শোভনের ডাইরি - অনন্যা দাশ
(লেখক শোভন বিশ্বাস, বয়স ৮ বছর)
জুন ১৯, ২০১৯
এখন রাত ন’টা বাজে। মা এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। পাশের বাড়ির দিদা, মানে মিসেস রুথ মার্টিন, আমাদের নিচের ঘরে টিভি দেখতে দেখতে সোফার ওপরই ঘুমিয়ে পড়েছেন। মা আজকাল প্রায়ই এই রকম দেরি করছে অফিস থেকে ফিরতে।
কিছু বললেই বলবে, “কী করব শোভন? আমাদের দুজনের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা তো আমাকে করতে হবে। এই রিসেশানের বাজারে চাকরির খুব খারাপ অবস্থা। যাক, তুমি ও নিয়ে চিন্তা কোরো না। মিসেস মার্টিন তো থাকেন তোমাকে রাতের খাবার দিয়ে দেওয়ার জন্যে। আর সামনের উইকেন্ডে একটু কাজের চাপ কম থাকবে মনে হয় তখন আমরা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যাবো, কেমন? শুধু তুমি আর আমি, অনেক মজা করব।“
কিন্তু সামনের উইকেন্ড আর আসে না। মানে সব উইকেন্ডই প্রায় মাকে অফিসে যেতে হয় কাজের জন্যে।
আমার বাবাকে আমি দেখিনি। আমি যখন খুব ছোট তখনই তিনি আমাকে আর মাকে ছেড়ে চলে যান। কোথায় তিনি মা যানে না। মা বাবার সঙ্গেই এই মার্কিন মুলুকে এসেছিলেন বিয়ের পর আর তার পর থেকে এখানেই রয়ে গেছেন।
এখন স্কুলের ছুটি, তাই বিকেলে আমি আমার প্রিয় বন্ধু জ্যারেডের সঙ্গে খলতে যাই। ওরা আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে। জ্যারেডের বাবাও ওর মাকে ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু জ্যারেডের অবস্থা আমার মতন নয়। ওর মা চাকরি করে না। বাড়িতেই থাকে সব সময়। আর ওর বাবা ওদের সঙ্গে থাকেন না বটে কিন্তু মাঝে মাঝেই বাবার মতন লোকজন ওদের সঙ্গে ওদের বাড়িতে এসে থাকে। জ্যারেড তাদের ‘আঙ্কেল’ বলে ডাকে। আমার সঙ্গে ওর যত দিন আলাপ তার মধ্যেই ওর তিনখানা আঙ্কেল হয়ে গেছে। আর ওই আঙ্কেলরা এসে থাকলে জ্যারেডের ভারি লাভ হয়। একজনের কাছ থেকে ও সাইকেল আদায় করেছে, আরেকজনের কাছ থেকে রোলার স্কেটস আর তৃতীয়জন ওকে একটা দারুণ ভিডিও গেম কিনে দিয়েছে।
আমি সেই কথা মাকে বলতেই মা তো রেগে কাঁই! আমাকে বলল, “জ্যারেডের মা আমেরিকান। সে যা খুশি করতে পারে। আমরা ভারতীয়। আমাদের একটা শিক্ষা আছে, সংস্কৃতি আছে! যা বোঝো না তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যেও না শোভন!”
আমি সত্যিই কথাটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না কিন্তু মা রেগেছে দেখে চুপ করে গেলাম। এদিকে মা কিছুতেই আমাকে সাইকেল কিনে দেবে না কারণ দিদা, মানে মিসেস মার্টিন, যিনি আমাকে দেখেন, তাঁর পায়ে ব্যথা। উনি কিছুতেই আমার পিছনে ছুটতে পারবেন না। আমি সাইকেল নিয়ে এদিক সেদিক চলে গেলে ঝামেলা হবে।
আরে গাড়ির শব্দ হল, মা ফিরেছে!
জুন ২৭, ২০১৯
এখন বিকেল চারটে বাজে। মা অফিসে, নিচে মার্টিন দিদা রান্নাঘরে খুটখাট করে কী সব করছেন। আমি আজকে খেলতে যাইনি। কার সঙ্গে খেলব? যার সঙ্গে খেলি সেই জ্যারেড তো আহত। ওরই একজন আঙ্কেল ও কথা শুনছিল না বলে ওকে টেনে একটা থাপ্পড় মেরেছিলেন কাল। জ্যারেড টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়েছিল আর টেবিলের কানায় লেগে ওর কপালটা ফেটে গেছে। কী সব কানেকশান না কী হয়েছে বলে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বেচারা জ্যারেড!
আজ মা বাড়ি ফিরলে আমি মাকে বলব, “মা, তুমি ঠিকই বলেছিলে। আমার ওই সব আঙ্কেল টাঙ্কেল চাই না। আমরা দুজনে বেশ আছি। সাইকেল আমার চাই না। শুধু তোমার সময় হলে একদিন সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে নিয়ে যাবে তো?”
অনন্যা দাশ। যুক্তরাষ্ট্র
-
গল্প//উপন্যাস
-
24-07-2020
-
-