অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
গৃহবন্দির মাতৃস্নেহ - গুলজাহান রুমী

রোনার সন্ত্রাসে মনটা অশান্ত হয়ে আছে! মনে  হচ্ছে কোথাও আলো নাই, কোথাও শান্তি নাই! চারিদিকে ভয়াল এক দানবের হুঙ্কার ! ভয়াবহ দুর্দিন জগত সংসারে। প্রতিটি মানুষকে ছুঁয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য এই ভয়ানক অনুজীব! মহামারী হিসেবে ধারন করছে দিনে দিনে! এই দাহকাল এই বেদনার দহন কবে শেষ হবে কেউ জানেনা। সবাই বলছে মৃত্যু অভধারিত নয়, কিন্তু মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে ঘুরে আসতে হবে। এমন মৃত্যু কেউ চায়না যে মৃত্যু স্বজনকেও কাছে টানতে পারেনা। কেউ তাকে শেষ বিদায় জানাতে পারবেনা, কেউ কাঁদতে পারবেনা প্রাণ উজাড় করে আপনজন বিয়োগে। মৃতের সৎকার  করতে পারবেনা যার যার সংস্কার মত। মৃতকে শেষ বিদায় জানাতে আত্মীয়-পরিজন কেউ আসবেনা!

প্রবীনদের কাছে গল্প শুনেছি, একটা লাশ কবরে, নামাতে না নামাতেই আরেকটা ‘গোর’ খোদাই করার খবর এসে যেতো! ওলাউঠা, শিতলা কত কত মহামারী আমাদের পূর্বপুরুষের শান্তি ও প্রাণের তরাস ছিল। অবাক হয়ে সেসব আতঙ্কের গল্প শুনতাম। এবাড়ির কান্না থামতে না থামতেই ওবাড়িতে মরাকান্নার আহাজারি। দাদি নানিদের কাছ থেকে সেইসব ভয়াল আতঙ্কের কাহিনী শুনে রুপকথার গল্পের মত মনে হত। সত্যিকারের আতঙ্ক কী যে ত্রাস এটা উপলব্ধি হতোনা তেমন। আমাদের জীবনবৃত্তে এরকম মহামারী, এরকম হাহাকার দেখিনি আমরা কোনোদিন।

আমাদের শহরে করোনার আতঙ্ক বেশ দেরী করেই আসে। চায়নাতে যখন এই প্রাণঘাতী করোনা ছড়িয়ে যাচ্ছে তখনও তেমন করে গায় মাখিনি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতই ভেবেছিলাম এটা চায়নিজ বিমার। সাপ ব্যাঙ কুত্তা ইঁদুরবাদুরখেকো চায়নিজদেরই এটা হবে। এরই মধ্যে চিন দেশে ডাক্তারী পড়তে যাওয়া আমার এক ভাজতি আন্নি ইন্দোনেশিয়া মালোয়েশিয়া ইত্যাকার বহু দেশ পাড়ি দিয়ে দেশে আসার সংবাদ পেলাম। পত্রপত্রিকায় ওর সাক্ষাৎকার পড়লাম। গা শিউরে উঠলো। একরত্তি এক মেয়ে একা কয়েক ঘন্টার পথ তিন দিনে ট্রানজিট পার হয়ে হয়ে মা-বাবার কোলে এসেছে। ওর বাবার তাড়নায় সে সাহস করে ভুবন পাড়ি দিয়ে এসেছে। বিদ্যাসাগরের কথা মনে পড়লো। মায়ের চিঠি পেয়ে ঈশ্চরচন্দ্র ভর বর্ষার ঢেউভাংগা  দামোদর পাড়ি দিয়েছিলেন। আন্নির বাবা সারাদিন হুঙ্কারের উপর থাকেন। আমার এই দেবরজির সাহস আর বীরগাথার গল্প তল্লাটের সকলে জানে। উনার ইলেকশনের প্রতীক বাঘ। তীর বেগে গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন। লোকে বলে সরে দাঁড়াও, বাঘ আসছেন। সেই সাহসী দেবর আমার ছেলেমেয়েদের জন্য বাৎসল্যে মমের মত নরম। চায়নাতে এই প্রাণঘাতী করোনা মহামারী হবার আগেই মেয়েকে সেখানে তিষ্টোতে দেননি। আমরা