অটোয়া, শুক্রবার ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
বাদাইম্যা (১) - কবির চৌধুরী

কাঁপতে কাঁপতে, হাঁপাতে হাঁপাতে - ঠিক দৌড় না আবার হাঁটাও না - এভাবেই শীতের বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিনের মত হানিফ তার নিয়মিত আড্ডার জায়গা টিমহরটন্সে এসে পৌঁছেছে। ভিতরটা ফাঁকা। অন্যান্য দিনের বিকেলের মত পাগলাভিড় আজ নেই। হাতেগোনা কয়েকজন নারীপুরুষ এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। এরা সবাই টিমহরটন্সের নিয়মিত কাস্টমার। হাত দুটো কচলাতে কচলাতে ভিতরে ঢুকে হানিফ বরাবরের মত টিমহরটন্সের শেষ মাথায় না গিয়ে সরাসরি কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো মেয়েটির সামনে চলে যায়, 
-হ্যালো, হাউ আর ইউ? ইটস কোল্ড!       
-ও ইয়া। স্মল ডাবল ডাবল?   
- নো। টুডে আই উইল হ্যাভ মিডিয়াম ডাবল ডাবল। প্লিজ। টায়ার্ড?  
-বোরিং; হোয়ার ইজ ইয়োর ফ্রেন্ড টুডে?                      

শীতের বিকেল, বাইরে মানুষের চলাচল নাই বললেই চলে, মাঝে মধ্যে রাস্তাঘাটের স্নো পরিস্কারের গাড়ি আর কিছু প্রাইভেট কার ও পাবলিক চলাচলের জন্য সরকারী বাসগুলো রাস্তা দিয়ে আসা যাওয়া করছে। ফেব্রুয়ারি মাসের এই সময়টা মানুষের কাছে খুবই বিরক্তিকর। অন্তত হানিফের কাছে। যেমন ঠান্ডা তেমন স্নো। প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হয় না। কেউ বের না হলে হানিফের কিছু যায় আসে না। প্রতিদিন-ই সে বের হয়। আজও সে বের হয়েছে - প্রয়োজনীয় কোন কাজের জন্য হানিফ শীতের এই বিকেলে হাটুসমান স্নো ভাঙতে ঘর থেকে বের হয়নি- বের হয়েছে নিতান্ত নিজের অভ্যাসের কারণে। টিমহরটন্সের আড্ডায় যোগ দিতে।

বহুদিন পর আজ একা একা হানিফ এই সময়টাতে টিমহরটন্সের কর্ণারের এই টেবিলটাতে বসে কফির কাপে চুমুক দিয়ে শীতের জড়তা কাটাতে চেষ্টা করছে। এসময়ের আড্ডার সাথী তুহিন আজ টিমহরটন্সে আসেনি। গতসপ্তাহে বাংলাদেশে চলে গেছে। তুহিন তার চেয়ে বছর দশেকের ছোট হবে। কয়েক বছর আগে উন্নত জীবনের আশায় কানাডায় এসেছিল। আজ থেকে ৫/৬ বছর আগে হানিফ অটোয়ার একটি বাঙালি মালিকাধীন একটি রেস্টুরেন্টে বেড়াতে গিয়েছিল, ঠিক বেড়াতে নয়- পত্রিকার জন্য একটি লেখা আনতে। রেস্টুরেন্টের মালিক একজন লেখক। আশির দশকের স্বনামধন্য লেখক। বাংলাদেশের অনেকেই তাঁকে চিনেন। নাম হোসেন মুনীর। তাঁর মাধ্যমেই তুহিনের সাথে হানিফের পরিচয়।           
-আরে হানিফ ভাই, আসেন আসেন। এই ভদ্রলোকের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দেই। আপনার কাজে লাগবে। 
-তুহিন ভাই, উনি আমাদের শহরের একমাত্র ‘বাংলা পত্রিকা’ র সম্পাদক। হানিফ উল্ল্যা ভাই।    
-স্লামালাইকুম ভাই। আমি হানিফ।
-আমি তুহিন। তুহিনুর ইসলাম।      
-সম্পাদক সাহেব, উনি একজন কবি। লেখালেখিতে ভাল হাত আছে।    

