত হয়ে গিয়েছিল। এ জগত জীবনে আমরাও অনেক মায়া হরিণের পিছে ছুটছি সেগুলির রূপে, চাকচিক্যে আকৃষ্ট হয়ে। আমাদেরকেও যখন কোন প্রকৃত হিতৈষী ওগুলোর পিছনে ছুটতে বাড়ন করে তখন আমরা এতটাই বিমোহিত থাকি যে আমরা তখন সে উপদেশে কান না দিয়ে তাঁর উপর ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠি। হিতৈষীর উপদেশকে তখন উপভোগের পথে কাঁটা সদৃশ মনে হয়।

পুরানে আর একটা হরিণের কথা আমরা জানতে পারি যার কারনে রাজা ভরত তাঁর ব্রত থেকে চ্যুত হয়েছিল। একটা সময় সে রাজকার্য ছেড়ে মন স্থির করে ফেলেন বনে গিয়ে তপস্বীর জীবন যাপন করবে। পঞ্চাশ বছর  বয়সের আগেই সে  বুঝতে পেরেছিল এ প্রাসাদে চিরকাল থাকা যাবে না। আর প্রাসাদের রঙীন জীবনে ভোগ বিলাসটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। মানুষকে ভুলিয়ে রাখে যে এ রঙীন আয়োজন শাশ্বত নহে। ঝাড়বাতির রোশনাই অনন্ত সময় ধরে আলো বিকিরন করবে না। তা এটাই যদি বাস্তবতা হয় তবে এটা থেকে একটু একটু করে সরে গিয়ে সহজ সরল ভাবে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিবে এ আশায় রাজা ভরত বনে গিয়ে লতাপাতা দিয়ে একটা ছোট কুটির বানিয়ে  বনের ফলমূলে আহার মিটিয়ে তাঁর বনবাসের জীবন সুন্দরভাবেই কাঁটাতে লাগল। বাকীটা সময় সে তপস্যা করে ব্যয় করত। একদিন সকালে ভরত যখন তাঁর কুটিরের সামনে বসে ছিল তখন সে দেখতে পেল একটা গর্ভবতী মা হরিণকে একটা সিংহ তাড়া করছে আর হরি্ণটি প্রান বাঁচানোর জন্য প্রচন্ডবেগে দৌড়াচ্ছে। একটা সময় হরিণটি একটি ছোট নদীতে ঝাপ দিল এবং এখানেই সে  ভয়সম্ভূত  মিসক্যারেজে একটি বাচ্চা প্রসব করে কোনমতে নদীর অন্য কিনারে পৌঁছল। কিন্তু প্রচন্ড ক্লান্তি ও অবসাদে মা হরিণটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। ভরত চিন্তা করতে লাগল মা হারা এ মৃগ শাবকটির প্রান রক্ষা করা তাঁর কর্তব্য। তাই সে নদীতে নেমে সদ্য মা হারানো এ বাচ্চা হরিণটাকে ডাঙ্গায় তুলে আনল। এরপর ভরত পরম যত্নে হরিণটিকে প্রতিপালন করতে লাগল। ক্রমে ক্রমে ভরতের জীবন হরিণময় হতে লাগল এবং তাঁর তপস্যার জীবন শিথিল হয়ে পড়ছিল। ভরত যেখানে যায় হরিণটিও তাঁকে সর্বদা অনুগমন করতে থাকে। হরিনটিকে লতা পাতা তৃন খাওয়ানোর নিমিত্তে ভরত কখনো কখনো তাঁকে কোলে বা কাঁধে তুলে বনের এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াত। পরম স্নেহে হরিণটির শরীরে হাত বুলিয়ে দিত। এরকম যখন দিন চলছিল হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে ভরত লক্ষ্য করল হরিণটি উধাউ হয়ে গেছে। অজানা আশংকায় ভরতের মন দুঃশ্চিন্তায় ভরে গেল এই ভেবে হয়ত কোন হায়েনা বা নেকড়ে এসে তাঁর প্রানপ্রিয় হরিণটিকে তুলে নিয়ে গেল কিনা। সে হন্যে হয়ে কুটিরের চারপাশ খুঁজতে লাগল। কোন রক্তছাপ লেগে আছে কিনা সেটাও খেয়াল করতে লাগল। কিন্তু কুটিরের চারপাশে এরকম কোন আলামতের সন্ধান না পেয়ে সে পাগলের মত চিৎকার করে সারা বনে হরিণটির খোঁজ করতে লাগল। অবশেষে সূর্যাস্তের আগে বহুদূরে সে যখন তাঁর পালিত হরিণটির মৃতদেহ দেখতে পেল তখন শোকাকুল ভরত হরিণটির কথা চিন্তা করতে করতে  নিজেই মৃত্যুমুখে পতিত হল। যে রাজা ভরত ত্যাগের জীবন যাপন করবে বলে একটা সময় বিশাল রাজ্য অনায়াসে ত্যাগ করতে পেরেছিল সে কিনা একটা হরিণের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত হয়ে তপস্যার যে লক্ষ্য নিয়ে স বনে এসেছিল তা থেকে বিচ্যুত হল। আমাদের জীবনপথে আমরাও অনেক সংকল্প নিয়ে, লক্ষ্য স্থির করে  অনেকেই অগ্রসর হই কিন্তু এ আসক্তি হরিণের কবলে  পড়ে মাঝখানেই কখনো কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ঠ হয়ে পড়ি।  

