অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
কিলিমাঞ্জেরোর কোল ঘেষে – চিরঞ্জীব সরকার

ছোটকালে ডেনিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রশোর গল্পটি বহুবার পড়েছি। দারুন এক মমতা অনুভব করতাম ক্রশোর জন্য যে কিনা জনমানবহীন একটা দ্বীপে বসে সমূদ্রের দিকে তাঁকিয়ে থাকত সভ্যজগতের কোন মানুষ কবে এসে তাঁকে উদ্ধার করবে এ আশায়। আফ্রিকাতে এসে যখন সুযোগ হল দার এস সালাম যাওয়ার তখনি মনে হল আমিও যেন কবেকার কোন পালতোলা জাহাজে করে দার থেকে মসলার দ্বীপ জাঞ্জিবারে যাচ্ছি আর কোন এক সামুদ্রিক ঝড় এসে আমার জাহাজটিকে ডুবিয়ে দিল। ক্লান্ত ক্ষুধার্ত আমি আশ্রয় পেলাম নাম না জানা সবুজে ঘেরা ছোট্ট একটি দ্বীপে যেখানে আমার ঘুম ভাঙ্গে অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে, বনের ফলমূলে আহার মিটে আর প্রতীক্ষায় থাকি আগামীতে এদিকে আসা কোন এক মনুষ্যবাহিত ডিংগি নৌকোর যে আবার আমাকে নিয়ে যাবে আমার ফেলে আসা পিছনের পৃথিবীতে।

২০১৩ এপ্রিলের কোন এক বিকেলে নাইরোবীর জোমো কেনিয়েটা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে তাঞ্জানিয়ার দার এস সালামের উদ্দেশ্যে রওহনা হই। রাষ্ট্রদূত ওয়াহিদুর রহমান স্যার তাঞ্জানিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাকায়া কিকোয়েতের কাছে পরিচয় পত্র পেশ করবেন, সাথে দূতাবাসের সেকেন্ডম্যান হিসাবে আমিও যাচ্ছি।  প্লেনে আমার উইন্ডো সিট পড়ল, তাই বাইরের আকাশ আর ভূপৃষ্ঠ দেখতে পারছি একমনে। আকাশযান কিছুক্ষন ওড়ার পর দৃষ্টিগোচর হল পূর্ব আফ্রিকার পর্বতশৃঙ্গমালার। পড়ন্ত বিকেলের লাল সূর্যরশ্মি যখন পর্বতশীর্ষে প্রতিফলিত হচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল নীচে যেন এক লাল আলোর সমূদ্র বয়ে যাচ্ছে আর আমি মেঘনাদ বধ কাব্যের রাবনের মত অনেক উঁচুতে বসে আলোর পৃথিবীকে দেখছি মাইকেলের ভাষায় এভাবে “কনক উদয়াচলে দিনমনি যেন অংশুমালী।“

দার এস সালামের এয়ারপোর্টের ফর্মালিটি শেষ করে হোটেলে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। ভারত মহাসাগরের কোলে দার এস সালাম বন্দরের একেবারে কাছেই হোটেলটি। একটু বিশ্রাম নিয়ে হোটেল রুমের ব্যালকনীতে বসে বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজের বাতিগুলি দেখছি। সমূদ্রের জলে চাঁদের আলো পড়ে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরী হয়েছে। মনে হচ্ছিল আমি যেন নাবিক হয়ে চাঁদের আলোর এ সৌন্দর্যের বন্যায় দূর অতীতের কোন এক পালতোলা জাহাজের মাস্তুল ধরে দাঁড়িয়ে আছি আর চেঁয়ে আছি তারাভরা রাতের আকাশের এক রহস্যেঘেরা দিগন্তের পানে।

