অটোয়া, রবিবার ৬ জুলাই, ২০২৫
হৃদয়ে লু হাওয়া - ইকবাল কবীর রনজু

ঝিঙের কেজি আশি টাকা! বিশ্বাস করা কঠিন হলেও অবিশ্বাস করতে পারে না হাসান মাস্টার। এইমাত্র পাশের দোকান থেকে এক কেজি ঝিঙে কিনেছে সে। দাম কমানোর জন্য দোকানদারের সাথে অনেক্ষণ দামা দামি করেও কোন লাভ হলো না। দোকানদারের সাফ কথা, নিলে নেন না নিলে কেটে পরেন। অযথা আমার সময় নষ্ট করবেন না। অন্যান্য ক্রেতার সামনে দোকানদারের এমন তীরষ্কারমূলক কথা শুনে মন খারাপ হয় হাসান মাস্টারের।

কথা না বাড়িয়ে এক কেজি ঝিঙে নিয়ে পাশের দোকানের দিকে হাটতে থাকেন তিনি। শারমিন ছোট মাছের সাথে ঝিঙে খেতে পছন্দ করে, তাই কেনা। আড়াই’শ টাকায় এক পোয়া চিংড়ি মাছ কিনে মাছ বাজার থেকে সবজি বাজারে এসেছে হাসান। পাশের দোকানে যেতে যেতে ব্যাগের হাতল একটু উঁচু করে ব্যাগের মুখ ফাঁক করে একবার চিংড়ি মাছ ও ঝিঙে গুলো দেখে হাসান। চারটেতো মাত্র ঝিঙে। ব্যাগের কোনায় পরে থাকা চিংড়ি মাছের দিকে তাকাতেই হাসানের মনে হয় আগে গরীব মানুষ গুলো চিংড়ি মাছ খেত। যুগ জামানা পাল্টে গেছে। এখন বড় লোকরা চিংড়ি মাছ খায়, আর গরীবরা, মধ্যবিত্তরা মাঝে মধ্যে পাঙ্গাস, সিলভারকার্পসহ পুকুরে চাষ করা অন্যান্য কার্প জাতীয় মাছ খায়। এগুলো দামে একটু সস্তা পাওয়া যায় তাই। খাল-বিল-নদী-নালার মত মুক্ত জলাশয়ের মাছের দাম বেশি। এগুলো কেনার সাধ্য খুব একটা হয়না হাসান মাস্টারের।

দেশী মুরগির দাম বেশি বলে তাও কিনতে পারেনা হাসান। শারমিন দেশি মুরগি কিনতে বললে কখনো কখনো সোনালী মুরগি কিনে বাজার থেকে ছিলে নিয়ে যায় হাসান। শারমিন বুঝতেই পারে না দেশি মুরগি না সোনালী। আগে গরীব মানুষ কালে ভদ্রে উৎসবাদীতে খাওয়ার জন্য ব্রয়লার মুরগি কিনতো। এখন তাও কেনার উপায় নাই। এই তো ক’দিন আগেই প্রতি কেজির দাম উঠেছিল প্রায় তিনশ টাকায়। এ নিয়ে কত কি হয়ে গেল। ভোক্তা অধিদপ্তর সরব হলে উৎপাদকরা দাম কিছুটা কমালো। খবরের কাগজে এসব পরেছে হাসান।

পাশের দোকানের সামনে পৌছে সজনে ডাটার দিকে নজর পরে হাসান মাস্টারের। প্রথম যখন সজনে ডাটা বাজারে ওঠে তখন একশত ষাট টাকা কেজি ছিল। এক দিন নেড়ে চেড়ে দর দাম করেছিল বটে কিন্তু কেনা হয়ে ওঠেনি। এখন পুরো মৌসুম। হয়তো দাম কমেছে এই ভেবে দাম জিজ্ঞাসা করতেই দোকানদার জানালো, একশত বিশ টাকা কেজি। অবাক হয় হাসান মাস্টার। সে ভেবেছিল দাম কমেছে হয়তো। কেননা মৌসুমের শুরুর দিকে এ ধরণের সবজির দাম আকাশ ছোয়া হলেও শেষের দিকে কমে যায়। এ অভিজ্ঞতা আছে তার। এবার তো তার ব্যতিক্রম দেখছে হাসান। এখন না কিনলে আর কবে কিনবে? ক’দিন পরতো আর পাওয়াই যাবে না তাই অর্ধ কেজি সজনে ডাটা কিনে দাম দেওয়ার সময় চোখাচোখি হলো লতিফের সাথে। 

