অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ - আশ্রম: একটি চেতনার নাম – সপ্তম পর্ব

কবির চৌধুরী, অটোয়াঃ কানাডার রাজধানী অটোয়াতে আমি সেই ’৮৮ সাল থেকেই আছি। এই শহরেই এখন স্থায়ীভাবে আমার বসবাস। এই দীর্ঘ সময়ে আমি অটোয়ার পুরাতন সংগঠন বাকাওভের উত্থান-পতন দুই-ই দেখেছি। যদিও পতন খুব আস্তে আস্তে হয়েছে তবে তার উত্থান ছিল দেখার মতো, মনে রাখার মতো। এখনও আমরা পুরাতনরা যখন বাকাওভ নিয়ে আলোচনা করি তখন সেই সব দিনের কথা আলোচনা করি। আমাদের স্মৃতির পাতায় উঁকি দেয় ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৯, ২০১০ এবং ২০১৭। অনেকেই মনের গহীন থেকে আক্ষেপ করেন শহরের অন্যান্য সংগঠনগুলো যখন সদর্পে শহরের আনাচে-কানাচে দাপিয়ে বেড়ায় সেখানে বাকাওভ কেন নতুন কমিটি গঠনের কিছু দিনের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে যায়? 

১৯৯১ সালের বাকাওভের জাগরণে আমি একজন দর্শক ছিলাম। আমি তখন দেখেছি বাকাওভের প্রতি অটোয়ার বাঙালিদের অকৃতিম ভালবাসা। প্রয়াত সৈয়দ ফারুক আনোয়ার মিন্টু, প্রয়াত আখলাকুজ্জামান পান্না, শেখ মোহাম্মদ ফারুক, ড. মাকসুদুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা এনায়েতুর রহমান আঙ্গুর প্রমুখদের অক্লান্ত পরিশ্রম। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে বাকাওভ সাধারণ মানুষের সংগঠনে পরিণত হয়। কিন্তু ২/৩ বছরের মাথায় বাকাওভ আবার তার জৌলুস হারিয়ে ফেলে, কোথায় যেন সংগঠনের কর্মচাঞ্চল্য হারিয়ে যায়। তারপরে আবার অটোয়ার বাঙালিরা ১৯৯৫ সালে বাকাওভের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৬ সালে আবার নির্বাচন হয়, কমিটি গঠন হয়। সেই একই সমস্যা! নির্বাচনের কিছুদিনের মধ্যেই কমিটির কেউ কেউ সংগঠনের দায়িত্ব ছেড়ে চলে যান। এভাবেই বাকাওভ চলছে। ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যেই যেন বাকাওভের চলা। ১৯৯৬ এর পরে বাকাওভের নির্বাচন কবে হয়েছিল আমার জানা নেই। তবে ২০১০ পর্যন্ত বাকাওভের ২/১টি কমিটি হয়েছে মনে হয়। অনেকেই বলেন বাকাওভ তখন মৃতপ্রায় ছিল। 

তারপরে আসে  ২০১০, এ বছরটি আমার বিশেষভাবে মনে আছে। আমি তখন সবেমাত্র মাসিক আশ্রম পত্রিকা প্রকাশ করেছি। আশ্রম স্থানীয় পত্রিকা, তাই আমরা কয়েকজন শহরে বাকাওভের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখালেখি শুরু করি। যদিও ইতিমধ্যে শহরে কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংগঠনের জন্ম হয়ে গিয়েছে। আমাদের লেখালেখির কারণে ২০১০ সালে বাকাওভ আবার পুনর্গঠিত হয়। সেই একই অবস্থা। কমিটি গঠনের কিছুদিনের মধ্যেই কমিটির কাজে স্থবিরতা চলে আসে। কমিটির সদস্যরা সংগঠন ছেড়ে যান। এমনকি অনেকেই বাকাওভের সাধারণ সদস্য হতেও আগ্রহী হন না। হাতে-পায়ে ধরেও কাউকে সংগঠনের সদস্য করা যায় না। যেহেতু সংগঠনে কোন সদস্যই পাওয়া যায় না, তাই নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না। কাকে নিয়ে কার্যকরী পরিষদ গঠন করবেন?  

এমতাবস্থায় আসে ২০১৭-১৮ সাল। অটোয়াতে ফোবানা আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এরকমই ফোবানার এক সভায় বাকাওভের পুনর্গঠনের জন্য সৈয়দ ফারুক আনোয়ার মিন্টুকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং ফারুক আনোয়ার মিন্টু খুব সুন্দরভাবে বাকাওভকে পুনর্গঠন করেন। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত সৈয়দ মিন্টুর কমিটি কর্তৃক গঠিত কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা বাকাওভের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ভাল কিছু কাজ করার জন্য। কিন্তু মহামারি কোভিডের কারণে অনেক কাজই তারা করতে পারেননি। এছাড়া নানাবিধ কারণে কার্যকরী কমিটির অনেক সদস্য তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ছেড়ে দিলে বাকাওভ অনেকটা আগের মতোই হয়ে যায়। ৩/৪ জন দ্বারা তো সব কাজ সামলানো যায় না। তারপরেও বর্তমান কার্যকরী কমিটির এই ৩/৪ জন, কোভিড মহামারীর পর সবকিছু স্বাভাবিক হলে বাকাওভের নির্বাচন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সম্পাদন করার জন্যে গত ৫ই অক্টোবর ২০২৩ সাধারণ সভার মাধ্যমে, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, লেখক মহসীন বখত, আশ্রম সম্পাদক সুলতান শিরীন সাজি, কমিউনিটি ও সাংস্কৃতিককর্মী রিয়াজ জামান ও আমাকে নিয়ে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট বাকাওভ উপদেষ্টা পরিষদ ও অন্তর্বতীকালীন কমিটি গঠন করে দেয়। আমাদেরকে সংগঠনের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বাকাওভের আগামী নির্বাচন আয়োজন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

