অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
ভিন্ন জীবন (তেরো) - সুফিয়া ফারজানা

কবার কলিং বেল দিতেই গেইট খুলে দেয় লিলি বুয়া। উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করে, "কই গেছিলেন, আপা?" লিলির চোখেমুখে উৎকন্ঠা। ছুটির দিনগুলোতেও দুপুরে আসে লিলি। ফারিনের রান্নায় সাহায্য করে, সাবিত-সারাকে গোসল করিয়ে দেয়, ভাত খাওয়ায়, আরও টুকিটাকি অনেক কাজই করে। আজ রান্নাবান্না লিলিই করেছে। সাবিত-সারাকে গোসল করিয়ে, খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আজ ছুটির দিনে সারাদিন মা'কে না পেয়ে খুব কান্নাকাটি করেছে দুই ভাইবোনই।

ফারিন কিছু না বলে সোজা চলে আসে শাশুড়ির ঘরে। শাশুড়ি শুয়ে ছিলেন। কষ্ট করে উঠে বসলেন তাকে দেখে, "কোথায় গেছিলা, বউমা? ফোন অফ কেন? আমার তো বুক শুকিয়ে গেছে ভয়ে। সাবিত-সারা সারাদিন কান্না করে এইমাত্র ঘুমাইলো। হিমেল কিচ্ছু খায় নাই সারাদিন। আমি তো খালি আয়তুল কুরসী পড়তেছি। খালি বলতেছি, আল্লাহ্! কোথায় গেল মেয়েটা রাগ করে? তুমি তো জীবনে কখনও আমাকে না বলে কোথাও যাও না, মা। আজ কেন গেলা? কি হইছে, বলো তো।"

ফারিন কিছুই বলে না। ঘুমন্ত সাবিত আর সারার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় একটু। তারপর ফ্রেশ হয়ে চায়ের পানি বসায় চুলায়। লিলি সরিষার তেল, পিয়াজ, কাচামরিচ কুচি আর চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখে। শাশুড়িকে মুড়িমাখা আর চা দিয়ে ফারিন দুই কাপ চা নিয়ে যায় হিমেলের কাছে। হিমেল শুয়ে ছিল চুপচাপ। ফারিনের উপস্থিতি টের পেয়েও রুম থেকে বের হয়নি একবারও। এবার সে উঠে বসে। হাত ধরে পাশে বসায় ফারিনকে, "আই অ্যাম সরি, ফারিন। আমাকে মাফ করে দাও।"

ফারিন কিছু বলে না। চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দেয়।

হিমেল আরও কাছে টেনে নেয় ফারিনকে, চুলের খোঁপাটা খুলে দেয়। ফারিনের সুন্দর, লম্বা খোলা চুলে হাত বুলিয়ে দেয় অনেকক্ষণ,"আমার মাথাটা কেন জানি কাজ করে না, ফারিন। কি করতে কি করি, কি বলতে কি বলে ফেলি, নিজেও বুঝতে পারি না। আমাকে মাফ করে দাও, প্লিজ। আমি তো বাঁচতে পারবো না তোমাকে ছাড়া, তুমি তো জানো। তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার, বলো। কে আমাকে বুঝবে তোমার মত?"

ফারিন কি বলবে, ভেবে পায় না। তার চোখ ভিজে উঠছে আবার, সে বুঝতে পারে। 

হিমেল মুড়িমাখা আর চা খেতে খেতে বলে,"চলো, সবাই মিলে একটু ঘুরে আসি কোথাও। গ্রামে যাওয়া হয় না অনেকদিন। চলো, তোমাদের বাড়ি যাই। বাবা-মা কে দেখে আসি, চলো। আগে থেকে কিছু বলবো না। হঠাৎ গিয়ে সারপ্রাইজ দিবো। কাল রাতের ট্রেনে চলে যাই, চলো।"

"আমার অফিস? সাবিত আর সারার স্কুল?"

"আরে ধ্যাত, দুই-তিন দিনে কিছু হবে না। তুমি দুই দিন ছুটি নাও। সাবিত-সারার মিসকে ফোনে বলে দাও, দুই দিন স্কুলে যাবে না ওরা।"

ঠিক এই সময়ে সারা ছুটে আসে ঘুম ভেঙে। লাফিয়ে কোলে উঠে পরে ফারিনের। চুপচাপ গলা জড়িয়ে কাঁদতে থাকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে। এই মেয়েটা একদম ওর বাবার মত। এত ইমোশনাল! আর এত চাপা স্বভাবের! ওর কষ্ট বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তেমনি ওর ভালবাসাও বুঝতে পারে না কেউ। লিলিও আসে কিছুক্ষণ পর সাবিতকে কোলে নিয়ে। সাবিত চোখ বড় বড় করে বলে, "মা, সারা আপু অনেক জেদ করেছে, ভাত নষ্ট করেছে। আমি কিন্তু সব ভাত খেয়েছি, তাই না, লিলি আন্টি?"

লিলি হাসে। ফারিন বলে, "তুমি তো লক্ষী ছেলে, সোনা বাবা আমার।"

ফারিনের হঠাৎ মনে হল, এই সংসার ছেড়ে সে চিরদিনের মত চলে যেতে চেয়েছিল আজ। এই যে ভালবাসা, এই যে অদৃশ্য বন্ধন, ছোট ছোট সুখদুঃখ, এই যে মান-অভিমান, এর নামই তো সংসার, এর নামই তো জীবন। এই অতি পরিচিত, দুঃখকষ্টে ভরা সংসারটা কত আপন, কত প্রিয়! এই মায়া কাটানো কি আদৌ সম্ভব এক জীবনে???(চলবে)

সুফিয়া ফারজানা
ঢাকা, বাংলাদেশ