লতিফ ও হাসান দুজনই পাশাপাশি দুটি এমপিওভূক্ত  স্কুলে শিক্ষকতা করে। গত মাসে ছেলের মেস খরচ বাবদ আট হাজার টাকা পাঠানোর সময় লতিফের নিকট থেকে তিন হাজার টাকা ধার করতে হয়েছিল হাসানকে। বেতন পেয়ে ফেরত দিতে চেয়েছিলেন টাকাটা। বেতন পেয়েছেন বটে কিন্তু ঈদ উপলক্ষ্যে অনেক কিছু কেনা কাটা করতে হলো বিধায় লতিফের টাকাটা শোধ করা হয়ে ওঠেনি হাসানের পক্ষে। লতিফের জমাজমি আছে, স্বচ্ছল সংসার। বিপদ আপদে অনেক সময়ই এই লোকটা হাসানের পাশে দাঁড়ায়। এজন্য হাসান কৃতজ্ঞও তার প্রতি।

এগিয়ে গিয়ে লতিফের সাথে সহাস্যে কথা বার্তা বলে হাসান। লতিফ হাসানকে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। টাকার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায় হাসান মাস্টার। লতিফের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে হাসান সামনে এগুতে থাকে আর ভাবে ভাগ্যিস টাকাটা ফেরত চায়নি বা টাকাটার কথা মনে করে দেয়নি লতিফ। সরকারি ছোট কর্মচারিরাও হাসানের চেয়ে বেশি টাকা বেতন বোনাস পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে কেন যে শিক্ষকতায় এসেছিল এ ভাবনা মনে আসে হাসানের। মৃত মায়ের কথা মনে পরে কষ্ট পায় সে। হাসান যখন শিক্ষকতায় যোগদান করে তখন ওর মা বেঁচেছিল। যোগদান করার পর পরই এম.পি.ও ও হয়ে যায়। মা একদিন বলেই বসে এত লেখা পড়া করেও একটা চাকরি পেলিনা, হলি মাস্টার। সত্যি এই মাস্টারিকে এখন আর চাকরি মনে হয়না হাসানের। বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা খুবই কম। দেশে তো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সব চেয়ে বেশি। এ অবস্থায় মেধাবীরা কি করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতায় আসতে আগ্রহী হবে প্রশ্ন জাগে হাসানের মনে। আর মেধাবীরা শিক্ষকতা বিমুখ হলে শিক্ষার ভবিষ্যত কি হবে তাও ভাবায় হাসানকে। এসব ভাবতে ভাবতে বাজার থেকে বেড়িয়ে বড় রাস্তায় ওঠে হাসান।       

দৃষ্টি পরে রাস্তার পাশের তরমুজের দোকানের দিকে। থরে থরে সাজানো তরমুজ দরদাম করছেন অনেকে। এত দাম স্বত্তেও তরমুজের দোকানে কত ভীড়, দেখে বিস্মিত হয় হাসান। এবার তরমুজ কেনা হয়নি। ভরা মৌসুমে দাম ছিল ত্রিশ টাকা কেজি। তখন দুই ছেলেই মেসে ছিল। হাসান ভেবেছিল ছেলেরা বাড়ি আসলে তরমুজ কিনবে। ও শুনেছে দাম বেড়েছে তবে দাম কত হয়েছে তা জানে না। তরমুজের দোকানের সামনের ভীড় ফুরোচ্ছেই না। বৈশাখের শুরুতেই তাপমাত্রা  চুয়াল্লিশ ডিগ্রী পর্যন্ত উঠেছে। গরমে হাসফাঁস করছে মানুষ। রোজার সময় হওয়ায় ইফতারে তরমুজের চাহিদা বেড়েছে। ক’দিন আগে যে তরমুজ ত্রিশ টাকা কেজি ছিল সাত দিনের ব্যবধানে তা ষাট টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আজ না কিনলে আর কেনা নাও হতে পারে। পকেট থেকে টাকা বের করে একবার গুনে দেখে হাসান। যে টাকা আছে তাতে একটা তরমুজ কেনা যায়।