খবর পেলাম মেয়ে আসার অপেক্ষায় তিনি দুইদিন দুইরাত ঢাকা বিমান বন্দরে পড়ে আছেন। আন্নি সম্ভবত প্রথম ছাত্রী যে চায়না থেকে করোনা মহামারী হবার প্রাক্কালে স্কুল-কলেজ লক-ডাউন হবার সাথে সাথেই চলে আসতে সক্ষম হয়। এজন্য সাংবাদিকরা চায়নাফেরৎ আন্নির গল্প ছাপতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তখনও কোয়ারেন্টাইন শব্দটি অভিধানে পড়ে ছিলো। এখন এই শব্দটি তসবির দানার মত জপতে শোনা যায়। দেখতে দেখতে একটা দৈববাণীর নির্দেশে যেন আমরা সকলেই শেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে চলে এসেছি। 

আমাদের শহর অটোয়া কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে হলেও  চিরাচরিত প্রাণছন্দেই চলছিলো। কোথাও জীবনের কোলাহল থামেনি। দীর্ঘ তুষার তান্ডবে ভাটা পড়ছে, দিনের পরিধি দীর্ঘ হতে শুরু করেছে। কান পেতে বসন্তের উষ্ণ বাতাসের স্বনন শোনার প্রতীক্ষায় আমরা উদগ্র হয়ে আছি। এত দীর্ঘ শীত পাড়ি দিতে আর প্রাণে সয়না। কানাডার মূল জনগোষ্ঠীও শীত ঋতুটাকে ভালবাসেনা। হাঁপিয়ে উঠে সবাই।আর আমরা যারা বাঙালি আমাদের দেশের বিনম্র সুখের শীত ঋতুটির স্মৃতি আমাদেরকে পীড়িত করে। ছোটবেলায় মায়ের উষ্ণ শরীরে শরীর মাখিয়ে উত্তাপ নিতে নিতে লেপের তলায় ঘুমিয়ে থাকার মত মনে হয় আমার জন্মভূমির শীতকালটাকে । ছেলেমেয়ে যখন স্কুল-কলেজে থাকে, হাজবেন্ড যখন ব্যবসাস্থলে তখন একাকী সময়ে স্মৃতির হাট বসে যায় আমার ভাবনায়। ইচ্ছে করে সেই ছোট বয়েসের মেয়েবেলায় ফিরে যাই। ফিকে মিঠে রোদের শীত আসুক সংসারে। আমার মায়ের শরীরে লেপ্টে চাতালে মোড়ায় বসে বিকেল বেলার রোদ পোহাই। আব্বার অফিস থেকে ঘরে ফেরার পথের দিকে চেয়ে থাকি, রোদে গরম দেওয়া লেপ মেলে আপাদের মধ্যখানে ঘুমিয়ে পড়ি। এসব কত কত সুখস্মৃতি আমাকে আবিষ্ট করে রাখে। অবাস্তব যত ইচ্ছে যেন সত্যি সত্যি যাপন করি আমি। যাপন করে সুখ পাই। কানাডার শীত ঋতুর তুষার তান্ডব যখন প্রাণে সয়না তখন সুখস্মৃতিতেই বাঁচতে হয়। এখানে দরোজা-জানালা একটুখানি সময় খোলা রাখার উপায় নাই। আগের দিনে সাবল মেরে ড্রাইভওয়ে সাফসুতরো করে ঘুমালাম, সকালে পর্দা সরিয়ে দেখি কোমর সমান বরফ ডুবিয়ে দিয়েছে সব। আবার সাবল মেরে বরফ সরিয়ে গাড়ী বের করো। গায়ে চড়াও দেড়মন ওজনের শীতবস্ত্র। বাচ্চাদের স্কুলে-ভার্সিটিতে পৌঁছে দাও, আবার নিয়ে আসো। রান্না চড়াও। ঘরদোর সাফসুতরো করো। খোলা আকাশের তলায় যাবার জন্যে মন হাপিত্যেশ করলেও বেশীক্ষণ বাইরে থাকার উপায় নাই। মার্চ মাসে হাড় কাঁপুনে শীত ও বরফের মাত্রা অনেকটাই কমে আসে। আমরা বাতাসে বসন্তের  আগমনী বার্তা পেয়ে কিছুটা ফুরফুরে হতে থাকি। কানাডায় স্প্রিং নামের অপূর্ব ঋতুটি উপভোগের আনন্দে আমদের বিধ্বস্ত শরীর-মন জীবনকে ভালবাসতে আকুল হয়ে