হিমালয়ে বাস করে কস্তুরীমৃগ যার নাভী থেকে নিঃসরন ঘটে এক ধরনের রেচকরস যার সৌরভে মৌ মৌ করতে করতে থাকে চারিপার্শ্ব। কস্তুরীমৃগ পাগল হয়ে যায় এ সৌরভের উৎস অনুসন্ধানে। সে বনে পাহাড়ে সবখানে খুঁজতে থাকে কোথা থেকে এ সুগন্ধ উৎসরিত হচ্ছে। এ রকম খুঁজতে খুঁজতে একটা সময়ে সে বড়ই ক্লান্ত ও হয়রান হয়ে পড়ে। শেষে এ সৌরভের উৎস যে স্বয়ং তারি দেহাবস্থিত নাভি তা না জেনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আমরাও জীবনের এ আনন্দমেলায় আনন্দের অন্বেষনে ছুটে বেড়াই কত জনপদে, কত জনের কাছে, পশ্চাৎধাবন করি কত বিচিত্র বস্তুর কিন্তু পরিশেষে সে আনন্দ অধরাই থেকে যায় যদি সেখানে অন্তরের পরিতৃপ্তি না থাকে। তাইতো দেখা যায় বস্তিতে থাকা একটা ছোট ছেলে মাটির সানকিতে তাঁর  মায়ের দেয়া কয়েকদলা ডালমাখানো মোটাচালের ভাত দিয়ে কত আনন্দে আহার করছে কারন সেখানে আছে হৃদয়ের পরিতৃপ্তি। আবার এও দেখা যায় মাছ মাংস দিয়ে পরিপূর্ন বাাহরী প্লেটে পরিবেশিত খাবারেও ধনীদের ছেলেমেয়েরা তেমন একটা আকর্ষন বোধ করছে না কারন সেখানে পরিতৃপ্তির ঘাটতি রয়েছে।

আর একটা হরিণ হল বাস্তব জীবনের সোনার হরিণ। এ সোনার হরিণ এক এক জনের কাছে এক এক রকম। একজন বেকারের কাছে চাকুরী, একজন চাকুরীজীবির কাছে অফিসের সর্বোচ্চ পদ, একজন পদধারীর কাছে সমাজে প্রতিষ্ঠা এভাবে নানারূপে সোনার হরিণটি নানা জনের কাছে ধরা দেয়। আর এটিকে পাবার জন্য আমাদের প্রতিজ্ঞা, “তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই”। সোনার হরিণটি পাওয়ার পর আমরাও আশ্চর্যভাবে লক্ষ্য করি এর গায়েও দুঃখ লেগে আছে কেননা একটা হরিণ সে যতই সু্ন্দর হোক না অসংখ্য দুঃখ  তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় আমৃত্যু।

চিরঞ্জীব সরকার । অটোয়া, কানাডা