একজন মহিলা ইশারা করে দোকানীকে একটা ছোট তরমুজ দেখাতে বলে। হাসান মহিলাটিকে চেনে। সবাই সবিতা খালা বলে ডাকে। হাসান যখন সস্তায় মাছ কেনার জন্য দুপুরের পর বাজার শেষের দিকে মাছ বাজারে যায় তখনও মাঝে মধ্যে সবিতা খালাকে চোখে পরেছে তার। বাজারের মাছের দোকান গুলোতে পানি সরবরাহের কাজ করে সবিতা খালা। সবিতা খালা ছোট সাইজের একটা তরমুজ মাপায় দোকানীকে। সাড়ে পাঁচ কেজির তরমুজটির দাম তিনশ ত্রিশ টাকা চাওয়ায় বাক্য ব্যয় না করে সবিতা চলে যায় মাছ বাজারের দিকে। চারশত টাকায় মাঝারি আকারের একটা তরমুজ কিনতেই ঘেমে যায় হাসানও।

নিজের মোটরসাইকেলটি রাস্তার পাশে দাড় করিয়ে রেখে বাজারে ঢুকেছিল হাসান মাস্টার। ব্যাগ হাতে মোটর সাইকেলের দিকে যেতে থাকে। ও.এম.এস এর চাল বিক্রি হচ্ছে রাস্তার পাশের দোকানে। রাস্তার এক পাশ বরাবর দীর্ঘ লাইন। একটু সস্তায় চাল পাওয়া যায় বিধায় উপচে পরা ভিড়। হাসান অনেক দিন ভেবেছে এ দোকান থেকে চাল কিনবে। কিন্তু ধাক্কা ধাক্কি দেখে সাহস পায়না। লোকে কি ভাববে এ চিন্তাও মাথায় এসেছিল তার। অনেকে তো তার চেয়েও খারাপ অবস্থায় দিন কাটায়। তাদের কথা ভেবে ও.এম.এস এর লাইনে দাড়ায়নি হাসান। টিসিবি’র পণ্যও এখন কার্ডের মাধ্যমে কিনতে হয়। কার্ড পেতে মেম্বর চেয়ারম্যানের কাছে ধরণা দিতে হয়। পেটে ক্ষিধে থাকলেও, প্রায় মাসেরই শেষ দিকটা ধার দেনা করে চললেও টিসিবি বা ওএমএস এর লাইনে দাড়ায়নি হাসান। অমনযোগি ভাবে হাটতে থাকায় একটা দ্রুত গতির ভ্যান গাড়ি ধাক্কা দিয়ে যায় হাসানকে। পায়ের চামড়ার খানিকটা ছিলে যায় হাসানের। হাসান একবার পায়ের দিকে তাকায় কিন্তু অতটা মালুম করে না।

ব্যাগটা মোটর সাইকেলের হেন্ডেলে বাধায় হাসান। শারমিন মোটর সাইকেলের সাথে একটা হুক লাগাতে বলে কিন্তু লাগানো হয়নি এখনও। বাম পাশের ভেঙ্গে যাওয়া এবং ঝুলে থাকা ইন্ডিকেটরের দিকে চোখ পরে হাসানের। আজ বদলায় কাল বদলায় এভাবে বদলানো হয়নি এখনো। ঈদের আগে আর বদলানো হবে বলে মনেও হচ্ছে না। হাসানের স্কুলটা বাড়ি থেকে বেশ দূরে। দৈনিকের যাতায়াতের জন্য এই বাহনটা হাসানের প্রয়োজন হলেও নিজের পেটের ক্ষিধের মতো এই বাহনটির ক্ষিধেও মেটাতে পারছেনা হাসান। সঠিক সময়ে মবিল পাল্টাতে না পাড়ায় যখন হাসানের মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন বিকল হলো, ঠিক সে সময়ে পেট্রোলের দাম বাড়ল প্রায় একান্ন শতাংশ। কষ্ট করে দশ হাজার টাকায় ইঞ্জনটি সচল করে চলাচলের উপযোগি করলেও হাসানের পেট্রোল বাবদ খরচ বাড়ল একান্ন শতাংশ। যে হাসানের বেতন বাৎসরিক পাঁচ শতাংশ বাড়ে সে কি করে একান্ন শতাংশ দাম বাড়া পেট্রোল ব্যবহার করে মোটরসাইকেল চালাবে এমন প্রশ্ন ঘুরে ফিরেই আসে হাসানের মনে। আর শুধু পেট্রোলই তো নয়, গ্যাস, বিদ্যুৎ, চাল, ডাল, তেল, নুন, সাবান, কাপড়, ওষুধ, মাছ, মাংস, ডিমসহ প্রায় সব পণ্যইতো নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে নাকি এসব হচ্ছে। তবে কি বিশ্ব রাজনীতির ধকল সইতে হচ্ছে হাসানকেও? কিন্তু পত্র পত্রিকায় হাসান যখন চোখ বুলায়, আমাদের জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে এমন বর্ণনা দেখে তখন তা বিশ্বাস করা হাসানের পক্ষে কষ্টকর হয়ে পরে। এইতো সেদিনকার কথা, ডিমের হালির দাম উঠল পঞ্চাশে। হাসানরা আগে প্রত্যেকে একটা আস্ত ডিম খেলেও দাম বাড়ার পর ব্যয় কমাতে এক ডিম মধ্য দিয়ে কেটে ভাগ করে খাওয়া শুরু করে ব্যয় কমালো। কিন্তু তাতেও তো আয় ব্যয়ের সংগতি করতে পারছে না। পেট্রোলের দাম পরে লিটারে পাঁচ টাকা কমেছে বটে কিন্তু তাতেও যে হাসানরা অপারগ।

