অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
একলা চলো রে - ফাহমিদা রিআ

রোশনার দেখা নেই এখনও। ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছাড়িয়ে গেছে কখন। অথচ এমন আশ্বাস দেয় যেন রাত  পোহাবেই না,এসে পড়বে। আরে বাবা, না পারলে না বলবি। তা' না "খালাম্মা কোন চিন্তা কইরেন না, আমি আন্ধার থাকতেই আইসা পড়ুম। কলিং বেল আপনের ঘুম ভাঙ্গামু, দেইখেন"।
হুম্ খুব দেখা হলো।  "আপন হাত জগন্নাথ"-- নিজ মনে গজ গজ করতে করতে চুলোয়  ছোট্ট কড়াইয়ে দেড় কাপ পানি বসায় তারিন। পাশে রাখা লবনের বৈয়াম খুলে এক চিমটি লবনও ছিটিয়ে দেয় পানিতে। আটার জারটা তাক থেকে নামিয়ে  বেলনা পিড়ি  রেডি  করতেই কলিং বেলটা পরপর দুবার বেজে ওঠে। এলেন উনি হুহ্। দেয়ালে ঝোলানো ঘড়িটায় চোখ ঘুরিয়ে কর্নার সেলফে রাখা চাবিটা হাতে  সামনের বারান্দায় এগিয়ে যায় তারিন। একবার নীচে তাকিয়ে রোজকার মত চাবিটা ফেলতে ফেলতে জানিয়ে দেয়  " রোশনা  চাবি ফেললাম"।

ড্রয়িং রুমের দরজার লকটা খুলে রেখে আবার কিচেনে পা বাড়ায় তারিন। হাতে সময় নেই মোটেও। অফিসে প্রচুর কাজের চাপ চলছে। সকালে সব গুছিয়ে যেতে পারলে ফেরার সময় অত তাড়া থাকে না। অথৈ সময়মত খেয়েদেয়ে পড়তে বসে যেতে পারে। মেয়েটাও এবার ক্লাশ নাইনে, চাপও বেড়েছে আগের চেয়ে। 
--খালাম্মা, খুব দেরী হইয়া গেলো আইজও। চিন্তা কইরেন না, হাত চালাইয়া শ্যাষ করবো তাড়াতাড়ি।। আপনি রাখেন আমি হাত ধুইয়া আসতাছি, আপনি অথৈ আপুমনিরে রেডি করান। 
তারিন কিছু না বলে ফ্রিজের মাছ,সব্জি, মসলার বাটি একে একে বের করতে থাকে। রোশনা দ্রুত হাতে আটা খমির করে ঠান্ডার অপেক্ষার সময়টুকুতে সব্জি কাটতে শুরু করে। অসাবধানে প্রথমেই একটুখানি আঙুলেও চোট লাগে। উফ্ বলতেই তারিন ফিরে তাকায়।
...আহা,কেটে গেলো?  অত তাড়ার দরকার নেই বাপু। একটু সময় বাঁচানোর  জন্য নতুন ঝামেলায় ফেলো না রোশনা। 
বলতে বলতেই ডাইনিং এ রাখা ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে এলো তারিন।  ছোট্ট করে তুলো ছিঁড়ে ডেটল লাগিয়ে কটন স্ট্রিপ বেঁধে দিলেন।
রোশনার কন্ঠ ভার। তাতে আবেগ ঢেলে চেখের দুফোটা পানি ঝরিয়ে বললো,
--জগতটায় এত মায়া থাকতেও কিছু কিছু মানুষ এত বে রহম হয় কেন্ খালাম্মা? 
আঙুলে স্ট্রিপ লাগাতে গিয়ে তারিন দেখলো  হাতে কালশিটের দাগটা।
--আবার মেরেছে বুঝি তোমার স্বামী? এইতো সেদিন না বললে, খুব ভালো হয়ে গেছে সে। কাজ করে, বাজার সদাই আনে, ছাই পাশ আর খায় না।
--"বদ মানুষের  স্বভাব যায় না ম'লে আর কয়লার ময়লা যায় না ধুলে" বুঝছেন খালাম্মা। আমার জমানো টেকার খোঁজ পাইয়া ভালো মানুষ সাজছিলো কদিন। পয়সা শ্যাষ, ভালোমানুষিও শ্যাষ। কাইল রাইত থন বিছানা বালিশ উল্টাইয়া জিনিষ পত্র ফেলা ছড়া কইরা আরও টেহা খুঁজে। আমি যহন বাঁধা দিছি আমার জিনিসে হাত দিতে, সেই পুরান অত্যাচার আবার।আমি নাকি তারে হাঁচা কই নাই। লুকায় রাখছি আমার গুপ্তধন। বদের ঘরের বদ, তুই আমারে কত সম্পদ দ্যাছস যে আমি গুপ্তধন বানায়া লুকায় রাখুম?
ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে কাঁদতে আবারো  কাজে হাত লাগায় রোশনা।

