রহস্যের মায়াজাল (চার) - সুজিত বসাক
সেজ জীতেন্দ্র প্রতাপ খুব সহজ মানুষ নন। কোনো কারণে মহারাজার ওপর তার প্রচন্ড ক্ষোভ রয়েছে। সুযোগ সন্ধানী লোকেরা তাকে উসকানি দিতে থাকে তলে তলে। ছোট নরেন্দ্র প্রতাপ মনে সরল হলেও ভীষণ স্বেচ্ছাচারী। ছোট থেকেই সে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত। কোন কাজেই তার মন বসে না। লেখাপড়াও বেশি দূর এগোয়নি। তাকে নিয়ে মহারাজা বীরেন্দ্র প্রতাপকে খুব চিন্তায় থাকতে হয়। কারণ রাজমাতার আবার ছোট ছেলের প্রতি অন্ধস্নেহ। মহারাজা কিছু বলতে গেলেই অন্ধস্নেহে প্রভাবিত রাজমাতা মহারাজকেই নানা কথা শুনিয়ে দেন। মহারাজা জানেন রাজমাতাকে প্ররোচিত করেন মহারাজার বৈমাত্রেয় মামা শিবনারায়ণ। সব বুঝেও মহারাজা কিছু বলতে পারেন না। ধূর্ত শিবনারায়নকে রাজ্য থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। রাজমাতা তার ঢাল হয়ে রুখে দিয়েছেন।
শিবনারায়নের দোসর আরও একজন আছে এই পরিবারে। তিনি মহারাজা বীরেন্দ্র প্রতাপের বোন জামাই অম্বরলাল। আগে ইংরেজ সরকারের অধীনে দেওয়ানের কাজ করত। টাকা তছরূপের অভিযোগে ইংরেজরা তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছে। এখন সপরিবারে কুঞ্জবিহারেই এসে আস্তানা গেড়েছে। বোন মাধবীলতা বাপের বাড়ি এসে থাকাতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু সে আপত্তি ধোপে টেকেনি। কারণ অম্বরলাল তার আগেই রাজমাতাকে বশ করে ফেলেছিল। রাজমাতা স্বয়ং ওর হয়ে সওয়াল করাতে বীরেন্দ্র প্রতাপ না করতে পারেননি। কুঞ্জবিহারে সেই দেওয়ানির কাজেই অম্বরলালকে নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
এর আগে কোন রাজবাড়ির অন্দরমহলের গল্প জানার সৌভাগ্য রাকিবের হয়নি। এই কদিনের অভিজ্ঞতায় তার এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছে। বাইরে থেকে রাজবাড়ির ঠাট বাট, জাকজমক মানুষকে মুগ্ধ করে। তারা ভাবে রাজবাড়ির ভেতরের মানুষ গুলো কতই না স্বর্গ রাজ্যে বাস করে! রাকিবও তাই ভাবত। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে আলোর ওপাশের অন্ধকারটা বড়ই ভয়ংকর। এখানে না এলে হয়তো সেটা সে কোনদিনই দেখতে পেত না।
রাজবাড়ির গল্প রাকিব শুনেছে রাজবাড়ির একজন চাকর হীরক দাশের মুখে। সবাই তাকে হীরুদা বলেই ডাকে। ষাটের কাছাকাছি বয়স। কিন্তু এখনও সুঠাম শরীর, কাজকর্মে সেই গতি। বর্ধমানের এক অখ্যাত গ্রামে তার জন্ম। একবার মহামারী শুরু হল গ্রামে। বাবা মা, আত্মীয় স্বজন অনেকেই মারা গেল। দূর সম্পর্কের এক মেসোর হাত ধরে সে হাজির হয়েছিল এই রাজ্যে। তখন মহারাজা ছিলেন বীরেন্দ্র প্রতাপের পিতামহ জ্যোতিরিন্দ্র প্রতাপ সিংহ। ভাগ্যক্রমে তার আশ্রয় পেয়ে গেলেন হীরক দাশ। সহজ সরল মানুষটা নিজের স্বভাব গুনে রাজবাড়ির অন্দর মহলে ঢুকে গেলেন। সেই থেকে হীরুদা রাজপরিবারের একজন সদস্য।
আজ সকালে হীরুদা রাকিবকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে বলল –“তুমি ওভাবে রাতে একা একা বেড়িয়ে একদম ভালো কাজ করোনি রাকিব দাদাবাবু। মানুষের কথা ছাড়, এদিকে চিতাবাঘেরও উৎপাত আছে। মহারাজা শুনলে খুব রাগ করবেন।”
রাকিব স্থির দৃষ্টিতে হীরুদার দিকে তাকিয়ে বলল-“তুমি আমাকে কোথায় দেখলে?”