ছেলে মেয়েদের সাথে নিয়ে মার্কেট করে কয়েকটি ব্যাগ হাতে বাড়ি ফিরছে হাসানের পরিচিত এক সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি কর্মকর্তারাও হাঁপিয়ে উঠেছে। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করছে। হাসানের মতো শিক্ষরাও আন্দোলন করছে কিন্তু তা কর্তৃপক্ষের নজরের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। নিজের ছেলে দুটোর মুখ ভেসে ওঠে হাসানের চোখে। ওর ছেলেদের বেশির ভাগ সময়ই কলেজের নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরতে হয়। বাড়তি কাপড় খুব বেশি না লাগলেও মাঝে মধ্যেই কলেজ থেকে কাপড়, জুতাসহ অন্যান্য সামগ্রি ক্রয় বাবাদ বেতন ব্যতিত বাড়তি টাকা পাঠানোর চিঠি পায় হাসান। সেগুলো পরিশোধও করে হাসান। তার পরও ঈদ বলে কথা। এবার ছেলেদের কাপড়-চোপড় ওর খালা কিনে দিয়েছে। দর্জির দোকানে বানাতে দেওয়া আছে। ঈদের আগেই চৌদ্দশত টাকা মজুরী দিয়ে দর্জির দোকান থেকে কাপড় গুলো আনতে হবে। শ্বাশুড়ির জন্য একটা কাপড় কিনেছে হাসান। ইচ্ছে থাকলেও খুব বেশি দাম দিয়ে ভাল শাড়ি কিনে দিতে না পারার কষ্ট বিদ্ধ করে হাসানকে। নিজের মা থাকলে তার জন্যও তো কিনতে হতো।

তরমুজটা তেলের টাংকি ও কোলের কাছাকাছি রেখে সাবধানে মোটর সাইকেল চালিয়ে বাড়ির সামনে চলে আসে হাসান। মোটর সাইকেলের হর্ণ বাজাতেই ছোট ছেলেটা বেড়িয়ে এসে তরমুজটা হাতে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢোকে। শারমিন ও বেড়িয়ে এসেছে। হাসানের পায়ের দিকে চোখ পরতেই আতকে ওঠে শারমিন। সাবমারসিবল পাম্প ছেড়ে দেয়। হাসানকে নিকটস্থ পানির কলের নিকট নিয়ে পানির কল ছেড়ে খানিকক্ষণ ঠান্ডা পানিতে পা ভেজাতে বাধ্য করে শারমিন। এর পর পা মুছে দিয়ে ঘরে নিয়ে খাটের উপর বসায়। অতি সাবধানে খাটে বসে হাসান।        

