অটোয়া, সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪
করোনার কড়চা - গুলজাহান রুমী

   মার সাইনাসের সমস্যা আছে! বহুদিনের পুরনো। ৯৭ সালে নাকের অপারেশন হযেছে! পলিপ ধরা পড়েছিল! অপারেশন করে বেশ ভালোই চলছে। আর কোনোদিন সমস্যা করেনি তেমন। শীতের সময় খানিক সর্দি-গর্মি লাগলে সামান্য জালাপোড়া হয় কখনও! আপনাআপনি ভাল হয়ে যায় কিছুক্ষণ পর। তবে করোনার আতংক যখন এসেছে, আমার নাকের উপসর্গ যেন আমাকে পেয়েই বসেছে। করোনা নাকি নাক, মুখ, চোখ দিয়ে গলায় চলে যায়, তারপর সংসার পেতে বসে। আমার ঘরে গবেষকদের অভাব নাই। লেপটপে, সেলফোনে একটার পর একটা গবেষণাপত্র বিভিন্ন সায়েন্স জার্নাল, মেডিকেল জর্নাল থেকে তন্নতন্ন করে বের করা হচ্ছে, করোনার চৌদ্দগোষ্ঠী জাতিগোষ্ঠীর বাছবিচার চলছে। করোনার মাইল্ড উপসর্গ, মাঝারি উপসর্গ আর সিভিয়ার উপসর্গ কি কি হতে পারে এনিয়ে নিরন্তর রিপোর্টের পর রিপোর্ট এবং এটির নানা রঙ্গের কুলজি বিচারের বিরাম নাই। এই লোকটার কোনো কাজ নাই এখন, দিনে রাত্রে ঘরে বসে এখন করোনা বিশেষজ্ঞ হবার পথে। বছরের এই সময়টাতে ব্যাকইয়ার্ডে বা ফ্রন্ট ইয়ার্ডে বাগান বিলাস করে করে এক মূহুর্ত ফুরসত নিতে দেখিনি অন্য বছরগুলোতে। এই বছর বাগানের কাজ শিকেয় উঠেছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা হয় কীকরে মাটির অন্দর থেকে রোদের মমতা মাখিয়ে অঙ্কুরিত হচ্ছে গাছগুলো। আমি লোকটার উঁকিঝুঁকি দেখে বুঝতে পারি প্রান আনচান করছে মাটিতে হাত লাগিয়ে গাছের শিশুগুলোকে আদর করার জন্য। শহর লকডাউন হয়ে যাবার পর সেটা করতে নাপেরে চার সপ্তাহ হয়ে গেল ঘরের ভেতর বসে বসে সিএনএন, আল জাজিরা, বিবিসি-র বডকাস্ট সেন্টার বানিয়ে দিয়েছেন আমার বাড়িটা। সারাক্ষণ টেলিভিশন, লেপটপ, সেলফোন থেকে একটা না একটা নতুন তথ্য বের করা হচ্ছে আর আমি নাশুনলেও ঘরের দেয়ালকেও শোনানো হচ্ছে ।
     প্রথম প্রথম আগ্রহ নিয়েই খবর নিতাম। কিন্তু এখন আর কোনো খবরই শুনতে মন চায়না। সবখানে মানুষ মরছে। আমাদের কাছাকাছি নিউইয়র্ক, টরন্টো,মন্টিয়লে মানুষ মরছে। ফেসবুকে গেলেই এখন বাঙালিদেরও অকাল মৃত্যুর কথা ছবি দিয়ে লোকজন শেয়ার করছে। মানুষের কষ্ঠের সীমা নাই। আমাদের দেশে নারী-পুরুষ গার্মেন্টস শ্রমিকরা ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে শত মাইল পায়ে হেঁটে ঢাকার দিকে রওয়ানা দিয়েছে। পেটের দায় মানুষের। নাগেলে চাকুরী থাকবেনা। মৃত্যুদূত যেন ডাক দিয়েছে একথা জেনেও মানুষ অনিশ্চিত পথে নেমেছে, যেতেই হবে। নাগেলে জীবনের ছোট্ট একটা স্বপ্নও ভেঙ্গে যাবে। চাকুরি হারাবার ভয়, জীবন আবার অনিশ্চিত হয়ে যাবার ভয়। এসব দৃশ্য দেখতে কার ভাল লাগে ? আমি টেলিভিশন অফ করে রেখে দেই। দেখতে চাইনা মানুষের দুর্দিন। কিন্তু আমার ঘরের গবেষকদের বিরাম নাই। ওরা বাপবেটা মিলে হালের গবেষণার তথ্যগুলো নিয়ে চুলছেড়া আলোচনা শুরু করে দেয়। উপসর্গগুলো যেটাই শুনি আমার মনে হয় এটা যেন আমার মধ্যেও নড়াচড়া করছে।
     মনে হয় নাকের ভেতরে কী যেন ঢুকে পড়েছে ঘরের আসবাবপত্রে ধুলোবালি ঝাড়ামোচা করার সময়। বেশিবেশিই সমস্যা করছে! সবাই ঘরে, কোথায়ও যাওয়া হচ্ছে না! তবে সাফসতরো খুব বেশি হচ্ছে! চার পাঁচ দিন ধরে শুধু নাক, গলা ও কানে কি যে করছে! আমি নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না! তাহলে আমি অপরকেই কি বলব বা কি করে বুঝাব? টেলিভিশন রুমে সোফায় শুয়ে পড়লাম, মনের ভয় কাটাতে ছেলের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। বললাম, অদিব এদিকে আয়, আমার কাছে এসে বস বাবা।
     -কেন,কি টক কবে,মাম?