উঠে। সকল মানুষের মধ্যেই একটা চাঞ্চল্য ফুটে উঠে এই সময়টাতে। দেখতে দেখতে বরফগুলো গলে যাবে। রুদ্রালোকে মাটি একটু উত্তাপ পেয়েই তার মাতৃগর্ভ থেকে জাগিয়ে তুলবে টিউলিপ, জাফরান প্রভৃতি। ফুলে ফুলে প্রজাপতির মেলা বসে যাবে চারদিকে। চেরী আর ক্রাব-আপেলের উজাড় করা প্রস্ফুটন চোখ ধাধিয়ে দেয়, বিনম্র পাপড়িগুলো একটুখানি দমকা বাতাসে বৃন্ত থেকে খসে আমাদের চোখেমুখে আদর দিয়ে আবার বায়ুরথে চড়ে উড়ে যাবে নিরুদ্দেশে। ঝরা পাপড়ির খেলা দেখতে দেখতে আমাদেরও উড়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করবে। বাধাবন্ধহীন অবুঝ বালিকার মত আমাদেরও ইচ্ছে করবে শান্তস্নিগ্ধ জলাশয়, বনভূমি পেরিয়ে মেঘবালিকার মত আকাশে উড়ে যেতে।ঝাকে ঝাঁকে পাখিরা চলে আসবে, নিজেদের ভাষায় কাকলি করবে। প্রকৃতি আমাদেরকে পেখম মেলে উৎফুল্ল করবে আবার, আমরা তখন দীর্ঘ শীতের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলবো মন থেকে, শরীর থেকে। কয়েকদিন থেকে দেখছি একজোড়া আমেরিকান রবিন আমার বাড়িতে গোয়েন্দাগিরি করছে, একজোড়া নর্দান কার্ডিনালও নিয়মিত আসছে। এরা খুব হিংসুটে পাখি, নিজের এলাকায় অন্য কাউকে সহ্য করেনা। রণচন্ডি হয়ে লড়াই বাধিয়ে দেয়। আমার ফ্রন্ট ইয়ার্ডে জানালার লাগোয়া একটা ঝাঊ গাছ আছে যেটা এই পাখিদের খুব পছন্দের। মাত্র ছয়ফুট উচ্চতার এই ঝোপালো গাছটি যা আমাদের নিয়মিত ঘরে আসা যাওয়ার পথের পাশে। এই গাছটি আপন ইচ্ছেমত মহীরুহ হতে পারেনা। ফিবছর আমার উনি এটাকে বেধড়ক কেটেছেটে একই উচ্চতায় রেখে দেন।সারা শীতকাল নিজের গায়ে সবুজ পাতারাশির পোশাক নিয়ে আমাদেরকে সবুজের স্বপ্ন দেখায়। এদেশে এই জাতীয় গাছগুলো ছাড়া সকল গাছ আর অবারিত বনানী পত্রহীন, যেন হাড়পাজর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খা-খা উদোম। আমার বাড়িতে দুটিমাত্র চিরসবুজ গাছ আছে। নানা জাতের কাশফুলের ঝাড় আছে, জেব্রিনাস গ্রাছ আছে,রেড ব্যরন, টেরাকোটা ফিদার রিড নামের ঘাস জাতীয় তিরিশ রকমের গ্রাছলাইক প্লান্ট ছাড়াও বহুবর্ষজীবি প্যারেনিয়েল গাছের দঙ্গল আমার হাজবেন্ড গত দশবারো বছর ধরে অপার স্নেহে লালন করছেন। নিজের শরীরের যত্ন নানিলেও এদের যত্নআত্তিতে কোনো বিরাম নাই। গাছগাছালি নিয়ে উনার নিজের কিছু দর্শনচিন্তা রয়েছে সেগুলো আমার বোঝার দরকার নাই, তবে দেখতে ভালই লাগে কত দরদ ও একাগ্রতার পন্ডশ্রম। অবশ্য আমি আমার বাড়ির ফ্রন্ট আজ্ঞিনা ও পেছনের উঠোনের বাগান খুব উপভোগ করি। বাগানের রেনডম কালার আমার একাকী সময়টাকে সঙ্গ দেয়। ছেলেমেয়ে যখন ছোট ছিল, ওরাও বাবার সাথে সারা দিনমান ব্যাকইয়ার্ডে পড়ে থাকতো। ছেলে পোকামাকড় ধরতে বাগান অগুছালো করে দিতো। এনিয়ে বাবার সাথে ঝগড়া। মেয়েটা ওর বাবা যা যা করতেন ঠিক সেটাই সে করতে চাইতো, কিন্তু