মাস ছয়েক আগে পুরোনা এ খাটটা ভেঙ্গে যাওয়ায় বাড়ির পাশের মাসুদ মিস্ত্রীকে ডেকে এনে কোনমতে মেরামত করে নিয়েছে হাসান। ভেবেছিল ঈদের আগে একসাথে বেতন বোনাস পেলে একটা নতুন খাটের অর্ডার দিবে। সপ্তাহ খানেক আগে ছোট ছেলেটাকে সাথে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের আনন্দ ফার্নিসার্সে গিয়েছিলও হাসান। ঘুরে ফিরে বিভিন্ন ডিজাইনের খাট দেখেছে বটে কিন্তু অর্ডার দিতে সাহস পায়নি, যদি শেষতক টাকায় না কুলোয়। বেতন তোলা মাত্র অন্য কিছু হোক না হোক আগে ছেলেদের পড়ালেখার খরচ পরিশোধ করে হাসান। তার পর মুদি দোকানীর বাঁকি পরিশোধ ও শেষতক হাওলাতের টাকা পরিওশোধ করে। কিন্তু এবার কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল নিয়মের। যে সামান্য টাকা অবশিষ্ট ছিল এখন তাই খরচ করছে। মূল বেতনের পঁচিশ শতাংশ উৎসব ভাতা পায় সে। এতে কিই বা হয়। রোজা উপলক্ষ্যে এমনিতেই বাড়তি খরচ এর পর ঈদের খরচতো রয়েছেই। কে মেলাবে প্রতিদিনের হিসাব?

ফিতরার টাকার জন্য কয়েকজন ভিড় জমিয়েছে বাইরে। নূন্যতম ফিতরার বেশি দেওয়ার সাধ্য হয় না হাসানের। ইচ্ছা থাকলেও পারে না। এমন কত ইচ্ছাইতো মাটি চাপা দিতে হয় হাসানদেরকে। ঈদুল আযহায় একটা পশু কোরবানী করার ইচ্ছাও অনেক সময় মেটাতে পারেনা হাসান। ভাগ্যকে দোষায় আর অপেক্ষায় থাকে, যদি কখনো সুদিন আসে।

ফিতরা প্রত্যাশীদের বিদায় করে ঘরে ঢুকে হাসানকে নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পরে শারমিন। ছুলে যাওয়া স্থানে মলমের প্রলেপ দিয়ে দেয়। এক দৃষ্টিতে শারমিনের দিকে তাকিয়ে থাকে হাসান। ভাবে এই মেয়েটা তার সকল সখ আহলাদ বিসর্জন দিয়ে কত ভাবেই না হাসানকে সাহস জুগিয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। শারমিনের বাবা মা চেয়েছিল প্রতিষ্ঠিত কোন ছেলের সাথে শারমিনের বিয়ে হোক। কিন্তু বেঁকে বসে শারমিন। একই কলেজে পড়তো শারমিন ও হাসান। কলেজে পড়ার সময়ই শারমিন ভালবেসে ফেলে হাসানকে, হাসানও। এর কয়েক বছর পর হাসান যখন স্কুলে জয়েন করে তখন শারমিনও পড়া লেখা শেষ করেছে। শারমিনের বাবা-মা যখন কৌশলে শারমিনকে অন্যত্র বিয়ে দিতে চায়, দিন ক্ষণও ঠিক করে ফেলে এমন সময় বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেড়িয়ে হাসানকে বিয়ে করতে বাধ্য করে শারমিন। এমন বিয়েতে হাসানের মত না থাকায় ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল শারমিনকে, কিন্তু পারেনি। পরে সব ঠিক ঠাক হয়ে গেছে। এসব কথা মনে হলে এখন হাসি পায় হাসানের। মাঝে মধ্যে অতীত স্মৃতি রোমান্থনের সময় ওরা দুজনই খিল খিল করে হেসে ওঠে। সেসব সময় শারমিন বলে, অর্থ বিত্ত না পেলাম, তোমাকে তো পেয়েছি।

একটা চাকুরীর চেষ্টা করেছিল শারমিনও। তখন স্থনীয় কমিটি শিক্ষক নিয়োগ দিত। স্থানীয় একটি স্কুলের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলে চূড়ান্ত করে রেখেছিল ওরা। পরে অন্য কেউ বেশি টাকা ডোনেশন দেওয়ায় চাকরীটা তারই হয়েছে, শারমিনের হয়নি। মহার্ঘ্য ভাতা পেলে এ অবস্থার হয়তো কিছুটা উন্নতি হবে এমন প্রত্যাশা বেশ কিছু দিন হলো করে আসছে হাসান। কিন্তু সেটি সহসা হচ্ছে বলেও মনে হয়না তার। পত্র পত্রিকায় এ সংক্রান্ত লেখা গুলো খুটিয়ে খুটিয়ে পরে হাসান।

