অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
আশ্রম: একটি চেতনার নাম – অষ্টম পর্ব

কবির চৌধুরী, অটোয়াঃ  শীতের সময়। ছুটির দিন। যদিও হাতে আছে দু’সপ্তাহের জমানো কিছু এসাইনমেন্ট। তারপরেও তো ছুটি। তাই কম্বল মুড়ি দিয়ে সারাদিনই ঘুমানোর ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু ইচ্ছা করলেই কি হয়? সকাল ১০টার পর থেকে কয়েকটি ফোন আসে। সবার একই প্রশ্ন! আজকের লেখা কোথায়? ‘শনিবারের নিবন্ধ’ লিখেন নাই?” ভেরি  স্ট্রেঞ্জ! আমার লেখা নিয়ে কিছু মানুষের আগ্রহ আছে জানতাম! তবে এতটা তা জানতাম না! আমার এই সুহৃদ বন্ধুদের কথা শুনে বললাম, নানা কারণে ভীষণ ব্যস্ত। তাছাড়া লেখার মতো কোন বিষয়ও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই আগামী ২/৩ মাস কিছু লিখবো না বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার কথা শুনে উনারা বললেন, কতকিছু লেখার আছে! এই যেমন, বাংলাদেশের ইলেকশন, বাংলাদেশ সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে নিয়োগ, আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সাউথ আফ্রিকার মামলা, ট্রুডোর ইমিগ্রেশন পলিসি, শরিফাকাণ্ড, ইত্যাদি! এইসব না লিখতে চাইলে, আপনার প্রিয় সংগঠন ‘বাকাওভ’ নিয়ে লিখেন। একজন তো বলেই দিলেন, আপনার শনিবারের নিবন্ধের ষষ্ট পর্বে ড. মনজুর চৌধুরী আপনার কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন! এগুলোর উত্তর দিলেই-তো আপনার লেখা হয়ে যায়। আমার এই হিতাকাঙ্ক্ষী আরো বললেন যা-ই করেন না কেন, ‘শনিবারের নিবন্ধ’ লেখা বন্ধ করবেন না, শত ব্যস্ততার মাঝেও লেখাটি চালিয়ে যাবেন!
পরিচিত মানুষদের এই উৎসাহ আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বিশেষ করে অটোয়ার জনপ্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘এলাইভ এডুকেশনে’র প্রিন্সিপাল ড. মনজুর চৌধুরীর লেখা মন্তব্যটি। ড. মনজুর চৌধুরী সবসময়ই আমাকে অকুণ্ঠ সমর্থন করেন, উৎসাহ দেন। এই যেমন, আমার শনিবারের নিবন্ধটি পড়ে লেখাটি কেমন হলো তা জানাতে কুণ্ঠাবোধ করেননি! তাঁর এই উৎসাহ, অনুপ্রেরণা আমাদের মতো কিছু মানুষকে সবসময় ভাল কিছু করার জন্যে অনুপ্রাণিত করে। তাইতো শনিবারের নিবন্ধের ষষ্ট পর্বে করা ড. মনজুর চৌধুরীর বাস্তবতা নির্ভর মন্তব্যটি শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে কিছু লিখতে বাধ্য করেছে। ড. মনজুর ভাই লিখেছেন,

“আজিজ(কবির) ভাই,
অটোয়ায়, আমরা যারা জীবনের নোঙ্গর ফেলেছি তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের বাইরে যে একটি আত্মিক জীবন আছে তা নিয়ে আপনি ভাবেন তা আমাকে আপ্লুত করে। আপনি আমাদের মাটি, আমাদের সংস্কৃতি এবং আমাদের ইতিহাসের সাথে আমরা কিভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারি সামষ্টিকভাবে তার একটা বাহন হিসেবে ‘বাকাওভ’কে কিভাবে সজীবতায় ভরপুর করা যায়, তা নিয়ে অনেক ভাবছেন বলে আমার ধারনা। আমার কিছু অগোছালো চিন্তা ভাগ করতে চাই এখানে।
আমার মনে হয় আপনি সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছেন যে, অটোয়ায় আমাদের স্বদেশীদের দ্বারা গঠন করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সংঠন যার উদ্দেশ্য কোন না কোন ভাবে আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। আমি ব্যক্তিগতভাব সব উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানাই। আমি বৈচিত্র্যের মধ্যে অনুপ্রেরনা খুঁজি, সৃজনশীলতা শিখি। যে কোন সৃজনশীল উদ্যোগকে কার্যকরী এবং গ্রহণযোগী করতে হলে আমার মনে হয় কিছু অতি জরুরী ব্যাপারে প্রথমেই মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।
প্রথম প্রশ্ন হবে, কেন আমি এই উদ্যোগ নিচ্ছি? যাঁদের জন্য আমি এই উদ্যোগ নিচ্ছি, তা কি দরকার? সে কেন আমার উদ্যেগকে গ্রহণ করবে? তার, কি কি সুবিধা হবে আমার উদ্যোগকে গ্রহণ করে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, কিভাবে আমি আমার উদ্যোগগুলোকে বাস্তবায়িত করব? শেষ প্রশ্ন, কি এমন কিছু আমি করব যা তাঁকে আমার উদ্যোগের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট করবে?
Stephen Covey র একটা বিখ্যাত উক্তি আছে, “we begin with the end in mind”. আমরা কি নির্ধারন করেছি কোথায় এবং কত দূর যেতে চাই? আমার মনে হয় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা দরকার সর্বাগ্রে। আমি বিশ্বাস করি ‘বাকওভ’ যদি এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবে এবং তার ব্যতিক্রমধর্মীতাকে প্রতিফলিত করতে পারে, আপনার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হতে বাধ্য।
ধন্যবাদ।“

আমি জানি না মনজু ভাইয়ের উপরোল্লেখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর কী হবে? তাঁর উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। মনজু ভাইয়ের মতো আমিও ভাবি আসলে ‘বাকাওভ’ করার যৌক্তিকতা কতটুকু? মানুষ অন্য সংগঠন বাদ দিয়ে ‘বাকাওভ’ কেন করবে? আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। তাই সবকিছু সাধারণভাবেই ভাবি এবং গ্রহণ করি। প্রশ্ন যখন এই প্রবাসে আমাদের দ্বিতীয় আবাসস্থল বিনির্মাণের সন্ধিক্ষণ, তখন সেখানে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে, আমরা আমাদের আবাসভূমি কীভাবে নির্মাণ করছি। মানুষ সামাজিক। একজনের সাথে আরেকজন মিশবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে এই প্রবাসে, বিজাতীয় পরিবেশে এবং নব্য জাতীয়তাবাদের উন্মেষকালে। বর্তমান বিশ্বের উগ্র জাতীয়তাবাদের যাঁতাকলে প্রবাসে আমাদের মতো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় আজ হুমকির সম্মুখীন। কানাডা মাল্টিকালচারেল দেশ। এখানে সাংবিধানিকভাবে ছোটবড় সব জাতিগোষ্ঠীর অবাধ চলাফেরা নিশ্চিত। নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার লালন-পালন করার সুযোগ সবারই আছে এবং আমরা অনেকেই বিভিন্নভাবে তা করছি। এখানে কিন্তু একটি সংগঠনের বিরাট ভূমিকা থাকে। কোনো না কোনো ভাবে আমরা একত্রিত হচ্ছি। আমি কাউকেই বলি না, আপনি অন্য কিছু না করে শুধু ‘বাকাওভ’ করেন। কারণ, আমি জানি আমরা অনেকেই আমাদের নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল পরিচয়ের তোয়াক্কা না করে চাপিয়ে দেওয়া আত্মপরিচয়ে গর্ববোধ করি। আমি যাকে বলি ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’। আর এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস থেকে একমাত্র ‘বাকাওভ’ই আমাদেরকে আলোর পথ দেখাতে পারে। কারণ, ‘বাকাওভ’ নামের সাথেই জড়িয়ে আছে আমাদের পরিচয়- বাঙালিদের পরিচয়। এসব নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করা যায়। কিছু মানুষ তা করছেন ও সবসময়। মনজু ভাইয়ের মতো আমিও ভাবি ‘বাকাওভ’ কেন অটোয়ার সাধারণ বাঙালিদের কাছে গ্রহণযোগ্য সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। আমি নিজে বহু বছর থেকে ‘বাকাওভে’র সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। কিন্তু এই সমস্যার সঠিক কোনো কারণ এখনো খুঁজে পাইনি। অথবা পাইলেও তা বুঝতে পারিনি। এখানে মনজু ভাইয়ের মন্তব্যের রেশ ধরেই বলতে চাই, আমাদেরকে নতুন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ‘বাকাওভে’ নতুন প্রজন্মের সৃষ্টিশীল লোকজনদেরকে জড়িত করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে 'বাকাওভে'র সদস্য হতে হবে (বাকাওভের সদস্য হওয়ার লিংক এবং  QR কোড), নিজের ছেলেমেয়েদেরকে 'বাকাওভে'র সদস্য করতে হবে, তাদেরকে সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। যদি নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদেরকে সংগঠনের কথা বলা যায়, তাদেরকে সংগঠন পরিচালনায় সংযুক্ত করা যায় তাহলে হয়তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে জড়িত সংগঠন 'বাকাওভে'র মাধ্যমে আমরা অটোয়ায় একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি কমিউনিটি দেখতে পারি।

