অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
কফি - তানিয়া নাসরীন

প্রায় দশ বছর পর দেশে আসা। দশ বছর অনেকটা বেশি সময় কিনা ঠিক বুঝতে পারছি না। কারণ প্রবাস জীবনে নানা চড়াই উৎরাই পেরোতে কখন দশ বছর পার হয়েছে বুঝিনি। ছোটবেলায় জীবন অনেক দীর্ঘ মনে হতো। এক একটা দিন অনুভব করতে পারতাম। এই বড় বেলায় এসে দিনগুলো কেমন করে কেটে যায় ঠিক বুঝি না। 

বাংলাদেশের বাতাসে এখন শরৎ আর কাশফুলের গন্ধ। আর পূজোর। হেমন্ত আসি আসি করছে। বাতাসে হিম হিম অনুভব। ঢাকা থেকে ফিরলে আমি আর দীপাণ্বিতা ভোরে হাঁটতে চলে যেতাম ভৈরব-এর পাড়ে। বাতাসে থাকতো হেমন্তের আগমনী বার্তা আর জলের গন্ধ। কী অদ্ভুত মাদকতাময় জীবন! কী প্রেরণাদাত্রী জীবন! অথচ কী সহজে এক মুহূর্তে সব ছেড়ে এলাম।

আহ দীপাণ্বিতা! 

শেষবার এরকম সময়েই দেখেছিলাম তাকে। পূজোর মণ্ডপে। পরনে ঢাকাই শাড়ি, চোখে কাজল। ঠোঁটে স্মিত হাসি। শেষ দেখা, অথচ সে জানতো না। পারিনি বলতে, পালিয়েই এসেছিলাম এক রকম। তাকে ছেড়ে, বাবা-মা, বোন সবাইকে ছেড়ে। পাগলি মারিয়াকে ছেড়ে। দশ বছর কারো সাথে যোগাযোগ করিনি। গোঁয়ারের মতো ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গেলাম ইটালি। সেখান থেকে স্পেন পরে ফ্রান্স। সবশেষে কানাডায় থেমেছি। এতদিন সময় হয়নি, সময় হলো যখন বুঝলাম বুড়ো হয়েছি। ফোন করলাম দেশে। বাবা-মা আর নেই। আপারাও খুলনায় আর থাকে না। মারিয়ার বিয়ে হয়েছে। 

মারিয়া আমার বোনঝি। খুলনায় একসাথেই থাকতাম আমরা। দশ বছর আগে সে পঞ্চদশী ছিলো। মারিয়া আমার দেখা সবচেয়ে সহজ মেয়ে। মারিয়া উচ্ছ্বল কিশোরী। আমাদের গুরুগম্ভীর পরিবারটাকে সে হাসির তুড়িতেই উড়িয়ে দিত। মারিয়া কবিতা পড়তো, নাটকের আসর জমাতো। আমি দূর থেকে দেখতাম ওকে। আমার অমন রাশভারী বাবাও কেমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতো তার কাছে। বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় স্মৃতি ছাড়াও কেবল ওর একটা ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। কী যে অভিমান আমার!

দশ বছর পর যখন মারিয়ার গলা শুনলাম ফোনে, আমার গলায় কী যেন দলা পাকিয়ে এলো। মনে হলো ভুল করেছি পালিয়ে এসে, ভুল করেছি সবাইকে ছেড়ে এসে। তখনো জানতাম না দেশে ফিরবো। মারিয়া ফোন ধরেই বললো, ছোটমামা, কবে আসবে তুমি? তখনই ঠিক করলাম, ফিরবো। 

তাই দশ বছর পরে ফেরা। অনেক বদল রাস্তা-ঘাটে। ঢাকা শহর চেনাই যায় না। কে জানে আমার গ্রামও চিনব না। অবশ্য যত অচেনা ততই ভালো। অন্তত আমার জন্য। কী হবে চিনে আর। 

দশ বছর আগে দীপাণ্বিতা ছিলো আমার জীবনে। দীপান্বিতা সনাতন ধর্মের। আর আমি আধুনিক! আমার অতি আধুনিক বাবা-মা মেনে নেয়নি আমাদের। নিজের প্রভাব খাটিয়ে ওদের দেশ ছাড়া করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। প্রেম আগে নাকি অস্তিত্ব? দীপকে কোন পরীক্ষায় ফেলতে আমি চাইনি। কারো দীর্ঘশ্বাসের বদলে কি সুখ আসে?