জুলিয়াস নায়ারের দেশ তাঞ্জানিয়া। প্রায় সারে নয় লক্ষ বর্গকিলোমিটারের পূর্ব আফ্রিকার এ দেশটির প্রকৃতি অনেকটাই আদিরূপে এখনও টিকে আছে। এর ভূপ্রকৃতি বৈচিত্রময়। তৃনভূমি থেকে শুরু করে বিশাল লেক, পর্বত, জঙ্গল সব কিছুর দেখা মেলে এখানে। প্রতিবছর এখানকার সেরেংগাটি থেকেই মিলিয়নেরও বেশি ওয়াইল্ডবিস্ট ও জেব্রার ছুটে চলা শুরু হয় কেনিয়ার মাসাইমারার দিকে যেটাকে বলা হয় প্রানী জগতের ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’। তাঁদের এ ছুটে চলা দেখে মনে হয় আমরা মানুষেরাও তো আমৃত্যু ছুটে চলছি। ওরা ছুটে চলে জীবনের বেইজ নিড অর্থাৎখাদ্যের সন্ধানে। আমাদের চাওয়া পাওয়া হয়ত ওদের চেয়ে অনেক অনেকগুন বেশী। ওরা যখন মারা নদীতে ঝাপ দেয় তখন মৃত্যুদূত কুমীর ওদের কাউকে ধরে ফেলে, আর ফিরে যেতে পারে না ওপারের তৃনভূমির চারনক্ষেত্রে। আমাদের জীবনের এ রহস্যঘেরা যাত্রাপথে মারা নদীর শিকারের আশায় প্রতিক্ষারত সে কুমীরগুলির মত কত রকমের দূর্ঘটনা এসে আমাদের যাত্রাপথের সবকিছু তছনছ করে দেয়, ছিটকে ফেলে আমাদের সে কাঙ্খিত স্বপ্নরাজ্য থেকে নিমিষেই।

এই সেরেংগাটিতেই দেখা মেলে আফ্রিকান বন্যপ্রানী জগতের বিগ ফাইভের (হাতি,সিংহ,বাঘ,মহিষ ও গন্ডার) যা সাফারি প্রেমিকদের কাছে গেম ফাইভ নামে পরিচিত। তাঞ্জানিয়ায় দেখা মেলে হাজার বছর বেঁচে থাকা বাওব্যাপ বৃক্ষের যাকে বলা হয় ‘সিম্বল অব আফ্রিকা “। বাওব্যাপ বৃক্ষের গোড়া এতটাই মোটা যে হাতিও অনেক সময় এর ভিতর ঢুকে যেতে পারে। পৃথিবীর সর্বমোট আট প্রজাতির বাওব্যাপ বৃক্ষের ভিতর সবচেয়ে লম্বা প্রজাতিটির দেখা মেলে তাঞ্জানিয়াসহ আফ্রিকার এ অঞ্চলে।

পাঁচ কোটি আশি লক্ষের জনসংখ্যার বর্তমানের ইউনাইটেড রিপাবলিক অব তাঞ্জানিয়া মূল ভূখন্ড ট্যাঙ্গানিয়াকা ও জাঞ্জিবার দ্বীপকে নিয়ে গঠিত হয় ১৯৬৪ সনের ২৬ এপ্রিল। বর্তমানে প্রশাসনিক রাজধানী ডোডোমাতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। জাঞ্জিবার ইতিহাসের সমৃদ্ধ এক জনপদ।আরব শাসক, ভারতীয় শ্রমিক, পর্তুগীজ ব্যবসায়ী ও কলোনিয়াল ইউরোপিয়ানদের এক মেল্টিং পটের লেগাছি বুকে ধারন করে আছে আজকের এ জাঞ্জিবার।সারা বছর পর্যটকদের পদচারনায় মুখরিত সাথে এ দ্বীপটি।পুরানো স্টোন সিটি ও স্পাইস গার্ডেন এখানকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

আফ্রিকার অনেক দেশের মত তাঞ্জানিয়ানদের মেইন স্টেপল উগালী (মিলেট বা সরগাম পেস্ট), সাথে সুকুমা (এক ধরনের লোকাল স্পিনাস) শাক। এ শাকটি আফ্রিকাতে ব্যাপক ভাবে চাষ হয়। তাঁদের মেইন ভাষা সোহেলী। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কাঠ যা মিউজিক্যাল যন্ত্রপাতি তৈরীতে ব্যবহার করা হয় সে মিপিঙ্গো (Mpingo) গাছটির দেখা মেলে তাঞ্জানিয়াতে। এ কারনে এ গাছটিকে বলা হয় ‘আফ্রিকার সংগীত বৃক্ষ’।

দার এস সালাম বন্দরের কাছেই একটি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরন কারখানায় কাজ করেন বাংলাদেশের কালাম সাহেব। সততার সাথে কাজ করে মালিকের বিশ্বস্ততা অর্জন করেছেন। চাবিসহ পুরো ফ্যাক্টরিটাই তাঁর উপর এক অর্থে ছেড়ে দিয়েছন মালিক। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ ইউরোপে তাঁদের কোম্পানী প্রক্রিয়াজত মাছ রপ্তানী করে। আমাদের উনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফ্যাক্টরিটি দেখালেন। সাথে ছিলেন সাউথ ইন্ডিয়ান ম্যানেজার মিঃ কৃষ্ণান। কথার ফাঁকে ফাঁকে জানালেন ছেলেকে আমেরিকা পাঠিয়েছে উচ্চশিক্ষার জন্য। উচ্চশিক্ষার জন্য শ্রেষ্ঠ আসনটি এখনো পর্যন্ত মনে হয় আমেরিকাই ধরে রেখেছে।