রাত পোহালেই ঈদ। বেরুতে হবে। ঈদের কিছু বাজার অবশিষ্ট আছে। গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা রয়েছেন। হাসানের ছোট ভাইয়ের পরিবারের সাথে থাকেন তিনি। শারমিন ওর জমানো টাকায় হাসানের বৃদ্ধ বাবার জন্য ও পরিবারের অন্যান্যদের জন্য কিছু কেনা কাটা করে রেখেছে। ওগুলো পৌঁছে দিতে হবে। গোস্ত সমিতিতে মাসে চারশ টাকা চাদা দেয় হাসান। এনায়েতুল্লা মাদরাসা মাঠে সমিতির গরু জবাই করা হয়েছে। গোস্ত আনতে যেতে হবে। কিছু মিষ্টান্নও কিনতে হবে। শারমিনের জন্য একটা থ্রিপিস কিনতে হবে। বিকেল তিনটে নাগাদ ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পরে হাসান।

এখন তাপমাত্রা কম, চল্লিশের মতো মনে হচ্ছে। এক ফোটা বৃষ্টি নেই কত দিন। বৃষ্টির জন্য এ শহর ও শহর গ্রাম গঞ্জে প্রার্থনা করছে মানুষ। সে প্রার্থনা, অন্তরের চাওয়া কি বিধাতা শুনছেন না, দেখছেন না। এই সোনার দেশ যেন মরুভূমি হওয়ার উপক্রম। লু হাওয়া বইছে। একজন লোক লুঙ্গি বিক্রি করতে করতে হেটে চলছে রাস্তায়। রাস্তার পিচ গরম হয়ে যেন গলে যাওয়ার উপক্রম। মুহুর্তেই ঘাম ঝড়তে শুরু করে হাসানের সারা শরীর বেয়ে। রাস্তার পাশে শুকনো নদী। নৌকা গুলো রোদে পুড়ে খাক হচ্ছে। রাস্তার পাশের সরকারি নলকূপের সানা বাধানো চত্ত্বরের ভাঙ্গা অংশে জমে থাকা সামান্য পানিতে চড়ুই পাখি ঠান্ডার পরশ পেতে গা ভিজিয়ে নিচ্ছে। পাশের বোরো ধান ক্ষেতের পাতা গুলো শুকিয়ে গেছে। জমির মাটি ফেটে চৌচির। ধানের শিষ বেরুচ্ছে। অনেক শিষেই কেবলই চিটা। সেচ কার্যে ব্যবহৃত নলকূপ গুলোর পাম্প মাটি গর্ত করে দশ বারো ফিট  নিচে স্থাপন করেও অর্ধেক পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ডেলিভারি পাইপের মুখে কি যেন গুজে দিয়েছেন পাম্প মালিকরা। নাবী ভুট্রা গুলো আরো অন্তত পনেরো দিন পরে পাকতো সেগুলো আগেই পেকে যাচ্ছে। গাছ থেকে আটির ছোট ছোট কাঁচা আম পারছে একদল লোক। হরিপুরের আড়তে এ আম বিক্রি হয়। অন্যদিন তো এ ব্যাপারগুলো ভাল ভাবে লক্ষ্যই করেনা হাসান। আজ কেন করছে?    

হাসানের হৃদয়ে এর চেয়েও বেশি লু হাওয়া বইছে নাকি? দিনের পর দিন রোদে পোড়া বোরো ধানের মতো হাসানরাও কি শুকোচ্ছে না? তার ভেতরটাও কি রোদে পোড়া পিচের মতো উত্তপ্ত হয়ে তরলায়িত হচ্ছে না?

ফেরার পথে শাহী মসজিদ মোড়ের রনজিতের লন্ড্রির দোকান থেকে পুরোনো পাজামা পাঞ্জাবীটা ইস্ত্রি করে নেয় হাসান। কয়েক বছর ধরে এটাই পরে আসছে। নিজের জন্য তো কিছুই কেনা হয়নি। কাল যে এ পোশাকটা পরেই ঈদের নামাজ আদায় করতে ঈদ মাঠে যেতে হবে তাকে।

ইকবাল কবীর রনজু
লেখক- সাংবাদিক, সাহিত্যিক
 পাবনা, বাংলাদেশ