তারিন দাঁতে ঠোঁট কামড়ে তাকায় রোশনার কান্না ধোয়া  কর্মক্লান্ত দুঃখি মুখটার দিকে। কতইবা বয়স। এ বয়সে অবস্হাপন্ন ঘরের মেয়েরা কলেজ ভার্সিটিতে যায়, স্যারের লেকচার শুনে, লাইব্রেরি করে,টিউটরিয়াল জমা দেয়।মাথা ভরা টেনশন থাকে গ্রেডটা ঠিক থাকবেতো? সি জিপির মানটা যেন বজায় থাকে। 
অথচ রোশনাদের জীবনে তখন ঘোর সংগ্রাম বেঁচে থাকার। যার চাওয়া শুধু সাধারন মৌলিক অধিকারটুকুর। জোটে না তাও। উপরন্তু লাথি ঝাঁটার গঞ্জনাতো আছেই।

... মা, একটু আসবে? গ্রামারটায় আটকে গেছি। দেখাও না প্লিজ...
তৈষির ডাকে তারিনের চিন্তাচ্ছিন্ন হয়। গলা বাড়িয়ে বলে,
-- দাঁড়া আসছি। কতবার বলি হোম ওয়ার্কগুলো আগের রাতেই করে রাখতে, তা ' না এখন আমি কোনদিকে সময় দেই বলতো?
তৈষী জানে, মা যতই মুখে বলুক, সময় বিলাতে মায়ের জুড়ি নেই। দশভুজার মত কেমন করে যেন সবই সামলে ফেলেন। পড়ে থাকে না কিছুই।