মনে করতে চাই না, বার বার তবু মনে পড়ে। আমি আসলে ভুলতেও চাইনি কখনো। আপার বাসায় যখন পৌঁছালাম, বুঝলাম কিছুই ভুলিনি, ভোলা যায় না। আপার গায়ের গন্ধ, আপার গলার স্বরের মায়া, সব আছে সে রকমই।

শুনলাম, মারিয়া আসবে বিকেলে, ওর একটা পরীক্ষার ডিউটি পড়েছে। ছোটমামার জন্য সে দুই দিন ছুটিও নিয়েছে। আমি হাসলাম, পাগলিটাও নিশ্চয়ই সেই রকম আছে। আপাকে বললাম, ওর জন্য সারপ্রাইজ আছে, তোমাকেও বলা যাবে না। 

দুপুরে খাওয়ার পর দুমিনিট শুয়েছি কেবল, সোরগোলে বুঝলাম মারিয়া চলে এসেছে। আমাকে দেখে মুখ গোমড়া করে বললো, এমন একমাথা পাকাচুল আর গোলগাল ভুড়ি নিয়ে চলে এলে? কোথায় ভাবলাম তুমি আরো স্মার্ট হয়েছো। 

হেসেই উত্তর দিলাম, বুড়ো হয়ে গিয়েছি রে মা।

- তুমি বুড়ো? কী যে বলো না ছোটমামা! এই, তুমি নাকি কী সারপ্রাইজ গিফট এনেছো আমার জন্য? মাকেও দেখাও নি?

আমি বেশ তোড়জোড় করেই লাগেজ খুলতে বসলাম। আসলে, এমন কিছু আনাও হয়নি। দেবার মানুষও তো এই কজনাই। চকলেট এনেছিলাম কয়েক রকমের। মারিয়ার জন্য একটা কিন্ডলে বুক রিডার। ওর জামাইয়ের জন্য এটা সেটা। এই দেখেই সে মহা খুশি। আর মারিয়ার সারপ্রাইজ গিফটটা প্যাকেটে-এ মুড়ে আলাদা করে এনেছিলাম। প্যাকেটটা তুলে দিলাম ওর হাতে। 

- ও বাবা! অতি স্পেশাল কিছু মনে হচ্ছে?

- খুলেই দেখ না।

মারিয়া যত্ন করে প্যাকেট খুলতে বসলো। খোলার পরে ভেতরের বস্তু দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।

আমি বলতে থাকলাম, আমি খুঁজে খুঁজে স্পেশাল সব ফ্লেভারের কফি এনেছি তোর জন্য। এখন মন ভরে খাবি। এই দ্যাখ, এই প্যাকেটের কফির গন্ধটা শুঁকে দ্যাখ, কী অসাধারণ!

ওর নাকের কাছে প্যাকেটটা ধরতেই মারিয়া সব ফেলে ছুটে বাথরুমে গেলো। পেছনে ছুটলো আপা। আমি কী করব বুঝতে না পেরে বোকার মতো বসে রইলাম। বসে থেকেই শুনতে পেলাম মারিয়া বমি করছে।

পরবর্তী একঘন্টায় মারিয়া দশ-বারোবারের মত বমি করলো, কাঁদতে কাঁদতে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো হয়ে গেলো। ওর স্বামীকে জরুরি ফোন করে আনানো হলো। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে অষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ানো গেলো যখন, তখন রাত দশটা। পুরো সময়টা আমি ওদের থেকে আলাদা ছিলাম। আমাকে দেখলেই মারিয়া আরো বেশি অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো। বিদ্ধস্ত আপা-দুলাভাই বাসায় এলেন আরো পরে, আমাকে খেয়ে শুয়ে পড়তে বললেন। 

আপা রাতে ঘুমাননি বোঝা গেলো। খুব ভোরে, আমি তখন বারান্দায়, আপা দুকাপ চা নিয়ে এলেন আমার রুমে। চোখে রাত জাগার ক্লান্তি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তোকে কীভাবে সব বলব বুঝতে পারছি না।

আমি কিছু না বলে চায়ে চুমুক দিলাম। বুঝতে পারছি আপা গুছিয়ে নিতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। 

কিছুক্ষণ পরে আপা আবার বললেন, তোর এক বন্ধু ছিলো গ্রামে সুশোভন, মনে আছে?

আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, মনে থাকবে না কেন?

- মারিয়া আর ওর বন্ধুরা ওর কাছে ব্যাচে অংক করতো।

- আপা, আমিই তো ওকে বলে ব্যাচ করে দিয়েছিলাম। তোমার মনে নেই?

- ওহ, তাই! হবে হয়তো! 

আপা আবার চুপ। অন্যমনষ্ক। এবার আমি উঠে গিয়ে আপার পায়ের কাছে বসলাম। হাতদুটো ধরে বললাম, কী হয়েছে আপা? তুমি আমাকেও বলতে পারছো না? এবার আপা কেঁপে উঠলেন। আমি জড়িয়ে ধরে রাখলাম তাঁকে। একটু কাঁদুক বেচারি।

আরো বেশ কিছু সময় পর। আপা একটু স্বাভাবিক হয়ে বলতে লাগলেন, সুশোভন ভালোই পড়াতো। মারিয়ারা আটজন পড়তো। একদিন সকালে এইচএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে আগে মারিয়া কলেজে যাবে বলে পড়া শেষ না করেই বের হতে চাচ্ছিল। তখন সুশোভন বলে যে সেও কলেজে যাবে, তাই একটু অপেক্ষা করলে মারিয়াকে সে কলেজে নামিয়ে দেবে। 

- তুই তো মারিয়াকে চিনিস, সে তো বসে থাকার মেয়ে না। সুশোভনকে তো সে মামাই ডাকতো। মারিয়া তখন বলেছে, মামা আমি এখনই যাবো, কলেজে যাওয়ার আগে এককাপ কফি খেতেই হবে, আজ আমার কফি খাওয়া হয়নি।

এটুকু বলে আপা আবার চোখ মুছলেন। বললেন, তুই তো জানিসই কফি নিয়ে ওর পাগলামির কথা। আমি মাথা নাড়লাম। মারিয়া আসলেই কফি নিয়ে পাগলামী করত। আর আমাদেরও পাগল করে ছাড়তো। ওর মা বেশি কফি খেতে দিতো না। কিন্তু দিনে এককাপ কফি তার চাই-ই। কফি নিয়ে তার বাড়াবাড়ি চেনাজানা অনেকেই জানতো। আর সে কী আয়োজন কফি খাওয়ার! স্পেশাল কাপ, কফি পট, মিল্ক পট, ট্রে- সে এলাহী ব্যাপার। আর কত রকম ধরনও জানতো কফির। আত্মীয় স্বজনদের কেউ দেশের বাইরে গেলে তার একটাই আবদার থাকতো, স্পেশাল ফ্লেভারের কফি আনার জন্য। আমি তো সেসব ভেবেই ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন আনকমন ফ্লেভারের কফি আনলাম তার জন্য। অথচ...

আপা আবার বলে লাগলেন, সুশোভন তখন তাকে বলেছে যে নতুন এক ধরনের কফি আছে তার কাছে, মারিয়াকে সে বানিয়ে খাওয়াবে। মারিয়া তখনও জানে না সেদিন বাড়িতে কেউ নেই। বন্ধুরা পড়া শেষে চলে গেলে সুশোভন তাকে বসিয়ে রেখে কফি বানাতে যায়। মারিয়া কফির কাপে চুমুকও দিয়েছিলো। হঠাৎ সুশোভন তাকে জড়িয়ে ধরে আর জোর করে চুমু খায়। মারিয়া প্রথমে ভ্যাবাচ্যকা খেলেও পরে ছাড়া পাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি শুরু করে। কিন্তু সুশোভন ছাড়েনি, মারিয়াকে মারধোর করেছে, জোর করেছে। জোর করে সোফায় শুইয়ে দিয়েছে। ততক্ষণে মারিয়ার জামাটাও ছিঁড়ে ফেলেছে সুশোভন। তখন হঠাৎ শেফালী আর ইভা, মারিয়ার দুই বন্ধু বেল বাজায়, তারা নাকি কী খাতা ফেলে গেছে। বেলের শব্দে সুশোভন একটু চমকে যেতেই মারিয়া ওকে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে বাইরে।