আমি এবং মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আনোয়ার ভাই সেই ১৯৯১ সাল থেকেই বাকাওভের নির্বাচন আর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। অনেকটা বাধ্য হয়েই আমার এবারের দায়িত্ব নেওয়া। তাই এবার যখন আমাকে এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত করা হয় তখন আমি কমিটির অন্যান্য সদস্যদের অনুরোধ করি বাকাওভকে অটোয়ার বাঙালিদের প্রিয় সংগঠনে পরিণত করতে হলে আমাদেরকে সর্বপ্রথম দেখতে হবে অটোয়ার সাধারণ মানুষ কেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সংগঠনের (আশ্রম: একটি চেতনার নাম- ষষ্ঠ পর্ব) সদস্য হতে চান না। আমরা গত ৩/৪ মাসে শহরের অনেকের সাথে আলোচনা করেছি। অনেকের মতে শহরে এখন অনেক সংগঠন বিদ্যমান। এতসব সংগঠনের ভিড়ে বাকাওভকে কার্যকরী সংগঠনে পরিণত করতে হলে গান-বাজনার পাশাপাশি এমন কিছু করতে হবে যাতে সাধারণ বাঙালিরা সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মানুষকে বুঝাতে হবে, অন্যান্য সংগঠনগুলো কিছু গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ঐসব সংগঠনে সবার অংশগ্রহণ শর্তসাপেক্ষ। কিন্তু বাকাওভ বাংলাদেশি, বাংলাদেশি-কানাডিয়ান সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে সবার সমান অধিকার। যে অধিকার হয়ত অন্যান্য সংগঠনে পাওয়া যাবে না।

অটোয়ার এই বিশিষ্ট মানুষজনের মতামত এবং আমাদের কমিটির সবার মতামতের ভিত্তিতে আমরা বাকাওভের সংবিধানের কিছু পরিবর্তন পরিবর্ধন করেছি। আমাদের বিশ্বাস পরিবর্তীত সংবিধান বাকাওভের আগামীদিনের কার্যক্রমকে গতিশীল করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। আমরা চেষ্টা করছি অটোয়ার সর্বস্তরের বাঙালিদের কাছে সংগঠনের সদস্য হওয়ার খবর পৌঁছে দিতে। আমরা চাচ্ছি সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে নির্বাচনের মাধ্যমে সংগঠনের কার্যকরী ও উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে দেওয়া যা আগামী ২১শে এপ্রিল ২০২৪ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে অটোয়া-গ্যাতিনোর পূর্ণ বয়স্ক বাংলাদেশি, বাংলাদেশি-কানাডিয়ান বাকাওভের যে কোন মেম্বার অংশ নিতে পারবেন। মেম্বার হওয়ার শেষ তারিখ ২৬শে মার্চ ২০২৪। আপনি নিজে বাকাওভের মেম্বার হোন, এবং অন্যকেও বাকাওভের মেম্বার হতে উৎসাহিত করুন। আমি অটোয়ার পাঠকদের অনুরোধ করবো এই লেখাটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকে বাকাওভের সদস্য হতে উৎসাহিত করুন। (বাকাওভের মেম্বার হওয়ার জন্য গুগল ফরম ও   QR কোড)

আমার এই লেখাটি অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে। লেখাতে অনেক কিছুই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা দিব্যচোখে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কি করবো। বাকাওভ আমার প্রিয় একটি সংগঠন এবং সব সময়ই বাকাওভ পুনর্গঠনের সাথে জড়িত ছিলাম। অনেককেই অনুরোধ করে বিভিন্ন সময় বাকাওভের মেম্বার করেছি, নির্বাচন করে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছি, এখনো করছি, ভবিষ্যতেও করবো। অনেকেই হয়তো বলবেন, কিছু দিন পরপর বাকাওভের এই অবস্থা কেন হয় তা আমি লিখছি না কেন? কি লিখবো? “পানিতে ছেদ মারলে যে হাঁটুতে পরে”, তবে এটুকু লিখবো যে, আমরা মাল্টিকালচারেল একটি দেশে বসবাস করি, এখানে সব অভিবাসীর জন্যে সমান সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা আছে। শুধু আপনাকে জানতে হবে আপনি কীভাবে আপনার অধিকার আদায় করে নিবেন। আমরা দেখছি আমাদেরই পরিচিত অনেক জাতি-গোষ্ঠী এইসব অধিকারের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে- শুধু আমরা ছাড়া! সবাই পারে, কিন্তু আমরা পারি না! আমরা পারি না কেন? (চলবে…)   

কবির চৌধুরী
২০/১/২০২৪
প্রকাশক, আশ্রম
অটোয়া, কানাডা