অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২ মে, ২০২৪
মা - ফরিদ তালুকদার

(উৎসর্গঃ আমার এবং পৃথিবীর সব মাকে)

মা..
তোমার নিশীথের কান্না ভেসে গেছে আঁধারের স্রোতে 
কেউ শোনেনি..! অবসর তোমার  ছিলো না তেমন কিছু,  
কষ্টের বিলাপ গুলো স্বগোতক্তি হয়ে ঝরেছে, 
কখনো উনুনের লাকড়িতে ফুঁক দিতে দিতে
কখনো বা মিশে গেছে শিল পাটার  ঘর্ষণের সাথে
তারই ফাঁকে সন্তানের মুখে নিয়মিত দিয়ে গেছো বুকের দুধের নহর
আটটি সন্তানে গড়া, একজন মায়ের সংসার জীবনের এই তো সংক্ষিপ্তসার!

কি চেয়েছিলে?  আর কি পেয়েছো?
সে হিসেব মিলানোর হয়তো সময়-ই পাওনি কখনো!
বাবা ছিলেন যেন দায়িত্বে অটল এক যান্ত্রিক কর্ণধার 
যতটুকু মনে পড়ে, একে অপরের মনোজগতে তোমাদের 
কদাচিত ছিলো কোন ঠাঁই,  আর এভাবেই.. 
এতোগুলো বছর..,  শুধু পাশাপাশি দুজনের 

আজ তোমরা কেউ নেই মা..
তুমি চলে গেলে ৮ই মার্চ,  বিশ্ব নারী দিবস
অন্যকিছু লিখবো ভেবেছিলাম 
কিন্তু তার পরিবর্তে..

এখন আমার কাছে
এই দিন, তারিখ, মাস, বছরের গননা
বিশেষ কিছু দিনের এমন বর্ণাঢ্য উদযাপন
এক অনাবশ্যক আয়োজন,  এক অর্থহীন লোকাচার বলে মনে হয়।
মনে হয়..
জন্ম থেকে মৃত্যু,  এই একটিই মাত্র হিসেব আমাদের জীবনে
বাকী সব.., মন ভুলানো এক প্রবোধের খেলা

তুমি চলে গেলে.. 
চলে গেলে এই পার্থিব জগতের সব সম্ভাষণের ওপারে
অথচ.., কি শক্ত করে রেখে গেলে 
তোমার নারীর ছোট্ট বলয়ের বাঁধন..!
রেখে গেলে একটি শব্দ, একটি ডাক.., “মা..”
তুমি শোনো আর না শোনো..
আর একটি জীবন-মৃত্যুর হিসেবের মধ্যে 
অনুক্ষণ আমি ডেকে যাবো তোমায়
মা. মা.. মা…

আমার রক্তে নেশার মতন মিশে আছে যে এই ডাক
সকাল-সন্ধ্যা,  সুখে-দুঃখে, স্বপ্নে-জাগরণে,
অনাবিল উচ্ছ্বাস, গহীন হতাশায়
জীবনের ভয়ংকর মুহূর্তগুলোতে, এই ডাক ই যে, 
আমার সাহস, আমার রক্ষা কবজ হয়ে পাশে দাঁড়াবে
এই নামের বুকেই যে আমার সবচেয়ে শান্তির, সবচেয়ে নিশ্চিন্ত ঘুম...
জীবনে এর চেয়ে বড়ো বিশ্বাস যে আমার আর কিছুতেই নেই মা..!

জীবন আসে জীবন যায়
কিছু কথা লিখে রেখে যায়, নোনা জলের খাতায়
তোমার কষ্ট লিপির শেষ কটা পাতা এখনও খোলা আছে, 
খোলা আছে আমার ভেজা চোখের পাতায় মা..
তোমার অপূর্ণ সব সাধগুলোর তালিকা থেকে, 
এখনো পড়ে নিতে পারি কিছু কিছু 
কিন্তু কি আশ্চর্য,  
শেষ নিঃশ্বাসটুকু হারিয়ে গেলে মহাকালের অসীমে, 
অনন্ত ঘুমে তোমার মুখচ্ছবিতে, 
তার কোন চিহ্নই আর দেখা গেলো না
তুমি শান্তিতে ছিলে মা.. 
খুব শান্তিতে ছিলে 

দিন আর রাতের সন্ধিক্ষণে ঝুলে থাকা সূর্যটা , 
নিভে গেলে হঠাৎ  ঈশান কোণের ছোট্ট  ঝড়ে,
মনে হলো.., 
তোমার জীবনের আরও অনেক কিছুই যে আমার জানা হলো না মা..
আমিতো তোমার মুখ থেকে কখনো শুনতে চাইনি, 
কি লেখা ছিলো তোমার স্বপ্ন বিভোর কৈশোরের পাতায়?
কেমন ছিলো তোমার জীবনের সুন্দর দিনগুলির রং?
অথচ কতো সময় ছিলো, অফুরন্ত সুযোগ 
কিন্ত কেবল দাবী আর আবদারে যে আমার দিন কেটে গেছে
কখনো জানতে চাই নি, 
কি করে তোমার সব ক্ষোভ, সব অতৃপ্তি, সব ব্যাথা
সমুদ্র আধারে নির্বাপিত এক টুকরো অগ্নির মত, কোন অনুযোগ ছাড়াই, 
নিমিষে বিলীন হয়ে যেতো মাতৃত্বের অবর্ণনীয় এক বিশালতার কাছে 

পানগুছি নদী তীরের মুক্ত বাতাসে
দীর্ঘ বেণীর দৃপ্ত আন্দোলনকে ছুঁড়ে দিয়ে
দুরন্ত ছুটে চলা কিশোরী দিনগুলিই কি 
তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলির রং মা..?
তবে তাই থাক..
তোমার জন্যে স্হাপিত আমার মনোমন্দিরে 
তুমি সেভাবেই বেঁচে থাকবে অনাদিকাল মা..,
তুমি ফিরে যাবে অপূর্ণ সেই আপন স্বপ্নের বিভোরে
আমি দেখবো.., 
নদীর তীর ছুঁয়ে, 
তুমি ছুটে চলেছো প্রজাপতির রঙিন ডানায়
বেড়ে উঠছো.., নির্বিকার নক্ষত্রের মতো, আর এক মহানুভবতা নিয়ে

তুমি যে ছিলে এই শাশ্বত বাংলার ই এক কিশোরী 
এই শাশ্বত বাংলার ই এক মায়ের বিশ্বরূপ 
আমার.., আমাদের মা..!!

ফরিদ তালুকদার । টরন্টো, কানাডা