হীরুদা হাসল –“বয়স হয়েছে…আজকাল কোথায় আর ঠিকঠাক মতো ঘুম হয়? বেশির ভাগ রাতই অর্ধেক জেগে কাটে। তাছাড়া আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে নমক খেয়েছি ওদের…. সেই দাম তো রাখতেই হবে।”
হীরুদার শেষের কথা গুলো হেঁয়ালি মেশানো, তাতে রহস্যের গন্ধ স্পষ্ট। রাকিব অনুমান করল, হীরুদা অবশ্যই জানে রাতের অন্ধকারে দীপঝিল পেড়িয়ে মেয়েটা কোথায় যায়। কিন্তু মেয়েটা ওভাবে পালিয়ে গেল কেন? তবে কী আরও কেউ আশেপাশে লুকিয়ে ছিল? নতুন করে আবার প্রশ্ন গুলো মাথায় চারা দিল।
ইচ্ছে করেই মেয়েটার কথা তুলল না রাকিব।
প্রসঙ্গ পাল্টে বলল –“কাল রাতে হঠাৎ অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। সেটা কিসের শব্দ দেখার জন্যেই বাইরে বেড়িয়েছিলাম। তুমি জানো, শব্দটা কিসের?”
হীরুদা বলল- “না। তবে আমিও শুনেছি। মাঝে মাঝে শোনা যায়। এই বাড়িতে এমন অনেক কিছু ঘটে যার উত্তর তুমি পাবে না। ঘুরতে এসেছ ঘুরে যাও। অযথা কোন বিপদের মাঝে পড় আমি চাই না।”
রাকিব হেসে বলল –“সে তুমি ঠিকই বলেছ। আসলে মহারাজার জন্য খারাপ লাগছে। দুদিনের সম্পর্ক হলেও ওঁর প্রতি কেমন জানি একটা মায়া জন্মে গেছে।”
-“তাহলে আমার অবস্থাটা চিন্তা করো। কোলেপিঠে মানুষ করেছি ওদের। মহারাজা মানুষটাই এমন, সবাইকে আপন করে নিতে পারেন। অথচ দ্যাখো, ওনারই আপনজনের অভাব। ধীরু দাদাবাবু ছিল আরও কাছের মানুষ। ওর মৃত্যুটা আমি মেনে নিতে পারিনি। প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে আমার বুকে।”
রাকিব বলল –“শুনেছি তার অকাল মৃত্যু হয়েছিল হার্ট অ্যাটাকে। বিধাতার বিরুদ্ধে তুমি কি প্রতিশোধ নেবে?”
নিমেষে পাল্টে গেল হীরুদার মুখ। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। চাপা হিসহিসে গলায় বলল –“সেদিন তোমাকে সত্যি বলিনি। এখন বলছি। ধীরু দাদাবাবু জলে ডুবে মারা যাননি। হার্ট অ্যাটাক ও হয়নি। খুন হন তিনি। বলতে পার আমার চোখের সামনেই তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল।”
একটু থামল হীরুদা। উত্তেজনায় তার বুক দ্রুত ওঠানামা করছে।
একটু জিরিয়ে নিয়ে বলল –“তুমি বাঙালি ছেলে। তোমাকে ভরসা করতে মন চাইল…তাই বললাম। এসব কথা তুমি আবার কাউকে বলতে যেও না কিন্তু।”
রাকিব বলল –“তুমি নিশ্চিন্ত থাক। তুমি ঠিক কী দেখেছিলে?”
-“আমি তখন গেস্ট হাউসের একটা ঘর পরিস্কার করছিলাম। তুমি তো জানো গেস্ট হাউসের জানালা দিয়ে দীপঝিলের দিকটা পরিস্কার দেখা যায়।”
-“কী দেখলে তুমি? কে মেরেছিল ধীরেন্দ্র প্রতাপকে?”
-“কী করে চিনব? মুখে মুখোশ পড়া ছিল তার। আমি ছুটে যখন সেখানে পৌছুলাম ততক্ষণে সে পালিয়েছে।”
-“এসব কথা তুমি এতদিন ধরে বুকে চেপে আছে? কাউকে বলোনি?”
-“না। কারণ জানি বলে কোন লাভ হত না। আমাকেই পাগল সাজিয়ে ওরা এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে। তাতে ওদেরই সুবিধা হত। ওরা চায়না আমি এখানে থাকি।”
-“ওরা কারা?”
-“তা জানিনা। এসব ষড়যন্ত্রের পেছনে যে একজন নেই সেটা তুমিও বুঝতে পারছ। নইলে ধীরু দাদাবাবুর খুনটা দিব্যি হার্ট অ্যাটাক বলে পার হয়ে গেল…. কেউ কিছুই করতে পারল না? ধীরু দাদাবাবু তো চলেই গেল…. এখন বীরেন্দ্র প্রতাপকে রক্ষা করাই আমার পণ।”
-“কিন্তু তুমি এভাবে একটা মানুষকে বাঁচাতে পারবে?”