দার এস সালাম থেকে ফিরে এসে আমি দ্বিতীয়বারের মত তাঞ্জানিয়া যাই আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট ক্লিমাঞ্জেরো দর্শনের নিমিত্তে কয়েক দিন পরেই। সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫৮৯৫ মিটার উচ্চতার এ পর্বতশৃঙ্গটি সারা আফ্রিকার ভিতর উচ্চতম। কেনিয়া- তাঞ্জানিয়া বর্ডারের কাছাকাছি আরুশা নামক তাঞ্জানিয়ার একটি শহরে গিয়ে এ টুয়েন্টি থ্রি হাইওয়ে ধরে এগোলে দূর থেকে দেখা মেলে বরফাবৃত ক্লিমাঞ্জেরোর শৃঙ্গের। বর্ডারের কাছে গাড়ি থামিয়ে ওপারে যাওয়ার ফর্মার্লিটি শেষ করে যখন আরুশার দিকে রওহনা দেব তখন খেয়াল করি নিকটেই অনুচ্চ একটি ছোট গাছে অনেকগুলি সুন্দর পাখির বাসা। কি গভীর মমতায় ও আদরে পাখিরা তাঁদের নীড়গুলি তৈরি করেছে। পাখির বাসার এ সৌন্দর্য ধানসিঁড়ি নদীর তীরের কবি জীবনানন্দ দাশের দৃষ্টিকেও এড়িয়ে যেতে পারেনি। তাইতো কবি তাঁর বিখ্যাত ‘বনলতা সেন’ নামক কবিতায় লিখেছিলেন “সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর / তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ / পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন”।

আমি যেদিন আরুশা যাই সেদিন ছিল ভাগ্যক্রমে মেঘহীন রোদেলা এক দিন। হাইওয়ে ধরে ক্লিমাঞ্জেরো এয়ারপোর্টর যত কাছাকাছি আসছি ততই স্পস্ট হচ্ছিল এ গিরিশিখর। সূর্যকিরনে শৃঙ্গের বরফের চাদর রূপালী ঝলকে জ্বলজ্বল করছিল। দুপুরবেলা নদীর পানিতে মৃদু ঠেউয়ের উপর সূর্যালোক প্রতিফলিত হলে যেরকম দৃশ্যের অবতারনা হয় সেদিন ক্লিমাঞ্জেরোকে আমার সেরকমি মনে হচ্ছিল। ক্লিমাঞ্জেরোকে পাশে রেখে এগোচ্ছি এমন সময় দেখা মেলল এক অপূর্ব দৃশ্যপট।অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু মালভূমি টাইপ একটি জায়গা ঘাসে ঘাসে ছেয়ে গেছে। ঝাকে ঝাকে পশুর পাল মাথা নুইয়ে ছিড়ে ছিড়ে ঘাস খাচ্ছে একমনে। গাড়ি এগোচ্ছে আর এরাও সমগতিতে দৃশ্যপটের মত পিছনে চলে যাচ্ছে। এ এক অনাবিল সৌন্দর্যের স্রোতলহরী। ইংরেজ রোমান্টিক কবি কিটস্ এর ভাষায় সত্যিই বলতে হয় ‘এ থিং অব বিউটি ইজ এ জয় ফর এভার’। গাড়ির সিডিতে তখন এ গানটি চলছিল ‘জিমি প্লিজ সে ইউ উইল ওয়েট ফর মি / আই উইল গ্রো আপ সামডে ইউ উইল সি,’।

এবার গৃহে ফেরার পালা। কেনিয়ার দিকে আসছি তাঞ্জানিয়াকে পিছনে ফেলে। এবার দেখছি তাঞ্জানিয়ার গ্রামীন জনপদকে। একটা জায়গায় দেখলাম অসংখ্য কলার বাগান। প্রায় গাছেই কলা ঝুলে আছে।স্মৃতিকে ফ্রেমে বন্দী করার মানসে গাড়ি থামিয়ে কলার কাঁদির সাথে ছবি তুললাম। এরপর শুধু ফাঁকা জায়গা। মাঝে মাঝে দূরে দুএকটা নাম না জানা গাছ দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল কোন এক শূন্যতা যেন অদৃশ্য থেকে বলছে “এখানে কেউ নেই, তবুও এখানে তুমি পাবে এক অপার নিস্তব্ধতা”।

চিরঞ্জীব সরকার । অটোয়া, কানাডা