অফিসে লাঞ্চটা সেরে দু' চোখ বুঁজে চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দেয় তারিন। রোশনার মুখটা ভেসে ওঠে ভাবনায়। কি সরল আর নিষ্পাপ একটা মুখ। আহা কি উচ্ছলই না হয় কখনো কখনো। স্বামীর মিথ্যে আশ্বাসে বারবারই ভুল করে, স্বপ্ন সাজায় জীবনের, রঙে রঙিন হয় মন। দিনান্ত খেটে  রক্ত পানি করা তিলে তিলে গড়া সঞ্চয় যখন কেড়ে নেয়। পুরো ভেঙ্গে পড়ে মেয়েটা। যেন দাঁড়াবার শক্তিটুকুও আর ধরে রাখতে পারে না। নিজের এই দু'পা তবুও মাটিতে ভর করে দাঁড়ায় বারবার নতুন আলোর আশায়, নতুন দিনের আকাঙ্খায়। তার দুটো পায়ে ভর দিয়ে আছে যে আরও একজন,মুনিয়া। তার ন' বছরের একরত্তি মেয়েটা। প্রাইমারীতে ভর্তি করিয়েছে। দু/ চারটে ক্লাশও ডিঙিয়েছে। এক বাসার আপার কাছে গিয়ে প্রাইভেটও পড়ে।  আর তাইতো খরচের হিসেবটা আজকাল মানিয়ে নিতে আরও দু' বাড়িতে সিঁড়ি মোছা আর কাপড় ধোয়ার কাজটা বাড়তি নিয়েছে রোশনা নিজের ছোট্ট অবসরটুকুকে কাজে লাগিয়ে। 
আর এসব কিনা জুয়াড়ি বেকার  স্বামী গুনে গুনে হিসেব চায়, কৈফিয়ত তলব করে। তারপর পুরুষত্ব ফলায় মেরে ধরে নাক মুখ ফাটিয়ে আঘাতের ক্ষত চিহ্নের দগদগে ঘা এঁকে দিয়ে নিরুদ্দেশ থাকে মাসের পর মাস। মেয়েকে নিয়ে কোন নিরাপত্তার বেষ্টনিতে কিভাবে এতগুলো রাতের আঁধার পার হয় রোশনা তা হাড়ে হাড়ে জানে। ছুটির দিনগুলোতে এক আধবেলা তারিনের বাড়তি কাজগুলো প্রায়ই করতে আসে রোশনা। বিনিময়ে মাইনের উপরিতো দেয়ই তারিন, আরও দেয় পুরনো  হয়ে যাওয়া কিচেনের অব্যবহৃত সেল্ফটা, টুলটা,  চেয়ারটা। কাপড় চোপড়, বিছানার চাদর, পর্দা আরও কত কি। রোশনা পুরনো ব্যাগে কাপড়গুলি ভাঁজে ভাঁজে ঢুকাতে ঢুকাতে হাসে আর বলে,
--খালাম্মা, এত্ত কাপড় আমি কি করি কনতো। আমার এক চিলতা ঘরতো ভইরা দিলেন আপনি।
-- কাঁথা বানাবে, কিসের যেন কভার বানাবে বলছিলে। তারপরও যেগুলো বেশি মনে হবে ঐ ফেরিঅলার কাছে দিয়ে হাঁড়ি কড়াই  নিয়ে নিবে আগের মত।
--হ, খালাম্মা আমার ঘরের সখের জিনিসগুলানতো আপনার এইসব দিয়াই করি। তয় মুনিয়ার বাপ যদি ভালা হইতো আমার আরও জিনিস জমতো। বদ বেডা কি করে জানেন খালাম্মা, নতুন বড় হাঁড়িটা আর সাধের প্রেসার কুকারটা কোন ফাঁকে নিয়া ক'টাকায় বেইচ্যা ছাইপাশ গিলে। ঘরে শত্তুর থাকলে সংসারে বরকত হয় না খালাম্মা। কপাল, সবই আমার কপাল। হের লাইগ্যাইতো মুনিয়ারে বুঝাই, মা  রে লেখাপড়া শিখ্ যতদিন পারা যায়। কোন মতে একটা কর্ম জোগাড় হইলে বিয়া করিস। নইলে না। সংসারের গ্যাড়াকলে আমার মত পিষতে দিমু না তোরে। পড়্ মা মন দিয়া পড়্।
তারিন এনড্রয়ডে আঙুলে স্ক্রল করতে করতে রোশনার কথা শুনে। এবার চোখ তুলে তাকায়, বলে
-- আচ্ছা রোশনা, তুমিতো বিয়ের মর্ম  মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলে। তারপরও মুনিয়াকে বিয়ে দেবার সখ কেনো? লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে যদি ভালোভাবে দাঁড়িয়ে যায় মেয়েটা। তোমরা মা মেয়ে মিলে সুখে থাকবে। হয় না?
--হায় হায় খালাম্মা কয় কি। আমি বুঝি সারা জীবন বাঁচুম? মাইয়া মাইনসের একটা সাইনবোর্ড লাগে গো খালাম্মা। তয় অরে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগে বিয়া দিমু না।

আজকাল রোশনার কথাগুলো মনে ঘুরপাক খায় তারিনের। খুব ছেলেবেলায় তার মাও সব সময় বলতেন, মাগো, লেখাপড়ার অনেক দাম। টাকা পয়সা, দামী গয়না,  গাড়ি বাড়ি সব থাকলেও ওগুলো কখনও কখনও হারাবারও ভয় থাকে, কিন্তু লেখাপড়া শিখে যখন উচ্চ শিক্ষিত হওয়া যায়, সেটা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। নিজের মর্যাদা নিজেকেই গড়তে হয়। নিজের আসন নিজেকেই উঁচু করতে হয়।

বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারিন। শিক্ষা দীক্ষা যেটুকু নেয়ার, নিয়েছিলো সে।  মানসম্মত একটা চাকরীতে জয়েনও করেছে যথেষ্ট পড়াশুনার পর লিখিত পরীক্ষা ডিঙিয়ে, ভাইভা বোর্ডের বাঘা বাঘা পরীক্ষকদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে।
মাস কয়েক যেতে না যেতে বসতে হলো বিয়ে পিঁড়িতেও।  এরেঞ্জ ম্যারেজ। শিক্ষিত  পাত্র,  বড় অফিসের চাকুরে, ভাইবোন সবাই আপন আপন জীবনে প্রতিষ্ঠিত, শুধু বাবা মা নেই।
চার হাত এক করে গুরুজনেরা দায় সারলেন। তারিনের নতুন জীবনের বোঝাপড়ায় ধীরে ধীরে অনুভব করলো তার ফেলে আসা অতীত, কৈশোর, তারুন্য পুরোই আড়াল এ জীবন থেকে। সামনে এগোতে হবে তাকে একাই। আক্ষরিক অর্থে জীবনসংগি হলেও সে মনের সংগে মিতালী করতে অপারগ। আত্ম অহমিকা আর নিজের একক ভালো থাকাটাই তার কাছে প্রধান। সময়ের সংগে প্রাণের দোসর সে হতে পারাতো দূরে থাক, অদ্ভুত হলেও সত্য যে দূরে ছিটকে পড়লো সে একটু একটু করে অনেকটাই। কন্যার জন্মের পর সুযোগটা আরও এক কাঠি সরেস হলো। এক ছাদের নীচে থেকেও যোজন যোজন দূরত্ব গড়তে থাকলো সে সামান্য কারনে কথা বন্ধ করে দিয়ে। তারিনও প্রথম প্রথম অভিমান করতো, আড়ালে কেঁদে ভাসাতো। কিন্তু এতে করে জীবনসংগিটি যেন মোক্ষম অস্ত্র এটাকেই  বানালো। বাজার শেষ হয়, আনে না। বাসা ভাড়া দিতে দেরি হওয়ায় বাড়িঅলার ফোনে নিজেকে হীন মনে হয়, মেয়ের খাবার দাবার পোষাক প্রয়োজন, সেখানেও ভ্রুক্ষেপ নেই। সব ক্ষেত্রেই গা বাঁচিয়ে চলে। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গে তারিনের। বিস্ফোরিত হয়,আবার কান্নার দমকে নিভেও যায়। কিন্তু স্বামী ভদ্রলোক সাফ জানিয়ে দেয়, তার শান্তিতে বিঘ্ন তিনি পছন্দ করেন না। পছন্দ করেন না মেয়ে মানুষের জোর কন্ঠ। আর চাকুরীজীবী মেয়ে  তিনি বিয়ে করেছেন,খরচ দেবার জন্যতো নয়। সুদূর চিটাগাং এ ট্রেনিং এর সুত্র ধরে চলে গেলেন পরের মাসেই। পরবর্তীতে পোস্টিং নিয়ে নোঙরও পুতলেন দূরের ঘাটেই। 
নিরুপায় তারিন একবার ভাবলো সব ছেড়ে ছুড়ে আগের মত ফিরে যাবে   আজন্ম বড় হওয়া শিকড়ে। মায়ের আঁচলের ছায়ায় তার পুতুল পুতুল খেলা আপন ঘরটায়। যেখানে কালো আবলুশ রঙা টেবিলটায় থাক থাক করে গোছানো থাকতো বই খাতা কলম। মাঝে মাঝে বাবা মোটা চশমা এঁটে অংক বুঝাতেন মেয়েকে। আর আনন্দে মাথায় হাত ছুঁইয়ে বলতেন,
----- তারিন তুই অনেক বড় হবি মা, অনেক বড়।
হ্যাঁ সবইতো তেমন আছে। সেই চাকা ওয়ালা মস্ত গেট, সেই ঘর সেই দোর সেই পেয়ারা সেই বড়ই গাছটা পর্যন্ত। কিন্তু তারিনের ঠাঁই হয় না। রোগে আর বয়সের ভারে  নুয়ে পড়া অশিতীপর বৃদ্ধ বৃদ্ধা বাবা মা তিন পুত্রকে স্হাবর অস্হাবর সমান ভাগ করে দিয়ে নিজেরাও দুজন তিনদিকে ভাগের পন্য হয়েছেন। তারিনকে কোথায় জায়গা দেবেন। একসময়ের পেলে পুষে বড় করা মেয়েটিকে সাজ সজ্জাসহ পাত্রস্হ করা  মানেতো শুধু অন্তরেই বসিয়ে রেখেছেন। এক কানি স্হাবরওতো দেন নি।
ভাই ভাবীরা একযোগে পারিবারিক মিটিং এ সিদ্ধান্ত নেয়, তারিন এখন যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। তৈষী জড়িয়ে গেছে তার জীবনে। ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে হলে ওর ভবিষ্যত কি হবে? পুরুষ মানুষ কেউ কেউ একটু অমনই হয়। মেজাজ মর্জি মত চললেইতো মানিয়ে চলা যায়। বাবা মা পয়সা ঢেলে প্রতিষ্ঠিত করে বিয়ে দিয়েছেন তারিনকে। কেন তাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে? মাথায় রাখতে হবে, এ সমাজে স্বামীর পরিচয় ছাড়া চললে তাকে সবাই সহজলভ্য, সস্তা মনে করবে। পেছনে তাচ্ছিল্য বাণী আউড়াবে।  তাছাড়া ভাইদেরও মেয়ে আছে। বংশে ফুপুর প্রভাবটাও মানুষে চোখে আঙুল দিয়ে  যে দেখাবে না, তাই বা কে বলতে পারে?