পারতোনা। এনিয়েও বাবা-মেয়ের ঝগড়াটা আমি খুব উপভোগ করতাম। ওরা বড় হয়ে যাবার পর জীবিনের এই ছন্দ আর কিচিরমিচির এখন আর নাই। তবে জানলার পাশের ঝাউ গাছটা ঘিরে রবিন দম্পতি ও লাল ঝুটিওয়ালা রেড কার্ডিনালদের দখলদারিত্বের লড়াই প্রতি বছর বসন্তের আগমনী সময়টাতে আমি দেখতে পাই। গত বছর রবিন দম্পতি জিতে গিয়েছিল। আগের বছর কার্ডিলাল যুদ্ধে জিতে তিনটি ডিমে তা দিতে দিতে বাচ্চা ফুটানোর আগেই একদিন গাংচিল এসে এদের সংসার তছনছ করে ভেঙ্গে দেয়, ডিমগুলো একলহমায় খেয়ে যায়। আমরা কেউ দেখতে পাইনি। ছেলেমেয়ে, ওদের বাবা মিলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি বসে যায়। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট চলে আসে কিছুক্ষ্ণের মধ্যেই। জানা যায়, পাশের বাড়ির কেটলেডির ষন্ডা কিসিমের পাড়া-বেড়ানো কালো বিড়াল নয়, হিংসুটে রবিন দম্পতিও নয়, রাক্ষুসে গাংচিল এমন হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। জেরা করে জানলাম, কার্ডিলনালের বিধ্বস্ত নীড়ে গাংচিলের কয়েকটা পালক পাওয়া গেছে সেটাই প্রমাণ। দুই বছর আগে আরেকটা দুঃখের ঘটনা ঘটে। অতিমাত্রায় বৃষ্টির কারণে রবিন দম্পতির পাঁচটি ফুটফুটে বেবি নীড়শুদ্ধ খসে পড়ে গাছ থেকে। রবিনের নীড় রচনার পদ্ধতি একটু ভিন্ন। খড়কুটোতে নরম কাদামাটি দিয়ে লেপেপুছে আমাদের দেশের গ্রাম্যবধুর মত পরিপাটি ঘর বানায় তারা। ফলে বেশ ভারী এদের বাসাটি। অতিবৃষ্টির কারণে ভঙ্কুর বৃক্ষশাখাটি থেকে বাসাটি আবুধি ছানাসমেত খসে পড়ে সহসা। সবক’টা বাচ্ছা পানিতে ডুবে সলিল সমাধি হয়ে যায়। কোমর সমান পানিতে নেমে রবিনরা তাদের ছানাগুলোর প্রাণ বাঁচাতে পারেনি। দুইদিন তারা এলাকাটিকে শোকের মাতমে করুণ করে রাখে। দেখে আমার মনটি বিষাদে আচ্ছন্ন থাকে। ডিম ফুটে বের হওয়া ছানাদের নিয়ে পাখিদের ব্যস্ততার কোনো ঘাটতি নাই। মানুষের মা-বাবার থেকে কোনোভাবেই কম নয় পশুপাখির সন্তান প্রেম। আপন সন্তানদের নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার থেকে কম কিছু দেখিনি এই পাখি দম্পতির মধ্যে। এদের ঘরকন্যার সংগ্রাম আমাকে অবিভূত করে। প্রতি বছর স্প্রিং আসলেই আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে এদের ঘরকন্যা দেখতে আমি মনোযোগী হই।   

কিন্তু এই বছর বিধি বাম হয়ে গেলেন যেন সহসা। সপ্তাহ দুই আগে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী লন্ডনে একটি সেমিনারে যোগ দিতে  গিয়ে নিজ শরীরে বহন করে নিয়ে আসেন করোনা নামের প্রাণঘাতী ভাইরাস। খবরটি আমাদের শহরটিকে অজানা এক বিষাদে মুড়িয়ে দেয়। কী এক গোপন ত্রাসে যেন তাড়িত হতে থাকে ব্যস্ততম নগরী অটোয়া। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ লক-ডাউন হবার ঘোষণা চলে আসে। দিন কয়েক আগে আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে এমনিতেই একটা দমকা ঝড় বয়ে গেছে। ঘটনাটা আমরা নিকট আত্মীয় সকলকেই সহসা বিধ্বস্ত করে রেখেছে। কিছুকিছু বিয়োগব্যথা নেয়া যায়না। লন্ডনে আমার মেঝো ননসের একমাত্র ছেলে রনির আচম্বিৎ মৃত্যু। মাত্র পয়ত্রিশ বছর বয়েসের এই ছেলেটা আমাদের সকলেরই খুব প্রিয় ছিলো। স্বাস্থ্যবান আর সুঠাম এই ছেলেটা দেখতে ছিলো রাজপুত্রের মত। শান্ত স্বভাবের অপূর্ব কান্তি ছিল তার চেহারায়। চার বছরের একটি ছেলে আছে তার আর তরুনী স্ত্রী আশু সন্তান সম্ভবা। রনি জানতো খুব শীঘ্রই কন্যা সন্তানের পিতা হচ্ছে সে। তড়িঘড়ি সে নতুন বিএম ডাব্লিউ কিনে এনে বাডির গ্যারেজে রেখে দেয়।গাড়ীটা চালায়না। আপাকে বলে, মা এই গাড়ীটি দিয়ে তোমার নাতনিকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসব। নিজের কন্যাটিকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হয়নি রনির। কন্যাটি জন্ম নেয় তার চলে যাবার চার দিন পর। মেঝ আপা আমার খুব প্রিয় মানুষ। পুত্রহারা আপা পাগলপারা বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে সদ্যজাত নাতনিকে দেখতে গিয়েছেন হাসপাতালে। নাতনীর কচি গালে নিজের গাল ঠেকিয়ে বোবাকান্নায় আকুল আপার ছবি ফেসবুকে দেখে দ্বিতীয়বার ছবিটার দিকে আমি তাকাতে পারিনি। আপা খুব হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন।  আপা এখন মধ্যরাতে দরোজা খুলে বাড়ির উঠোনে বেরিয়ে যান ছেলেকে খোঁজতে। আমরা আপার সাথে ফোনে কথা বলতে পারিনা। পুত্রহারা একজন মাকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা জগত সংসারে নাই। এই আচম্বিত শোকের আচ্ছন্নতা আমরা সকলকেই মরমে মেরে রেখেছে। অন্যদিকে একটার পর একটা বিপদের বার্তা চার দিকে। আমার ছোট আপার বড় ছেলের পক্ষের এক বছরের নাতিটা্র রক্তের শ্বেতকনিকা হঠাৎ করে কমে গেছে দেখে ওর বাবা সিএমএইচ-এ ইন্টেনসিভ কেয়ারে ভর্তি করে। ছোট আপা উনার ছোট ছেলেটাকে বাসায় একা ফেলে দিনের পর দিন ক্যান্টনমেন্টে পড়ে আছেন। আমার ছোট আপা এমনিতেই খুব নরম মনের মানুষ। প্রতি দিনই উনার সাথে আলাপ করি, ধৈর্য ধরতে বলি। বড় আপা গুলশানে প্রায় একা একটি এপার্ট্মেন্টে থাকেন। ভাগ্যিস উনার ছোট মেয়েটির বাসাও একই ফ্লোরে, সামনা সামনি দরোজা। ছয় বছরের নাতিটা আপাকে এখন দিনমান সঙ্গ দেয়। বড় আপার নিঃসঙ্গ জীবনের নিত্যসঙ্গী এখন এরন। তাকে আমি দুলাভাই ডাকি। সে শুধু আপাকে নয় কেবল, যখনতখন ফোন করে আমাকেও সঙ্গ দেয়। এই বয়েসে এত বাহারি কথা সে বলতে পারে। আপা আমাকে রুমী ডাকেন এজন্যে সেও আমাকে নাম ধরে ডাকে। আমাদেরকে দেখেছে সে দুইবার মাত্র। সবাইকে মনে রেখেছে। যখনতখন বায়না ধরবে অরনিকে দাও, অদিবকে দাও কথা বলি। আমি মনেমনে ভাবি, সে যদি নাথাকতো তাহলে আমার বড় আপার এই ভয়াল একাকীত্ব কীকরে কাটতো। আপার চারটি মেয়েই খুব ভাল আছে, কানায় কানায় পূর্ণ তারা। কিন্তু আমার আপার কী যেন নাই, কী যেন এক শূণ্যতার হাহাকার। সারা জীবন আপার সংসারটা ছিলো আনন্দে পরিপূর্ণ। দুলাভাই মারা যাবার পর আপা মনের দিক দিয়ে ভেঙ্গে পড়েছেন। মেয়েরা আর জামাইগুলো  এত টেইককেয়ার করে কিন্তু আপার শূণ্যতাকে কেউ ভরে দিতে পারেনা। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি আমার আরেকটি ছেলে থাকতো তাহলে বড় আপাকে একটি ছেলে লাদাবি রেজিস্টারি করে দিয়ে দিতাম। আমার বড় আপার আজব সব কান্ড আমরা খুব ইনজয় করি। আমার হাজবেন্ড গুলশানের ব্রাক নার্সারী থেকে কিছু রেয়ার গাছের চারা কিনেন গ্রামের বাড়িতে লাগাবেন বলে। থাইল্যান্ডের থেকে আসা একটি পাতাবাহারের গাছ এক হাজার টাকা রেখেছে বলে আপা এদেরকে ফোন করে ধমকাতে থাকেন, আমার ভাইয়ের কাছ থেকে তোমরা এত দাম রেখেছো কেনো। ওরা কাচুমাচু করে বলে, মেডাম, উনি পরিচয় বলেননি আমাদেরকে। বেচারা লোক মারফত অর্ধেক টাকা ফেরত পাঠায় বাসায়। আপা যেখানেই যান জামাইদের পরিচয় দেবেনই দেবেন। এত আদর কদরেও আপার শূণ্যতা যায়না। ফোন দিলেই কান্নাকাটি করেন। এরনের কথা জিজ্ঞেস করলে বলবেন, আর বলিসনা, ওর পাকামো কথার জবাব দিতে দিতে আমার জান পানি হয়ে যাচ্ছে। আবার এদিকে ওকে ছাড়া এক দিনও আপা থাকতে পারেননা। অন্য মেয়েদের বাসায় গিয়েও থাকেননা এরনের চিন্তায়। এরনের মা-বাবা দুজনই অফিসে থাকে বলে স্কুলের সময়টা ছাড়া বাকী সময়টা সে আপার সাথেই থাকে। এরন মন চাইলেই আমাকে মেসেঞ্জারে ধরিয়ে দিয়ে যখন তখন বলে, এই নাও রুমীর সাথে কথা বলো। এত ছোট একটা মানুষ সে কিন্তু আপার মনের শূন্যতা বুঝতে পারে। নিজে যেচেই আপাকে জিজ্ঞেস করে, কার সাথে আলাপ করবে তুমি?  মায়ার সাথে?  নিরুর সাথে? রানীর সাথে? মুরাদের সাথে?  রুমীর সাথে? আমরা ভাই-বোনদের সবারই নাম জানে সে। সেদিন ফোন ধরেই বললো, শুনেছো, মায়ার মন ভালো নাই। আমার মেঝো আপা তিনি। বললাম, কেন ভাইয়া? সুজন আর ওর বৌ অফিসে যায়। ওদের বেবি অসুখ। বুঝতে পারলাম সে মেঝো আপার খবরটাও খুটিয়ে খুটিয়ে জানে। আরও বললো,তান্নার সময় নাই, মেডিকেলের টিচারতো, সময় নাই, ডিস্পেন্সারীতেও বসার সময় নাই, বেবিটারেও বাইরে নিয়ে যেতে পারেনা, বেবিরা মায়ারে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমরাও এখন বাইরে যাইনা। জানোনা করোনা এখন। আমি বলি, আমরাও এখন বাসায় থাকি ভাইয়া, আমাদেরও বিপদ। সে বলে আমি সব জানি, আমার নানু তুমি আর রানীর জন্য চিন্তা করে। আমি বললাম, তোমার নানুকে চিন্তা করতে দিয়োনা, কেমন? এই ছোট্ট এরন আমারও ফ্রি ইন্টারনেট। তার কাছ থেকে সকলের প্রাথমিক খবর আমি পেয়ে যাই। করোনার প্রকোপ বাংলাদেশে খুব মারাত্বক হতে পারে এনিয়ে