অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
সাবধান, দিগন্ত সমাদ্দার আসছে! - সুনির্মল বসু

মেয়েটির স্বামী মারা গিয়েছে বিয়ের পরে বছর তিনেকের মধ্যেই। কোলে দুধের শিশু। বড় অভাবের সংসার। চৌরাস্তার মোড়ে কিলো দশেক চাল নিয়ে বিক্রি করতে বসেছিল। পাড়ার উঠতি মস্তান বিল্লা গতকাল সকালে দলবল নিয়ে সেই চাল কেড়ে নিয়ে চলে গেছে। 

কথাটা এরিয়ার টাফ রংবাজ দিগন্ত সমাদ্দারের কাছে পৌঁছালো। পরদিন সকালে দিগন্ত ওর ডান হাত সন্টেকে নিয়ে মাঠ পেরিয়ে বিল্লার কাছে এলো। বাইরে থেকে হাঁক দিল, বিল্লা, বাড়ি আছিস?

জানালার ওপার থেকে বিল্লা একবার বাইরেটা দেখে নিল। প্রশ্ন করলো, কেন? কি হয়েছে?

দিগন্ত বললো, গরীব মানুষের চাল কেড়েছিস কেন? খেতে পায় না, ওর চাল ওকে ফেরত দিয়ে দে!

বিল্লা জবাব দিল, তোমাকে দালালি করতে হবে না।

দিগন্ত বললো, ওর চাল ওকে দিয়ে দে। আমি তোকে চালের টাকা দিয়ে দিচ্ছি।

বিল্লা বলল, না, আমি দেবো না।

এটাই তোর শেষ কথা?

হ্যাঁ, বললাম তো। তুমি এখন ফুটে যাও।

কাজটা কিন্তু তুই ভালো করলি না! বলে দিগন্ত মাঠের মধ্যে গিয়ে হাঁটা শুরু করলো।

দিগন্তকে, মানে মাস্তান দিগাকে এরিয়ার সবাই খুব সমীহ করে। ও চলে যাচ্ছে দেখে, বিল্লা জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে যাচ্ছিল। হঠাৎ গুলির শব্দ। পিছন ফিরে দিগন্ত গুলি চালিয়ে দিয়েছে। কপালে গুলি লেগেছে বিল্লার। স্পট ডেড।

এই দিগন্তের একদিন একটা উজ্জ্বল অতীত ছিল। বড় বাড়ির ছেলে সে। হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করবার পর জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার সুযোগ পায়। ওরা দুই ভাই বোন। দিদি পারমিতার বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা সরকারী গেজেটেড অফিসার। মা একসময় স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। ছেলে মেয়ে মানুষ করবার জন্য স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন।

দিগন্ত শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। ওর সাবজেক্ট, ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং। ওখানে হোস্টেলে থাকতো। ছুটিতে ওদের বেহালার বাড়িতে এসেছে। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা। আড্ডা দেওয়া। ক'দিন ধরে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ একটি মেয়ে এই সময় কলেজে যায় দেখেছে। ওর বন্ধু অতীন বলেছে, মেয়েটির নাম অরুনিমা সান্যাল। লেডি ব্র্যাবন কলেজে ইংরেজিতে অনার্স পড়ে। ভারী সুন্দর দেখতে ওকে। মাথায় ঢেউ ঢেউ কেশরাশি।
তপেশ বলল, ওই তো, তোর ফিয়াসে আসছে!

দিগন্ত মানবেন্দ্র মুখার্জির গানের ভক্ত। ওকে শুনিয়ে গেয়ে উঠলো, মিথ্যে কাঁচের আরশিতে মুখ দেখ না সজনি, আমার চোখের আয়না দ্যাখো, রূপসী গরবিনী!

অরুনিমা হঠাৎ হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল,
কোনো কাজকর্মের যোগ্যতা নেই, রাস্তায় মেয়ে দেখলেই, ঝারি মারা অভ্যেস। লজ্জা করেনা?

দিগন্ত বলল, ভালো লাগে আপনাকে, তাই গানটা গেয়েছি।

ময়দানে বসে গান প্র্যাকটিস করুন। যাতায়াতের রাস্তায় নয়। তারপর অহংকারী ভঙ্গিতে অরুনিমা চলে গেল।

সেদিন খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল দিগন্তের। কাউকে ভালোবাসা জানানো কি পাপ! সত্যিই সে কি কোনো গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছে? এই পথে আর কোনোদিন দাঁড়াতো না দিগন্ত।

অরুনিমার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলে, খুব কষ্ট হতো ওর। বুকের মধ্যে ভালোবাসা গোপন রেখে, ও তখন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিত।

বছরখানেক বাদে তপেশ খবর এনে দিল, অরুনিমা ইংরেজি অনার্সে ভালো রেজাল্ট করে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে এমএ ভর্তি হয়েছে।

ততদিনে দিগন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার ফাইনাল দেবে। একদিন নিজেই অরুনিমার সঙ্গে পথে দেখা করে বলল, তোমার সাফল্য আমার ভালো লেগেছে।

অরুনিমা বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।

দিগন্ত বললো, আজও তো ভালবাসি তোমাকে।

আমার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলুন!