এনাফ, এনাফ টু মাচ...
তারিন দুহাতে মাথার রগ চেপে ওঠে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট তৈষীকে নিয়ে নিজের চাকুরীর শহরে সেই যে গেছে আর এ মুখো হয় নি। বড় ফ্লাট ছেড়ে   সাধ্য অনুযায়ী ছোট ফ্লাটে নিজের মত করে মা মেয়ের সংসার সাজিয়েছে। স্বামী ভদ্রলোক কালে ভদ্রে ফোন করলে সেও স্বাভাবিক জবাব দিয়েছে। না, কোন তপ্ত বাক্যে নয়, নয় নরম সুরেও। নারী পুরুষের ভেদাভেদটা, বৈষম্যের সমতাটা, নারীর ক্ষমতায়নটা তার একার কাছ থেকেই  শুরু হোক, হয়েছে। অন্তত তারিনের সেটা ভেবেই স্বস্তি।
দিনে দিনে মুনিয়া বড় হয়েছে, মায়ের স্কুটিতে চড়ে স্কুলে, কোচিংএ কখনও পৌঁছে গেছে, কখনওবা নিজেই রিকশা নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রাইভেট টিউটর বাসায় এলে  মাকে পাহারায় বসে থাকতে হয় না। কারন মেয়েকে সব ধরনের প্রতিকুলতা বুঝতে শিখিয়েছে তারিন। সাবধানী হতে। প্রয়োজনানুযায়ী প্রশিক্ষন নেয়া কংফু কারাতী প্রয়োগ করতে।
স্বামী ভদ্রলোকটিকে নিজ থেকে কাগজ পাঠাতে চেয়েও আর পাঠায় নি তারিন। থাক না সাইনবোর্ড হয়ে। মেয়েটা  ফোনে বাবা ডাকতেতো পারে, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ঈদ পার্বনে কাছেও পায়, গায়ে হাওয়া জুড়ানো আত্মঅহংকারী বাবা পকেট থেকে মুঠিভরে সেলামীও দেয় বৈকি। কর্তব্য বলে কথা।

দিন গড়িয়েছে, গড়িয়েছে বছর। তারিন পদমর্যাদায় আরও উঁচুতে ওঠেছে। তৈষী বড় শহরে পড়তে গেছে, হলে হোস্টেলে থাকতে শিখেছে। চার দেয়াল ছেড়ে  চারপাশের হাল হকিকত চিনতে শিখেছে, অনুভব করতে শিখেছে মায়ের একার সংগ্রামটাকে। পড়া শেষে বাইরের স্কলারশীপটাও লুফে নিয়েছে। যাবার আগে মায়ের হাতে হাত রেখে মায়ের স্বপ্নটাতে শক্তি জুগিয়েছে দ্বিগুন আনন্দে।