আমি সবসময়ই বলি আমাদের আরশীনগর অটোয়ায় সৃষ্টিশীল মানুষের অভাব নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদ পত্র প্রথম আলো অনলাইন ভার্সনে প্রচারিত ছোট একটি সংবাদ আমার কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। আমার মনে হয় অনেকেই খবরটি দেখেছেন। খবরটি ২৫শে জানুয়ারী ২০২৪, প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে ছাপা হয়েছে। সেখানেই দেখতে পাই বাংলাদেশি কানাডিয়ান গানের ব্যান্ড ‘অপার্থিব’ ২৬শে জানুয়ারী ২০২৪, আগরগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে বাংলাদেশে তাঁদের প্রথম কনসার্ট করতে যাচ্ছে। খবরটা দেখে আমি এতই আনন্দিত হই যে সংবাদটি আশ্রমে দিতে আগ্রহী হই। কিন্তু কপিরাইটের ভয়ে আমার ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। ‘অপার্থিব’ আমাদের শহরের একটি গানের ব্যান্ড। আমি তাঁদের অনেকগুলো প্রোগ্রাম দেখেছি। সালেহিন চৌধুরী উচ্ছ্বাস, দিশা এবং ব্যান্ডের অন্যান্য সদস্যদের সম্মোহনী পরিবেশনা আমাদেরকে আনন্দ দিতো, অনুপ্রাণিত করতো। আমার মনে আছে, শহরের এইসব শিল্পীদের দেখে মনে হতো, শহরে এতসব শিল্পী থাকতে আমরা কেন বাংলাদেশ থেকে শিল্পী আনি? আমরা কেন এইসব শিল্পীদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করি না? ইচ্ছা করলে তো ওদেরকে দিয়ে বাংলাদেশে প্রোগ্রাম করা যায়! কিন্তু তা না করে হাজার হাজার ডলার খরচ করে বাংলাদেশ থেকে শিল্পী আনি আর বড় বড় অনুষ্ঠান করি। এ নিয়ে শহরের অনেক সংগঠকের সাথে বাক-বিতন্ডতা হতো। একসময় তো আমি স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে ‘একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের’ সূচনা করি। উদ্দেশ্য একটাই। স্থানীয় শিল্পীদেরকে উৎসাহিত করা। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের প্রবাসের শিল্পীরা সুযোগ পেলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের যে কোনো শহরে অনুষ্ঠান করতে পারবে। এইসব উদ্যোগে 'বাকাওভে'র মত সংগঠন বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। খুশির খবর, 'অপার্থিব' আমাদের মত তথাকথিত পৃষ্টপোষক আর সংগঠক বা সংগঠনের অপেক্ষা না করে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে কানাডা থেকে মাতৃভূমি বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ট্যুরের ব্যবস্থা করেছে। ভাবতেই আনন্দে-গর্বে বুক ফুলে উঠে। আমাদের মতো কিছু স্বপ্নবিলাসী বাঙালির মনের আশা ‘অপার্থিব’ পূর্ণ করেছে। তাঁদের এই পরিবেশনা বাংলাদেশের বাইরের অন্যান্য শিল্পী এবং গানের ব্যান্ডগুলোকে উৎসাহিত করবে নিঃসন্দেহে। অভিনন্দন ‘অপার্থিব’।

মনজু ভাইয়ের উত্থাপিত প্রশ্ন নিয়ে আপনারাও আপনাদের মতামত দিতে পারেন। মনে রাখতে হবে, কানাডা আমাদের এবং আমাদের ছেলেমেয়েদের আবাসভূমি। হাজার চেষ্টা করলেও আর আমাদের বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া হবে না। এখানেই আমাদেরকে হাজার হাজার বছর কাটাতে হবে। একসময় এই ভূমিই হবে আমাদের ভূমি। তখন বাংলাদেশে আমরা বেড়াতে যাব। 'অপার্থিবে'র বাংলাদেশ ট্যুর সেই শুভযাত্রার মাইলফলক! জয়তু 'অপার্থিব'!!! (চলবে…) 

কবির চৌধুরী
২৭/১/২০২৪
প্রকাশক, আশ্রম
অটোয়া, কানাডা