-“জানিনা। চেষ্টা করে যাচ্ছি এইটুকুই বলতে পারি। বড় রাজাবাবু মানে আমাদের বর্তমান মহারাজার বাবার মৃত্যুটাও আমার স্বাভাবিক মনে হয়নি। বৃদ্ধ হলেও তিনি যথেষ্ট সুস্থ ছিলেন। আমার সন্দেহ হয় তার ওষুধের মাত্রা কেউ গোলমাল করে দিয়েছিল। তার কিছু প্রমাণও আছে আমার কাছে।”
-“কাউকে সন্দেহ হয় তোমার?”
-“সন্দেহ তো অনেককেই হয়। বোকার মতো একবার মহারাজাকে অনেক কিছু বলেও ফেলেছিলাম। তারপর ঘটল এক বীভৎস ঘটনা। একটা ছোট ছাগল ছানাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে কারা যেন আমার ঘরের সামনে রেখে গেল। এরপরে আর মুখ খুলিনি কোনদিন।”
-“বীরেন্দ্র প্রতাপ মহারাজা, তার শত্রু থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ধীরেন্দ্র প্রতাপ তো খুব ভালো মানুষ ছিলেন বললে…তাকে মেরে কার কী লাভ ছিল?”
-“সে ঠিকই বলেছ। তিনি একেবারে অন্য জগতের মানুষ ছিলেন। লড়াই- ঝগড়া- কোন্দল এসব থেকে বহু দূরে থাকতেন। খেলাই ছিল তার ধ্যান জ্ঞান। তবে….”
-“তবে কী?”
-“শেষের দিকে তার এক অদ্ভুত নেশায় ধরেছিল।”
-“কীসের নেশা?”
-“গুপ্তধনের নেশা। আমাকে একবার ঠাট্টা করে বলেছিল, জানো হীরুদা এই প্রাসাদে সাতরাজার ধন লুকানো আছে। আমি সেটা খুঁজে বের করবই।”
-“এটা সে কেমন করে জেনেছিল?”
-“তা আমি বলতে পারব না। তবে তাকে দেখতাম পুরানো পুঁথি পত্র নিয়ে নিজের ঘরে দিনরাত পড়াশোনা করছে। প্রথমে ঠাট্টা মনে হলেও পরে মনে হয়েছিল, ধীরু দাদাবাবুর খুনের পেছনে এসব কোন কারণ ছিল না তো? কারণ তার সিংহাসন বা জাগতিক লোভ তেমন কিছু ছিল না। তাছাড়া…”
একটু থামল হীরুদা। একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলে। তারপর আবার শুরু করল –“আমি তো ছুটে গেলাম ঝিলের ধারে। গিয়ে দেখি তখনও ধীরু দাদাবাবুর দেহে প্রাণ আছে। প্রলাপের মতো কী যেন বিড়বিড় করে বলছে। আমি মুখের কাছে কান নিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম। তার বেশির ভাগই বুঝতে পারলাম না। শুধু দু তিনটি শব্দ এখনও মনে আছে।”
-“কী শব্দ?”
-“ম্যাপ… চোরাকুঠুরি…. শয়তান…. গুপ্তধন। তারপরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল ধীরু দাদাবাবু।”
-“মুখোশধারী কিভাবে মেরেছিল ধীরেন্দ্র প্রতাপকে?”
-“প্রথমে পিছন থেকে মাথায় আঘাত করেছিল। তারপর জোর করে কিছু খাইয়ে দিয়েছিল বোধহয়। পরে ডাক্তারি রিপোর্ট বলল মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক।”
রাকিব কী যেন ভাবল একটু সময়। তারপর বলল –“তুমি যখন ভরসা করে এত কথা বললে, আমিও তোমাকে কালকে রাতের অভিজ্ঞতা টা বলি।”
রাকিব সবিস্তারে রাতের ঘটনা বলল। সব শুনে হীরুদা বলল –“এ এক অন্য উপাখ্যান। মেয়েটার নাম মায়া। কলকাতা থেকে এসেছে। লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মেয়ে। এমন সাহসী মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। কিন্তু যে জালে জড়িয়ে পড়েছে তাতে ওর কপালে কী যে আছে কে জানে। অন্য একদিন সব বলব। এই প্রাসাদে অনেকেই আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে। তুমিও বুঝে শুনে কথা বোলো।”...(চলবে)
সুজিত বসাক । দিনহাটা, কুচবিহার
-
গল্প//উপন্যাস
-
04-04-2020
-
-