অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
বৈশেখী মেলা - সিরাজুল ইসলাম

বাঙালীর ঐতিহ্যে বৈশাখ মাস সবচে গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু পূরানের তথ্যানুযায়ী দেবী বিশাখার নামের প্রভাবে এই বৈশাখ মাস। সত্যমিথ্যা জানি না।
হিম কুহেলীকায় ঝরে যাওয়া গাছের পাতা;  উদাসী মানুষের মনে যখন একরাশ ক্লান্তি এসে ছুঁয়ে যায়,তখন বসন্তরাজ ধীরে ধীরে ন্যাড়াবোঁচা গাছে নতুন পাতা গজিয়ে, ফসলের মাঠে শস্যদানায় পরিপুর্ন করে মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়!
পুরনো দুঃখ ভুলে নবজীবনের জয়গানে প্রকৃতিও মেতে ওঠে আটপৌরে জন-জীবনে। ব্যবসায়ী, দোকানী হিসেবের নতুন খাতা খোলে। যার নাম খেরোখাতা। লাল শালুতে মোড়া, শক্তির প্রতিক যেন!
পাড়ায় পাড়ায় ধুম পড়ে যায় উৎসব আমেজে। বয়সী কোন বটের নীচে, নদীর পাড়ে জমে ওঠে মেলা। লোকজ মেলা।
বহুদূর-দূরান্ত থেকে কতশত মানুষ আসে এই মেলা দেখতে,  কেনাকাটা করতে। দোকানীরা থরেবিথরে সাজিয়ে রাখে মনকাড়া মনোহারী পণ্য। শিশুদের উপযোগী পাতার বাঁশী, শোলার পাখি, টিনের সেপাই,  ঢাল-তলোয়ার, তালপাতার পাখা  রান্নার চুলো, কাঠের ঢেঁকি! খেলনা, হাড়ি-পাতিল। ছাঁচেগড়া মাটির পুতুল, লাল নীল নানারঙের বেলুন! আহা! কী যে এক ভালোলাগা মূহুর্ত! বলে বোঝানো যাবে না।
ছোট্ট নাতীর হাত ধরে, ফোঁকলা দাদুর নাড়ু খাওয়া মুখের কষ্ বেরুনো হাসি। আঙ্গুলে গজা, গুড় কদমা, হুড়ুম ভাঁজা, সস্তার জিলাপী জামার কোঁচড়ে ভরে বেলুন-বাঁশী ট্যাঁ ফোঁ শব্দে বাজিয়ে ঘরে ফেরা। কে তা ভুলতে পারে? ভাবলে এখনও চোখের কোণে জল এসে যায় অজানা সুখের পরশে। ভালোলাগার শিহরণে ভরে ওঠে মন!
শহরের যান্ত্রিকতায় আজ আমরা ভুলে যেতে বসেছি সংস্কৃতির ধারক-বাহক ঐতিহ্যমন্ডিত সেইসব লোকজ খেলা। দাঁড়িয়াবান্ধা, হা ডু ডু, বউ চু, ডাংগুলি, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ যুদ্ধ, অথবা নৌকাবাইচের মত সর্বজননীন সর্বজন প্রিয় উৎসব। ডিজিটাল ব্যানারে এ প্রজন্ম আজ আকাশ সংস্কৃতিতে বিভোর।
তারপরও অতি বিচ্ছিন্নভাবে উদযাপন হয় বৈশাখী মেলা; লোকজ উৎসব। শিমুল-পলাশের হাসি যখন নিস্প্রভ হয়ে যায়, ঠিক তখনই কৃষ্ণচুঁড়ার কলি ফুটতে শুরু করে। মহুয়ার বনে মৌ জমে। উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে মন! ঢ্যাঁম কুঁড় কুঁড় বাদ্যি বাজিয়ে অতি যান্ত্রিক সভ্যতায় সেই গ্রামীন স্বাদ সজীবতায় শিশুর সারল্যতায়  আজও আমরা অনুভব করি বৈশাখী উন্মাদনা।
রাত জেগে বসে দেখা গাজনের নাচ। পলান তপন পল্টুরা রং মেখে সং সেজে মাদল বাজিয়ে নেচে যায় অবিচল। উলুধ্বনীতে মুখরিত গোটা গ্রাম।
লাল সিঁদুরে নববধূঁ শঙ্খধ্বনী শেষে মাখন-সাদা লালপেড়ে শাড়ীতে শাঁখাপরা সুডৌল হাতে বিলোয় পুজোর প্রসাদ। অফুরন্ত প্রতিক্ষায় হৃদয়কোটরে খুব সংগোপনে তুলে রাখা ছবি। রংচটা টিনের তোরঙ্গে ভাঁজ করে রাখা ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা মায়ের পুরোনো শাড়ীর মতই বিবর্ণ স্মৃতির ঝাঁপি!
এই মেলার শুরু কবে থেকে তা কারো জানা নেই। গোটা মেলা প্রাঙ্গন জুড়ে জমজমাট হয়ে ওঠে শিশু কিশোর যুবা / আবালবৃদ্ধবনিতার পদভারে।
ব্যস্ত জীবনের কর্মক্লান্ত দেহে মন না চাইলেও ছোট্ট শিশুর বায়না মেটাতে তাদের বাবা-মা পাখিরং বিকেলের মরারোদ গায়ে মেখে ঘুরে বেড়ায় মেলা প্রাঙ্গন। মনোহারী পণ্যে মমতার স্পর্শে হাত ছুঁইয়ে অনুভব করেন নিজের শৈশব কৈশর! উদ্ভাসিত দ্যূতিময়তায় একবুক ভালোবাসা ভালোলাগা বুকে নিয়ে ঘরে ফিরে যান সন্ধ্যার স্তিমিত আলোয়।
বিলবোর্ডের হ্যালোজেন অথবা নিয়নবাতিও নিঃস্প্রভ মনে হয় ছোট্ট দোকানীর  প্রদীপের আলোয়!
দূরে সাউন্ড সিস্টেমে ভেসে আসে সুরঃ, ''বাঁশী কই আগের মত বাজে না / মন আমার তেমন করে সাজে না/ তবে কী ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি!"
চেনা আলোয় তখন নিজেকে চিনে নিতে খুউব ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ছোট্টশিশুর মতন মায়ের আঁচলে মুখ লুকোতে!

সিরাজুল ইসলাম । পাবনা, বাংলাদেশ