অনেক ভয়ঙ্কর কথা শুনতে পাচ্ছি। টেলিভিশনে দেখতে পাই লোকজন উৎসব করে বেড়াচ্ছে। এদিকে আমাদের শহরে দুইশো করোনা আক্রান্ত রুগীর সংবাদে আমরা আতঙ্কে কাপছি। টরোন্টো, মন্ট্রিয়েল সহ অন্যান্য শহরগুলোতে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। টরন্টো সহ প্রায় সবখানেই বাঙালিদের আক্রান্তের খবরে আর পার্শ্ববর্তী নিউইয়র্ক নগরীর বাঙ্গালি সহ অনেক মানুষের মৃত্যুর সংবাদে চরম উৎকণ্ঠায় আমাদের দিন কাটছে। কানাডার ভ্যাঙ্কুবার নগরী এই কয়েকদিন আগেও সবচে বেশী আক্রান্ত এলাকা ছিল। আমার বোনজি তানির দুটি ছেলেই সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে বেশীদিন হয়নি। ঢাকা থেকে ওদের মা তানি আমাকে প্রতিদিনই ফোন করে উৎকণ্ঠার কথা বলে। আরেক বোনজি রিয়ার দুটো ছেলেই মালোএশিয়াতে পড়তে গিয়েছিলো।তারা আটকা পড়ে যায় সহসা।রিয়া কাঁদতে কাঁদতে ফোনে বলে,খালামনি, আমার ছেলেদের কি হবে! দিন কয়েক আগে ওর ছেলেরা কত ঘাটের জল খেয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছেছে।চারদিকে কেউ শান্তিতে নাই। চোখে দেখা যায়না এমন এক অদৃশ্য ঘাতক সন্ত্রস্ত করে দিয়েছে সারা পৃথিবী।আমরা যে কত অসহায় এটা সবাই বুঝে গেছি।কোনো দেশের সরকারই মহামারী ঠেকিয়ে দেবার মত শক্তি অর্জনে কোনো ব্যবস্থা যে করেনি এতদিন সেকথা পৃথীবির মানুষ আজ দেখছে।শুনেছি সারা পৃথিবীকে একাধিকবার  রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করে দেবার ক্ষমতা আমেরিকার রয়েছে, কিন্তু মহামারী হলে নাগরিককে চিকিৎসা দেবার মুরোদ নাই। নিউইয়র্কের লেজে গোবরে অবস্থা দেখলে আমেরিকাকে মনে হবে গরিবেরও গরিব। আর আমাদের কানাডায় শীতের মৌসুমে অগনিত মানুষ নানা দেশে চলে যায়। করোনার বিস্তারে সবাই ঝাঁকেঝাঁকে দল বেধে ফিরছে। সারাদেশ ছেয়ে যাচ্ছে বিদেশফেরতদের বহন করে নিয়ে আসা অদৃশ্য দানবটি। এসব চিন্তা করলে মাথার ভেতর ভনভন করে। টেলিভিশন বন্ধ করে দেই সহসা। না, আর কোনো খবরই নেবোনা। কিছু জানতে চাইনা। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি এই আকাশ, গাছবিরিক্ষি যার যার মত আনন্দিত আছে, চেরীর শাখায় কলিগুলো ডাগর হয়ে গেছে। এই প্রকৃতি কি ওর আনন্দের ভাগ আর আমাদের দিতে চায়না? প্রকৃতি আমাদের হিংস্রতার প্রতিশোধ নিতে যেন উদ্যত আজ। আমার ঘরের ভেতর তাকিয়ে দেখি হাউস প্ল্যান্টগুলো যেন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। এদের যত্ন নেইনি কতদিন। মাথার ভেতর থেকে এই নিদান কালে চরম উৎকণ্ঠা কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুছে দিতে গাছগুলো যত্ন নিতে ইচ্ছে করে। চেয়ে দেখি, লাল কাপ ও পিরিসের উপর বসে আছেন আমার প্রিয় মিন্টের লতানো গাছটি! উনাকে আলতো করে কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিলাম। চেয়ে