সবেমাত্র বাংলাদেশে নির্বাচন শেষ হয়েছে। সেনাসমর্থিত সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট জয়লাভ করে সরকার গঠন করেছে। পাঁচ বছর পর দল ক্ষমতায় এসেছে। এর জন্য আওয়ামী লীগকে যথেষ্ট আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে। হানিফ জানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আন্দোলন করে ক্ষমতায় আসাটা কতটুকু কস্টসাধ্য ব্যাপার। ক্ষমতাসীন দল বিএনপি ও জামাত ক্ষমতায় থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলনের মুখে নির্দলীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। প্রবাসে থেকে হানিফ খুব নিবিড়ভাবে সেই গণআন্দোলন লক্ষ্য করেছে। সে দেখেছে জননেত্রী শেখ হাসিনা কিভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রবল বাধার মুখে আন্দোলন করে জয়লাভ করেছেন। সেই জয়লাভের রেশ সুদূর কানাডায় এসে পৌঁছেছে। স্থানীয় আওয়ামীলীগ কর্মী সমর্থকরা খুব খুশি। খুশি হওয়ারই কথা। 
কলেজ জীবনে জাসদ ছাত্রলীগ করলেও তাঁর ছাত্রজীবনের প্রথম দল ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। হাইস্কুলে পড়াকালীন সময়েই হানিফ ছাত্রলীগের সদস্য হয়েছিল। কচিমনের গভীরে জন্ম নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালবাসা। তাই তো যখন অটোয়াতে ২০০৯ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সাথে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। হানিফ তখনই অটোয়ায় বাংলা পত্রিকার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝতে পারে। কারণ, অনুষ্ঠানের পরে শোক দিবসের সংবাদ ছাপাতে বিভিন্ন পত্রিকার শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। কানাডার অনেক সংবাদ পত্র তখন সংবাদটি ছাপতে অনীহা প্রকাশ করে। 
ছোট এই শহর অটোয়াতে তখন প্রায় ৪হাজার বাংলাদেশির বসবাস। এখানে উত্তর আমেরিকার পাঠকনন্দিত লেখক মীজান রহমানসহ অনেক কবি সাহিত্যিকের বসবাস। কিন্তু এই শহরে বাংলা কোন পত্রিকা নেই। অথচ পাশের শহর মন্ট্রিয়েল আর টরেন্টো থেকে প্রতি সপ্তাহেই অনকগুলো সাপ্তাহিক প্রকাশিত হচ্ছে। অনেক কিছুর মত এই বিষয়টিও হানিফকে ভাবিয়ে তুলে।    

১৯৮৭ সাল। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়। মন্ট্রিয়াল এয়ারপোর্টে ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজের ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। হানিফ এবং কদ্দুস ভয়ে কাতর। কি হবে জানে না। বাংলাদেশ থেকে কানাডায় আসার পথে অনেক কিছুর সাথে সাহসটাও তারা হারিয়ে ফেলেছে। প্রায় ৪ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে হানিফ যখন ইমিগ্রেশন থেকে বের হয় তখন মনে হয় সে একবারে কাহিল। ভাগ্যিস, ইংরেজি ভাল জানে না বলে ইমিগ্রেশন অফিসার একজন দোভাষীর ব্যবস্থা করেছিল।

সালাম ভাই তাদেরকে এয়ারপোর্ট থেকে নিতে এসেছেন। সালাম ভাই কদ্দুসের বড় ভাই। দেশে থাকতেই তাঁর সাথে পরিচয় ছিল।  
-হানিফ কিথারে ভাই, ভালভাবে আইছো তো? 
-জ্বী অয় ভাইসাব। আল্লায় আইনছন। যে ডর ডরাইছলাম। বাবারে বাবা কত সময় ভিতরে রাখছে।
-কদ্দুস কই? আইতে পারছে তো?   
-জ্বী অয় ভাইসাব। কদ্দুস আইছে। ভিতরে ডকুমেন্টে সাইন করের।

কিছু সময় পর কদ্দুস ইমিগ্রেশন থেকে বের হলে সালাম ভাই তাদেরকে এয়ারপোর্টের ভিতরে একটি দোকানের সামনে নিয়ে যান। জিজ্ঞাসা করেন-
-কিথা খাইতায় 
কদ্দুস বলে -বারগার খাবো।
হানিফ বলে -যেচাতা আনিলাউকা।  

খাবার দাবারের পর হানিফ এবং কদ্দুস সালাম ভাইয়ের সাথে এয়ারপোর্টের বাইরে আসতে চাইলে উনি বলেন, 
-তোমরা ভিতরে থাকো, বাইরে আইও না। আমি গাড়ী থাকি তোমাদের জন্য জ্যাকেট লইয়া আই।    

কিছুক্ষণ পর সালাম ভাই দুটো ঢাউস মার্কা জ্যাকেট এনে হানিফ আর কদ্দুসকে দিতে দিতে বলেন,  
-জ্যাকেটটা ভালভাবে পিন্দো। ভালা ঠান্ডা পড়ছে। এইদেশে কোন ভাবেই ঠান্ডা লাগাইও না। একবার ঠান্ডা লাগলেই হইল- সারাজীবন কস্ট করবায়। 
কথা বলতে বলতে সালাম ভাই তাদেরকে নিয়ে গাড়ীতে উঠে পড়েন। মধ্যরাতের নিকষ কালো অন্ধকারে ঝাঁকঝাঁক জোনাকী পোকার আস্তরণ অতিক্রম করে হানিফদের গাড়ী চলতে থাকে সামনে- নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে... চলবে।

কবির চৌধুরী
অটোয়া, কানাডা।