নারীর ক্ষমতায়নের উপর বিদেশী এন জিও গুলোতে লাগাতা যোগাযোগ করে কয়েকটি জেলায় শাখা খুলতে সফল হয়েছে তারিন। বঞ্চিত অনেক নারীর একলা চলার পথকে মসৃন করেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। ছড়িয়ে পড়েছে নারী পুরুষের সমতা অর্জনের অনেক বিষয়ের উপর কর্মদান। সবচেয়ে আনন্দের কথা হলো, সেই ছোট্ট জেলা শহরের মুনিয়া লেখাপড়া শেষে ঐ জেলার নারীর ক্ষমতায়ন প্রজেক্টটার কর্ণধার আজ। আর তার মা রোশনাও একজন কর্মী সেখানকার।

অবসরে যাবে আজ তারিন। খাতা কলমে অবসর ঠিকই কিন্তু আসলে আরও ব্যস্ততার দিন সামনে তারিনের। বিদেশ থেকে আমন্ত্রন এসেছে একটা সেমিনারে যোগদানের। সেখান থেকে তৈষী মাকে ছ' মাসের জন্য নিয়ে যাবে নিজের কাছে। ওদেশে তারিনের কাজও হবে আবার মেয়ের যাপিত জীবনটাও দেখা হবে। 

অফিসের শেষ দিনের ব্যস্ত সকালের শেষ দিন আজ। চায়ের মগ হাতে দখিনের বারান্দায় বসে প্রতিদিনের মত সূর্যোদয় দেখছিল তারিন।হঠাৎ করেই যেন জীবনটাকে আপাদমস্তক খুলে দেখার সাধ জাগছে আজ অবসরের আগ মুহুর্তে।। লাভ ক্ষতির হিসেবটাও মিলাতে  ইচ্ছে করছে যে।
টিংটংটিংটং রিং টোনটা ইচ্ছেতে বাঁধ সাধলো ঠিক তক্ষুনি।
--হ্যালো, তৈষী?  ভালো আছিসতো মা?
--মা, প্লেন ডিলে থাকায় পৌঁছুতে দেরী হয়ে গেলো। আজ তোমার চাকুরীর শেষ দিন। আমি আসছি তোমার অফিসে। তোমাকে নিয়ে ফিরবো। 
--কেনরে তোকে আসতে হবে কেনো? আমি ঘাবড়ে গেছি ভেবেছিস?
--উঁহু, তুমিতো তা নও। একলা চলা যার জীবন, সেতো চেনা পথেই ফিরতে পারবে ভালো করেই জানি। তবে কি জানো মা, বাবা ফোন করেছিলেন  আমার কাছে। রিটায়ার করার পর দেশের বাড়িতে ভাই ভাতিজাদের বোঝা হয়ে থাকতে থাকতে খুব মুষড়ে পড়েছেন।  বললেন, শুনলাম তুই তোর মাকে নিয়ে বাইরে চলে যাবি, আমাকে একা রেখে? 
তারিন হেসে বললো,
--আর অমনি তোর খুব মায়া হতে লাগলো বাবার জন্যে তাইতো?
--ঠিক তা নয় মা। আগে শোনোই না। বাবার খুব ইচ্ছে আমার সাথে উনিও আজ তোমার অফিস থেকে তোমায় নিয়ে ফিরবেন।  এও বললেন, যে কটা দিন তোরা দেশে আছিস একসাথেই না হয় কাটুক দিনগুলো। তোরা ফিরে আসার আগেই হয়তো চলে যেতে হবে ওপারে। শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না রে মা।

তারিন এর কোন জবাব খুঁজে পেলো না শব্দ ভান্ডার হাতড়েও। ও প্রান্ত থেকে তৈষী তখনও বলে চলেছে,
--হ্যালো, হ্যালো মা শুনছো? নাকি নেটওয়ার্ক  প্রবলেম, ওয়ান সাইড হয়ে গেছে   হয়তো...

ফাহমিদা রিআ 
মালিবাগ, ঢাকা
বাংলাদেশ