দেখলাম উনার সৌন্দর্যের জৌলুস উপছে পড়েছে। এক ডলার দিয়ে উনাকে গত সামারে কিনে এনেছিলাম। তারপর উনাকে বহু যত্নতালাবি করে বাঁচিয়ে রেখেছি! দিন দুইএক মাস আগে লতাটিকে প্রায় মরি মরি অবস্থা থেকে কোনো রকমে বাঁচিযে রেখেছি। যখন গোসল করিয়েছি তখন উনার গায়ের থেকে অনেক ছোট ছোট সাদা সাদা মিহি দানার মত কি যেন ঝড়ে পড়তে থাকলো! মনে হলো এক ধরনের পোকা। আমার ঘরে ভিন্ন ধরনের অনেকগুলো অর্কিড আছে। ওদেরকেও গোসল করালাম, পাতাগুলো মুছে পরিষ্কার করলাম। মিনটের লতায় পোকাগুলো সাদা সাদা পোকারা যেন উডছে এখনও। দেখে ভয় পেযে গেলাম। পোকামাকডে ভীষণ এলার্জি আমার। অনেক ভয়ও পাই। একে তো করোনা ভয়, আবার মিনটে্র লতায় পোকা, হায়রে আমি যে কোথায় পালাই। মনে সাহস নিযে চোখ বন্ধ করে ওটাকে বাইরে নিয়ে গেলাম। অনেকপানি ঢেলে পাচঁ ছয়বার গোসল করালাম এবং মনে মনে ভাবলাম না আর ঘরে নিবো না। বেশ ঠান্ডা এখনও আছ। ব্যাকইয়ার্ডে বরফ গলেনি পুরোটা। মিন্টের গাছটাকে রেখে এসে সাইডিং ডোরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। ওদের শীত লেগেছে মনে হলো, ঠকঠক করে কাঁপছে যেন যেভাবে ছোট্ট শিশুকে গোসল দেবার পরে ঠোঁটে কম্পন তুলে ঠিক তেমনি। মনে আমার মাতৃস্নেহ জেগে উঠলো। ঘরে নিয়ে আসলাম। চেয়ে দেখলাম আমেরিকান রবিন দম্পতি আপন মনে খড়খুটো টানছে নীড় বাঁধবে বলে। তাদের কোনো করোনার ভয় নেই। আমার রান্না ঘরের আইল্যান্ড টেবিলটা আমার খুব পছন্দের একটা বসার জায়গা। অনেক আলো আসে সারাদিন। শীত কালে সূর্যের আলোছায়ায় এখানে অনেকক্ষণ চা নিয়ে আয়েসে বসে থাকি ফুরসত পেলে। সকালবেলা উপছে পড়ে আলো এখানে। আগষ্টের শেষের দিকে এখানে বসেই আমার বাগানে কাশের মাতাল নাচানাচি দেখি। দূর আকাশে মেঘের ভেলা, পাখির কিচিরমিচির কলকাকলি, কি না দেখা যায় এখান থেকে! সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন এক কাপ চা নিয়ে বসি তখন এই মনোরম দৃশ্য আমাকে নানান ধরনের ভাবনায় ভাবিয়ে তুলে! আর রাতের বেলা যখন আকাশে থাকে একাকী চাঁদ, তুষারপাতে গাছের পাতাগুলো যখন চিকচিক করে তখন মনে হয় যেন নিয়ন টিউব লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে সারা অঙ্গনে কেউ! দুটো তারা ফুটে থাকে অকাশের অন্য পাশে। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলেমনে হয় যেন আমাকে দেখছে তারাগুলো। এরা যেন কতকালের আপন আমার। কেন যেন মা-বাবার কথা মনে পড়ে যায়! কত যুগ হয় আমার আব্বা ও আম্মা কে দেখেছি না! চিরতরে চলে গেলে আর কেউ ফেরেনা। এত দূর চলে গেছেন কখনো ধরতে, ছুঁতে পারবো না। কিন্তু এই দুটো তারা দেখলে মনে হয় উনারা যেন আমাকে দেখছেন, মনে হয় আমার আব্বা - আম্মা যেন আমাকে ডেকে বলছেন,কেমন আছিস রে মা!

গুলজাহান রুমী । অটোয়া, কানাডা