     -আমার শরীরটা এত খারাপ লাগছে।
     -কেন, কি হইছে তোমার?
     -জানি না বাবা, কি যেন করছে আমার গলায়, কিছু যেন আটকে আছে।
     -কিছু না মাম, গরম পানি ও লেবু খাও!
     -খাচ্ছি তো বাবা! শুধু ভয় ভয় করছে!
     -না মাম, কিছু হয়নি! ভয় পাওনা মাম।
     -চারিদিকে যে হারে মানুষ মরছে! আমি যদি মরে যাই কী করবে তোমরা?
     -ইস, মামা! মরবা না! কেন মরবে!
     -আচ্ছা, আমি যদি মরে যাই এ দুর্যোগের মধ্যে তাহলে কি করবি? লাশটা তো গর্তে রেখে দেবে। তোমারা কেউ যেতে পারবে না, গোসল দেবেনা, এই কথা মনে হলেই তো ভয় লাগে, কান্না পায়।
     -না মাম, তোমার কিছু হয়নি! বেশি বেশি করে লেবু ও গরম পানি খাও। আমারও এরকম করে। আবার চলে যায়।
     -হায়রে আল্লা! কবে থেকে তোর এরকম করে? তাড়াতাড়ি আয়, গরম পানি ও লেবুর রস চিপে দেই তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।
     ছেলের কথা শুনে আমি আমার গলার ব্যথা ভুলে যাই। ছেলে আমার হাসতে হাসতে বলে- না, না মাম! আমি অকে আছি। এখন নাই। অনেক আগে ছিল।
     -ঠিক বলছিসতো? তাহলে শোন, আমি যদি মরে যাই এই যে আমার গলায় একটা চেইন আছে দেখ......
     -হুম, তুমি কি চাও ঐটা সহ দিয়ে দিতে?
     -না, না, বাবা! এইটা গোল্ড! হোয়াইট গোল্ড। খুলে রাখবে। বুঝেছিস?
     -আচ্ছা মামা।
     -আর শোন,অরনিকে দেখে রাখিও। ভাই বোন একই সাথে, পাশাপাশি বাড়ি কিনে থাকবে।
     -হুম।
     এই হচ্ছিল মা বেটার কথাবার্তা। পাশেই ছিলেন অদিবের বাবা বসা! আমাদের কথা শুনে বলেন, কি যে বল না বল। বলেই বাপ-বেটাতে মিলে এক জগ লেবুর পানি গরম করে অদিবকে বললেন, পুরো একগ্লাস তোমার মাকে খিয়ে দাও। ছেলে আমাকে সোফা থেকে তুলে বিশাল একটা গ্লাস আমার মুখের কাছে ধরে বলে,সবটা খাও,মাম। এদের কান্ডতে আমার যত ব্যথা, ক্লান্তি সহসা পালিয়ে গেল। ছেলের সরল হাবভাব দেখে ভাল হয়ে গেল অশান্ত মনটা। সে ভেবে নিয়েছে ওর বাবার ধন্বন্তরি বিদ্যা আছে, এবং এতেই ওর মামের মৃত্যুভয় কেটে যাবে। হলোও তাই। আগেও মঝে মাঝে হতো নাকের ভিতর অস্বস্তি, গলা ব্যথাও। কিন্তু ঠিক এরকম হত কিনা মনে পড়ছে না।
     এখন কেনো যে মনটা অশান্ত হয়ে থাকে। মন ভালো রাখার জন্য নামাজ, কুরআন পড়া, তসবী টেপা, বইপডা, রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করায় ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করি কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন শান্তি পাইনা, মনের শংকা যায়না। কি এক আশংকা যেন আমাকে, আমার পৃথিবীকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নতুন কোনো কাজের খোঁজে তখন সারা ঘরময় আতিপাতি করে বেড়াই। রাতে ঘুমাতে গেলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মৃতদের দৃশ্য। সাদা পোশাকে আবৃত দেবদূতের মত কারা যেন চুপেচুপে নিয়ে যাচ্ছে সেমিট্রিতে মৃতদের লাশ। লাশগুলো যেন অচ্চ্যুত, ধরা যাবেনা, বেল্টে করে কবরে নামিয়ে চুপিসারে চলে যায় তারা! ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে উঠে এসে আবার গরম পানির থেরাপি নেই। মাথার ভনভন দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সেলাইর মেশিন নিয়ে বসে পড়ি, কাপড়-চোপড় মেশিনে ঢুকিয়ে ধুইতে দেই রাত-বিরাতে, বাসন গুলো গরম পানি দিয়ে আবার পরিষ্কার করি। কিন্তু কিছুতেই রাত ফুরোয়না। রাত ফুরোয় তো দিন আসেনা, আগের মত ব্যস্ততম দিন। স্বাধীনতা যুদ্ধ যখন হয়েছিল তখনও নাকি এরকম শংকায় দিন গেছে মানুষের! সেইসব শত্রুদের চোখে দেখা যেত। কিন্তু করোনা নামক শত্রুটাকে দেখা যায়না। কত হিংস্র, কত বন্য এই শত্রু। কত রূপে রূপান্তরিত হচ্ছে দিনে দিনে শুনতে পাই। সারা বিশ্বে ফ্রী টিকেটে কি মহা আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে! যাকে নাগালে পাচ্ছে সুড়ুত করে তার মধ্যেই ঢুকে পড়ছে। এক বিন্দু সরিষার দানাও নয়, এতই ছোট যে হাই লেন্সের মাইক্রোস্কোপ ছাড়া তাকে দেখা যায়না। সেই একরত্তি অনুজীব মানুষের দেহে প্রবেশ করে মানব দেহ দখলে নেয় ক্রমে, সংসার পেতে বাহকের অঙ্গ অচল করে দিতে পারে। সম্পূর্ণ বিশ্বমনডলকে কাপিঁযে রেখেছে আজ কতদিন। এখন আর কারও হাত নির্ভরযোগ্য না, তাইতো ধরা যাবে না! তবে খুবই উপকারী এক থ্যারাপী, জানিনা সবার মধ্যে কাজ করে কিনা? মনের অশান্তি ও মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পাবার জন্য, দুইদিন উপোস দিলাম। খুবই শান্তি পাচ্ছি। কেমন যেন মনটা সতেজ হয়ে উঠেছে। নিজেকে হালকা হালকা লাগছে। উপকৃত হয়েছি, এবং সাথে সাথে তাও উপলব্ধি করেছি, এই দুর্যোগের সময় আমাদের দেশে খেটে খাওয়া মানুষগুলো খিদার জ্বালা মিটানোর জন্য সারি সারি করে গাদাগাদি করে একে অপরের গায়ে ল্যাপটে দাড়িয়ে থাকে কেন? নারী পুরুষ শিশু। বিভিন্ন সংস্থা থেকে ফ্রী খাবার দেয়া হচ্ছে, দাতারা গলাগলি করে ছবি তুলছেন। ক্ষুধাতুর মানুষগুলোর বিপন্ন আর আকুল দৃশ্যটাকে যেন উপহাস করছে দাতাদের উৎসবমুখর ফটোসেশন। অগনিত ভোখা মানুষের মিছিল, কেউ পায় কেউ পায়না।। চোখ দুটো ছলছল করে উঠে. যখন দেখি বয়েসের ভারে কাতর কত কত মানুষ কেউ রিক্সা বা ঠেলাগাড়ি চালায়, তারা একটু খাবারের জন্য করোনার মত দানবের গ্রাসের ভেতর নিজেকে সপে দিচ্ছে। দুইদিন উপোস দিয়ে বুঝলাম মানুষ আর প্রানী কেন ক্ষুধার কাছে নতজানু।
     আর কিছু যেন ভাবতে পারিনা। কিন্তু একথা বুঝতে পারি সবাই মিলেমিশে বেঁচে থাকার আনন্দের চেয়ে আর কোনো আনন্দ নাই! মানুষকে মানুষ হিসেবে ভালবাসি। সবাই সুস্থ থাকি । আগামীতে করোনা মুক্ত নতুন পৃথিবী দেখার অপেক্ষায় আশায় বুক বাধি।

গুলজাহান রুমী। অটোয়া, কানাডা