এটুকু বলে থেমে যান আপা। আমি বুঝতে চেষ্টা করি ঘটনাটা। আমার বিশ্বাস হয় না। সুশোভন!!! মারিয়ার যখন জন্ম হয় হাসপাতালে আমার সাথে সুশোভনও অপেক্ষা করেছে। বাজার থেকে ফেরার সময় কখনো কখনো সুশোভনেরও ঘাড়ে চড়ে এসেছে মারিয়া। আমার মতো সেও মারিয়ার কাছে মামাই ছিলো। সেই সুশোভন!!!

আমার রাগ হয় না সুশোভনের উপর। কেমন যেন মায়া হয়। আপাকে বলি, আপা তারপর?

- শেফালীরাই মারিয়াকে বাসায় দিয়ে গিয়েছিলো। মারিয়া রাস্তায় বমি করেছিলো কয়েকবার। যতবার বমি করে ততবার নাকি কফির গন্ধ পায়। কফি আর সে সহ্য করতে পারে না রে। 

- তোমরা সুশোভনের বিরুদ্ধে কোন কিছু করলে না?

- কী করতাম বল? কোন প্রমাণ তো নেই। ওর বাবা ওকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। এখানেই ভর্তি করলেন। অসুস্থ ছিলো অনেকদিন। ওই বছর পরীক্ষা দিতে পারেনি। আমরা ওকে নিয়ে আর কখনোই গ্রামে যাইনি। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়েছে, স্বাভাবিক হয়েছে।

- তোমরা ঢাকায় এলে আর সুশোভন? সে বহাল তবিয়তে গ্রামেই থেকে গেলো? 

- হ্যাঁ। তুই তো বিষয় সম্পত্তির কোন খবর জানিস না। আমাদের বাড়িটা সুশোভনের বাবা কিনে নিয়েছেন। ওরা এখন অনেক প্রভাবশালী এলাকায়।

আমাদের বাড়ি! বাহ! তাহলে তো খোঁজা সহজ হয়ে গেলো আমার জন্য। যদিও গ্রামে যাবার কোনো পরিকল্পনা আমার ছিলো না, কিন্তু এখন তো যেতেই হবে। আপাকে বলিনি কিছু। মারিয়া এখনো হাসপাতালে। 

দশ বছর পর আবার পা রেখেছি গ্রামে। আমার গ্রাম। আমার প্রিয় ভৈরবের গন্ধমাখা গ্রাম। আমার আর দীপাণ্বিতার গ্রাম। কেন জানি না, মারিয়ার জন্য আনা কফিগুলো সাথে নিয়ে এসেছি। কী করব জানি না, নিতে ইচ্ছে হলো তাই এনেছি। 

এলোমেলো কিছুক্ষণ হাঁটলাম। স্মৃতিময় পথগুলোতে। ভৈরবের ধারে। মনটাকে শক্ত করে পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে। আমাদের বাড়ি অথচ আমাদের নয়! বেল বাজানোর বেশ কিছু পর শুনলাম ভেতর থেকে কেউ বলছেন, বৌমা দ্যাখো তো কে এলো?

মাসীমার গলা চিনতে ভুল হলো না। ভুল হলো না যিনি দরজা খুলে দিলেন তাকে চিনতেও। হ্যাঁ, তার পরনে ঢাকাই শাড়ি, সিঁথিতে সিঁদুর! আমার দীপাণ্বিতা!

দশ বছর পরে আমি আবার পালালাম।

তানিয়া নাসরীন
ঢাকা, বাংলাদেশ