অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
গাল-গল্প (৮) - কবির চৌধুরী

     বর্তমান অটোয়ায়- অর্থাৎ করোনাযুগের অটোয়ায় আলো আর অন্ধকার ছাড়া দিন-রাতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। চারিদিক নিরব নিস্তব্ধ। প্রয়োজনীয় কারনে ঘরের বাইরে যাওয়া ছাড়া- জেগে থাকা, ঘুমানো, নাওয়া-খাওয়া সবকিছুই এখন নিয়মের বাইরে। মহামারী “করোনা” ভাইরাস-এর সংক্রমণ টেকাতেই – মহল্লা, গ্রাম, শহর, দেশ, এমনকি পুরো পৃথিবী এখন লকডাউনের আওতাভুক্ত। হানিফের ৫৫ বছর জীবনে এই প্রথম  এধরনের অবস্থার মুখোমুখি হলো। অনেকেই বলছেন- এর আগে পৃথিবী এধরনের সংকটের মুখোমুখি হয়নি- এমনকি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও। 
     করোনা, সেলফ আইসোলেশান ও লকডাউনের কারনে মোটামুটি বিশ্বের অন্যান্য শহরের ন্যায় আমাদের আরশীনগর অটোয়া এখন একেবারেই নিরব-নিস্তব্ধ-শান্ত। খুব জরুরী কাজ ছাড়া কেহ ঘরের বাইরে যাচ্ছে না। সিগারেট খাওয়ার উছিলায় বাড়ীর চারপাশে হাঁটাহাঁটি ছাড়া আজকাল হানিফেরও তেমন বাইরে যাওয়া হয় না। লকডাউনকালীন অন্যান্য রাতের মত আজ রাতেও হানিফ সিগারেট খাওয়ার জন্য ঘরের বাইরে পা দিয়েছে। কি সুন্দর রাত। বাড়ীর সামনে বড় বড় পাতাবিহীন গাছগুলোর উপর চাঁদের আলোর বন্যা তার ভাবুক মনকে পাগল করে তুলে- ভাবে, দাঁড়িয়ে থাকা ন্যাড়া গাছগুলোর ফাঁকফোকর গলিয়ে আসা ঘোরলাগা এই আলোতে যদি পাওলার হাসিমাখা মুখটি দেখা যেত! ভাবতে না ভাবতেই বুকপকেটে রাখা ফোন বেজে উঠে-
     আগেও জিজ্ঞাসা করেছি, এখনো জিজ্ঞাসিলাম- কীভাবে বুঝেন যে, আমি আপনার কথা চিন্তা করছি?
     -মনের টান। কেমন আছেন? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? 
     -ঘুম, ফেইসবুক, বই নাড়াছাড়া আর টেলিফোনে আলাপ- এভাবেই সময় যাচ্ছে। কাজ কেমন যাচ্ছে? অফিস খোলা?
     -না, অফিস বন্ধ। অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটি।
     -ইশ! লকডাউন না হলে তো ভাল হতো। কোথাও ঘুরে আসা যেত!
     -শুরু করলেন!
     -সরি, মাফ করেন।
     -ঠিক আছে। বলেন, আমার কথা মনে হচ্ছিল কেন?
     -এমনিতেই। ভাল লাগছিলোনা তাই। আচ্ছা দেখছেন, করোনার সংক্রমণ কি হারে বাড়ছে?
     -হু দেখছি। তবে, এধরনের কিছু হবে তা আগ থেকেই বুঝা যাচ্ছিল। ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার পরপরই তা বুঝা যায়। এই রোগটির ভয়াবহতা সম্পর্কে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গেনাইজেশন সবাইকে সতর্ক করেছে। কিন্তু কেহ গুরুত্ব দেয়নি। অনেক রাষ্ট্রই ভাইরাসটিকে হালকাভাবে নিয়েছে, কেহ-ই চিন্তা করেনি রোগটি মহামারী আঁকারে দেখা দেবে। 
     -তা বলতে পারেন। দেখছেন না, বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য পিপিই(পারসোন্যাল প্রোটেকটিভ ইকুপমেন্ট), ভাইরাস পরীক্ষার জন্য কিট, এমনকি রোগিদের জন্য ভ্যান্টিলেটরের অভাব দেখা দিয়েছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য কোন দেশই সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল না।
     -এই অবস্থায় ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় নাই!  
     -তা বুঝলাম, ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় নাই। ইটালী, লন্ডন, ফ্রেঞ্চ, স্পেন, আমেরিকা এমনকি আমাদের কানাডা। যে হারে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা বাড়ছে- তাতে ভয় হচ্ছে। এপর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ১০লাখ মানুষ মরনব্যাধী করোনায় আক্রান্ত। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্যমতে প্রায় ৬০হাজার মানুষ করোনায় মারা গিয়েছে।
     -বাংলাদেশের অবস্থা কেমন? আপনার পত্রিকাতে তো বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কোন লেখা দেখলাম না।
     -বাংলাদেশে তো আমাদের কোন প্রতিনিধি নাই। আমাদের এটি তো একটি সাহিত্য পত্রিকা। খুবই কমই সমসাময়িক বিষয়ের সংবাদ ছাপা হয়।
     -আপনি লিখেন না কেন? 
     -সঠিক তথ্য ছাড়া এসব লেখা যায় না। এছাড়া কি লিখবো? হাসপাতালে রোগী নিচ্ছে না। ডাক্তাররা হাসপাতালে যেতে চায় না? মানুষ- মৃত মানুষকে দাফন করতে বাঁধা দেয়! অসহায় স্ত্রী- স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য সারারাত মানুষের সাহায্য চায়! বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু! হাসপাতাল বানাতে জনসাধারনের বাঁধা! ভয়ে স্বদেশভূমে বিদেশ ফেরত প্রবাসীদেরকে হেনস্তা! বাংলাদেশের মানুষ এত অমানবিক হলো কীভাবে? মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করাতে সেনাবাহিনী তলব! এইসব?
     -রাগ করবেন না। ভাইরাসটি সবদেশেই এধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। উন্নত দেশগুলোই যেখানে করোনার সংক্রমন টেকাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে কিছু অগোছালো হবে তা স্বাভাবিক। 
     -আপনার কথা মানলাম, -হয়তো বা তাই। পাওলা, এসব বাদ দেন। অন্যকিছু বলেন।
     -আপনিই শুরু করেন, আপনিই বাদ দেন। বাদ দিলাম। আপনিই নতুন কিছু বলেন।
     -লকডাউন নিয়ে একটি কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। শুনবেন? 
     -শুনবো, তার আগে বলি- আপনার “নীল ঘোড়া” কবিতাটি ভাল হয়েছে।
     -ধন্যবাদ, শুনুন তাহলে,

লকডাউনঃ-
অজানা এক রোগজীবানু-
নাম করোনা! এক ভয়ের নাম!
যা দেখে এখন
পৃথিবীর মানুষ অবাক-নির্বাক__
সংসারের সবিকছুতে অদ্ভুদ এক পরিবর্তন_
অথচ, একসময়-
মানুষ- মানুষ ছিল বলে,
পৃথিবী জয় করেছিল__
আর, এখন-
মানুষ- রোবট হয়েছে বলে, 
সামান্য এক রোগজীবানু পৃথিবীকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে!
ভাবতেই আশ্চর্য লাগে-
রোগজীবানু হতে ও যে নিজেকে, এই পৃথিবীকে__
বাঁচাতে হয়-
তা' কীভাবে ভুলে গেল?
পৃথিবীর উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষগুলো???

     -খুব ভাল লিখেছেন। আশা করি মানুষেরা মানুষের কথা চিন্তা করবে - করোনা পরবর্তী সময়ে মানুষ সুন্দর একটি পৃথিবী দেখবে। এখন রাখবো। ভাল থাকুন।
          -পাওলা, লাইন কাটার আগে শুনে যান-

লড়ছে মানুষ-
লড়ছে পৃথিবী-
হারবে করোনা-
জিতবে মানুষ-
গড়বে নতুন পৃথিবী-
মানুষের কল্যাণে। 
ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন।।

কবির চৌধুরী । অটোয়া, কানাডা