দিগন্ত একদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলল। বলল, আমি অরুকে  ভালোবাসি। আপনারা অনুমতি দিলে,

অরুনিমার বাবা জাঁদরেল পুলিশ অফিসার। বললেন, আই সে গেট আউট!

আপনি আমার কথাটা একটু শুনুন!

তুমি যাবে, না তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দারোয়ান দিয়ে বের করে দিতে হবে?

দিগন্ত আর কথা বাড়ায় নি। সেই থেকে বুকের মধ্যে একটা বেদনার ক্ষত বহন করে নিয়ে চলেছে। সংসারে কোন কিছুই ভালো লাগে না ওর। জীবন যেন ভার বাহী একজন জন্তু। বহন করতে পারছি না এই ভার, ও মনে মনে বলে। মনে মনে আরো বলে, আমি যখন কিছু গড়তে পারিনি, তখন আমি সব ভেঙে দেবো।

এরিয়ার টাফ রংবাজ এখন দিগন্ত সমাদ্দার। মানুষের উপর অন্যায় দেখলে, ও ঝাঁপিয়ে পড়ে। গরীবের বন্ধু, বড়লোকের শত্রু এখন দিগা।

সেদিন অবশ্য দিগন্ত একা কষ্ট পায়নি, কষ্ট পেয়েছিল অরুনিমাও। কিন্তু বাবা-মায়ের মুখের ওপরে প্রতিবাদ করতে পারেনি। প্রথমবার ছেলেটিকে ভালো না মনে হলেও, পরে অরুনিমা বুঝেছিল, সত্যিই ছেলেটি ওকে ভালবাসে! আর একবার প্রকৃত ভালবাসা পেয়ে গেলে, মেয়েরা তখন নদী হয়ে যায়।

একদিন অরুনিমার বাবা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা গেলেন। ও বাবা মার একমাত্র সন্তান। মাঝপথে পড়া থামিয়ে ও তখন চাকরির চেষ্টা করতে লাগলো। বাবার বন্ধু এক উকিল বাবু জয়ন্ত মিত্র ওকে ডালহৌসির এক প্রাইভেট অফিসে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেন।

যদিও চাকরিটা অরুনিমার ভালো লাগছিল না। অফিস ছুটির পর, বস দীর্ঘ সময় অফিসে আটকে রাখেন। মাঝে মাঝে পার্কস্ট্রিটের পানশালায় মদ্যপানের আসরে সঙ্গ দিতে বলেন। এমন চাকরি ছেড়ে দেয়াই ভালো, কিন্তু সংসারটা কিভাবে চলবে?

সেদিন সকালে অফিসে আবার পথে দিগন্তের সঙ্গে দেখা। এনফিল্ড বুলেট গাড়ি চালিয়ে ও আসছিল।
অরুনিমাক দেখে গাড়ি স্টার্ট বন্ধ করে বলল, কোথায় চাকরি করছো?

ডালহৌসিতে অফিস।

কেমন লাগছে?

মোটেই ভালো লাগছে না।

কেন?

বসের মতিগতি ভালো নয়।

চাকরিটা ছেড়ে দাও।

কি করে চলবে?

আমি সামলে নেব।

কিভাবে?

গত সপ্তাহে আমি একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে জয়েন করেছি।

একদিন আমাদের বাড়িতে এসো।

যাবো তো। তোমার মায়ের কাছে বিয়ের অনুমতি চাইতে।
এক বছর পর অরুনিমার বাবার অশৌচকাল কেটে গেলে, ওদের বিয়ে হলো।

একদিন পুলিশ এলো, দিগন্তের খোঁজ করতে।
আপনার নামে একটা ওয়ারেন্ট আছে, একটা মার্ডার কেস। আপনাকে থানায় যেতে হবে।

চলুন। আমি সমাজের কোন নিয়ম ভাঙ্গিনি। শুধুমাত্র অন্যায় গুলোর প্রতিকার করতে চেয়েছি।

দিগন্ত পুলিশ ভ্যানে উঠে বসলো। 

অরুনিমা কাঁদছিল। জানলা দিয়ে দিগন্ত বললো, আমি তোমার কাছেই ফিরে আসবো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবো। নতুন পৃথিবী ফিরিয়ে আনতে হবে।
জয়া দেবী মেয়ে অরুনিমার পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, ও খাঁটি ইস্পাতের টুকরো, ব্যবহার করতে জানা চাই, তুই একটুও কাঁদিস না, অরু।  অনেক ভাগ্য করলে, সংসারে এমন মানুষের দেখা মেলে।

সুনির্মল বসু
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত