সুব্রত কুমার দাসের সাহিত্যভ্রমণ: জানতে ও জানাতে
ড. ফজলুল হক সৈকতঃ- সুব্রত কুমার দাস আমাকে কাছে টেনে নিয়েছেন কেবল সাহিত্য নিয়ে কিছু কাজ করি বলে। এটি আমার একেবারেই ব্যক্তিগত ধারণা। সুব্রত দা বলি তাঁকে আমি। কোমল মনের এই সুব্রত দা সহজভাবে নিজেকে মেলে ধরতে শিখেছেন। তাঁকে দেখতে দেখতে, বুঝতে বুঝতে জেনেছি শিল্প-সাহিত্যকে যাঁরা লালন করেন, তাঁরা সুব্রতর পরিজন। তিনি সাহিত্য পড়তে গিয়ে, পড়াতে গিয়ে হয়তো নিজেরই অজান্তে সাহিত্যভুবনের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছেন। আর বেরুতে পারেননি। তারপর সে ভুবনে ডুবতে তিনি ‘ঝিনুক থেকে মুক্তো কুড়ানোর কাজে’ নেমে পড়েছেন। এই ডুবে থাকা বা নেমে যাওয়া নেতিবাচক অর্থে নয়; তিনি চলতে চলতে জীবনের এমন এক অলিন্দে পৌঁছে গেছেন, যেখান থেকে জীবনকে নয় - জীবনের শোভা ও প্রভাকে অনুভব করা যায়। প্রাত্যহিক জীবনে ঘর-সংসারের পাশে শিল্পের সাধনা যে কঠিন, সেই ‘কঠিনেরে’ ভালোবেসেছেন সাহিত্যলগ্ন সুব্রত কুমার দাস। পাঠে, বিশ্লেষণে, পরিবেশনে, প্রচারে, সংগঠনে, প্রকাশে নিজের ভাবনাকে জনসম্পৃক্ত করে তোলার মতো একটি শক্ত পরিভ্রমণে নিয়োজিত রয়েছেন তিনি।
সুব্রতর সাহিত্যচর্চার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো কাজ হলো নতুনকে জানা। বিশেষত যে বিষয়গুলো সমকালে ঘটছে কিংবা আগের ঘটে-যাওয়া ঘটনাগুলো থেকে আলাদা কিছু প্রকাশ করতে পারছে - এসব বিষয়ে তাঁর ঝোঁক। প্রসঙ্গটি এলো সুব্রতর কথাসাহিত্যে যাদুবাস্তবতা ও অন্যান্য (২০০২) গ্রন্থটির কথা মনে পড়ায়। তাঁর এই গ্রন্থ বিষয়ে ‘কথাসাহিত্য বিবেচনায় ঘরোয়া মেজাজ’ শিরোনামে আমার একটি সমালোচনা ৫ ডিসেম্বর ২০০৩ তারিখে ঢাকা থেকে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বইটিতে বাংলাদেশে কমচর্চিত একটি তত্ত্ব সম্বন্ধে সরলভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তিনি। এটি হয়তো তিনি করে থাকতে পারেন অধ্যাপকীয় দায়িত্ববোধ থেকে। কিন্তু যে সমাজের লোকেরা ন্যাচারালিজম এবং রিয়েলিজমের তফাৎটুকুও বুঝে উঠতে সক্রিয় নন; অন্তত সে কষ্টটুকুও করতে চান না অলসতার কারণে, সে সমাজে পাঠককে যাদুবাস্তবার বিশ্লেষণ এবং বিশেষত তার নিজের ভাষায় রচিত সাহিত্যে এই বিশেষ তত্ত্বের প্রকাশ ও প্রভাব তুলে ধরা ও প্রচার করার চেষ্টা করা খুব সহজ কাজ নয়। সুব্রত এমনটা করতে পেরেছেন তাঁর অফুরন্ত নিষ্ঠার কারণে। কাজেই তিনি সমকালে একজন উদ্যোগী ও সাহসী সাহিত্য-বিশ্লেষক। যদিও তিনি এ গ্রন্থে বাংলাদেশের যাদুবাস্তবতার প্রবেশ ও প্রভাবকে ১৯৯০-এর দশকে ‘একটি নতুন ট্রেন্ড’ বলে বিবেচনা করেছেন; প্রসঙ্গত বাংলাদেশের সাহিত্যে যাদুবাস্তবতা বিষয়ে সৈয়দ শামসুল হকের একটি বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে: ‘মনে পড়ছে, রক্তগোলাপ লিখেছিলাম এক রেস্তোঁরায় বসে- সকাল থেকে একটানে প্রায় মধ্যরাত অব্ধি। আজকাল লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে যাদুবাস্তবতা বলে একটি ধারা সনাক্ত করা হয়। পেছনের দিকে তাকিয়ে যখন রক্তগোলাপ লেখাটি দেখি, তখন আবিষ্কার করে বিষ্মিত হই, ঘটনা-বিন্যাস ও কল্পনার ‘যাদু’ আমি সেই ১৯৬৩ সালেই ব্যবহার করেছিলাম, তবে, এই যাদু নির্মাণের সূত্রটি কিন্তু পেয়েছিলাম আমাদেরই রূপকথা ও ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে।... বাংলা সাহিত্যে এই যাদুবাস্তবতার নির্মাণ ছিল বহুশত বৎসর পূর্ব থেকেই।’ কিন্তু সুব্রত দা বিষয়টিকে বাজারের আলোচনায় এনেছিলেন সৎ-চিন্তাকে ধারণ করে; এবং এতে সমালোচক-পাঠক উপকৃত হয়েছেন। আবার, নজরুল বিষয়ে দশটি প্রবন্ধ (২০০৫) শীর্ষক বইতে সেই সুব্রতকে পাওয়া যায়, যিনি পুরাতনের পাটাতনে নতুনকে বিবেচনার সামনে আনতে চান। মাসিক কালি ও কলম (ঢাকা) পত্রিকায় এই বইটির পরিচিতি লিখেছিলাম আমি। দীর্ঘদিনের চর্চায় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেখার একটি বিশেষ ধারা; প্রচলিত ধারা - এর পাশাপাশি নজরুল বিষয়ে অন্যতর বিবেচনাগুলোকে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর অবস্থানকে তিনি পরিবেশন করতে চেয়েছেন। অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে সাহিত্য ও রাজনীতিকে কীভাবে নজরুল প্রভাবিত করেছেন, তা অনেকের জানা। কিন্তু নজরুলচর্চার সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনাগুলোকে খানিকটা নাড়া দিতে চেষ্টা করেছেন সুব্রত।
সাহিত্যযাত্রায় সুব্রতর প্রথম প্রেম সম্ভবত উপন্যাস। বাংলাদেশের উপন্যাস-বিষয়ক আলোচনাগুলোকে অন্তর্জালে জড়ো করতে তিনি ২০০৩ সালে একটি ওয়েবপেজ তৈরি করেন - এটিই সম্ভবত বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে প্রথম কোনো অনলাইন সেবার উদ্যোগ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ওই ওয়েবসাইটটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন-সমাবেশে উপস্থিত থাকার। যদিও যে-প্রত্যাশা নিয়ে এর অভিযাত্রা, পরবর্তীকালে এটির ক্রম-উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। কিন্তু পয়লা পদক্ষেপ হিশেবে এর ঐতিহাসিক মর্যাদার স্বীকৃতি তাঁকে দিতেই হবে। অবশ্য পরে তিনি কিছুটা ভিন্নভাবে নিজের সাহিত্য-ভাবনাকে সম্প্রসারিত করেছেন। এবং বিশেষত অভিবাসী হওয়ার ফলে তাঁর সাহিত্যচেতনায় দেশীয় (জন্মভূমি অর্থে) নিমগ্নতা কিছুটা অতিক্রম করে অভিবাসিত ঠিকানার (নতুন আবাসস্থল - কানাডা) প্রভাব পড়েছে। তখন তিনি কানাডার সাহিত্য নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কানাডার সাহিত্য : বিচ্ছিন্ন ভাবনা (২০১৯) তাঁর সেই প্রয়াসের ফসল। বহুসাংস্কৃতিক ও বহুজাতিক রাষ্ট্র কানাডার সাহিত্যচর্চার ‘একঝলক’ তুলে ধরেছেন তিনি গ্রন্থটিতে। সাহিত্যের বিশেষ-ব্যতিক্রমি ভুবনে ডুব দিয়ে তিনি অনুভব করেছেন: 'বিশ্বসাহিত্যের সকল ঐশ্বর্য্যকে কানাডীয় সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব।’ সুব্রতকে এবং তাঁর সাহিত্যজার্নিকে বুঝতে উৎস থেকে পরবাস (আলাপনে দেবাঞ্জনা মুখার্জি ভৌমিক, ২০২৩) গ্রন্থটি একবার পাতা উল্টে দেখা যেতে পারে। এখানে তিনি আলাপের ছলে নিজেকে জানতে ও জানাতে চেষ্টা করেছেন। বইটি পড়তে গিয়ে হয়তো মনে হতে পারে - বাংলাদেশের মাটি সুব্রতকে ধারণ করতে না পারলেও প্রবাসের বিপুল সুখ-সুবিধার ভেতরেও সুব্রত প্রিয় মাতৃভূমিকে ধারণ করে ফিরছেন।
সংগঠক হিশেবে সুব্রত দা চিন্তাশীল মানুষ। তিনি যখন ঢাকার ক্যামব্রিয়ান কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে, তখন - ২০০৯ সালে, কলেজের সহযোগিতায় ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ উপলক্ষে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করেন। কলেজ-শিক্ষার্থীদের সাহিত্যের একটি বিশেষ প্রবণতা - কবিতার চর্চা, পাঠ ও অনুশীলন বিষয়ে জানাতে তাঁর এই উদ্যোগ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, তখন (এখনও কি!) বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সাহিত্য বিভাগে (বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত, পালি প্রভৃতি ভাষা ও সাহিত্য-বিষয়ক বিভাগ) বিশ্ব কবিতা দিবস (২১ মার্চ) পালন শুরু হয়নি বললেই চলে। জাতীয় পত্রিকায় তখন আমি ‘বিশ্ব কবিতা দিবস : কবিতার প্রাসঙ্গিকতা’, ‘কবিতার পঠন-পাঠন ও বিশ্ব কবিতা দিবস’ প্রভৃতি শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছি। কবিতার পঠন-পাঠনে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞান-সম্বন্ধে সুব্রত দার আন্তরিকতার ছাপ ছিল সেই আয়োজনে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ করুণাময় গোস্বামী, প্রধান অতিথি ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী, বিশেষ অতিথি হিশেবে সে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে পারার আনন্দ আজও আমি বিপুলভাবে অনুভব করি। অনুষ্ঠানটি পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন ক্যামব্রিয়ান কলেজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লায়ন আবুল বাশার। সাহিত্যকে জানার এবং জানানোর যে প্রত্যয় লালন করেন সুব্রত, তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে ওই আলোচনাসভাটি।
![](https://ashrambd.com/uploads/news/extraimage/EIT_20240126143618.jpg)
সাহিত্য-প্রেমিক সুব্রত সম্ভবত এমন এক প্রজন্মের কথা কল্পনা করেন, যে-প্রজন্মের তরুণ ও সম্ভাবনাময় মানুষগুলো শিল্পের সমূহ শক্তিকে ধারণ করে আপন আপন পথচলার মত ও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারবে। নিজেকে দেখার, চারপাশকে অনুভব করার এবং যাপিত জীবনের জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে যে সাহিত্যও সহায়তা করতে পারে, তা বোধকরি সুব্রত উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি দেশ ছেড়েছেন কিন্তু সাহিত্যকে ত্যাগ করেননি। সাহিত্যকে সাথে নিয়ে ঘুরছেন পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে। জীবনকে অনুভব করছেন শিল্পের শোভায় এবং তিনি তাঁর জানা পথ বিষয়ে অপরকে জানাতে সবসময় তৎপর রয়েছেন শৈল্পিক বোধের তাড়নায়।
ড. ফজলুল হক সৈকত
ঢাকা, বাংলাদেশ
(ড. ফজলুল হক সৈকত: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, বাংলাদেশ; সংবাদ পাঠক, বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা; শিল্প-সাহিত্য বিশ্লেষক ও কলামলেখক।)
-
নিবন্ধ // মতামত
-
26-01-2024
-
-