অটোয়া, শনিবার ২১ জুন, ২০২৫
ভালোবাসার লাল গোলাপ - সুলতানা শিরীন সাজি

মানুষ যখন ভালোবাসার জন্য গোলাপকে বেশি পছন্দ করছে। আমার তখন শুধু গন্ধরাজকেই মনে পড়ছে। হলিফ্যামিলি হাসপাতালের ডক্টরস কোয়ার্টার এর দিকে যাবার সময় হাতের বায়ের বিশাল যে কড়ই গাছটা তার পাশেই ছিল গাছটা।

ভালোবাসার জন্য ফুলের চেয়ে সবুজ পাতাকে আমার বেশি পছন্দ।
পাতার সবুজে ক্লোরোফিল থাকে। সবুজের অবুঝ টান থাকে।

আমাদের মেয়েবেলায় যে চুড়িওয়ালাটা আসতো রাজ্যের অবাক করা জিনিসপত্র নিয়ে। কাঁচওয়ালা সেই বাক্সের ডালা খুললে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম।  

লালমনিরহাট এ সাহেবপাড়ার এল চার-এর, পাশের বাসার খালাম্মা কতকিছু যে কিনতেন। সবকিছুর নাম জানতাম না। আমার শুধু বাহারী রেশমী চুড়ির দিকে চোখ আটকে থাকতো। পাশের বাসার উপরতলায় থাকা এক ভাবী হাত ধরে বড় ছেলেটাকে আর ছোটটাকে কোলে নিয়ে আসতো। আর মোড়ায় বসে একের পর এক চুড়ি পড়তো। চুড়িওয়ালা ম্যাজিকের মতন উনার শক্ত হাত টিপে টিপে চুড়ি পড়াতেন। কয়েকটা চুড়ি মটমট করে ভেঙে ও যেতো। আমি চুড়ির ভাঙা টুকরোগুলো কুড়িয়ে রাখতাম।

একদিন মায়ের কি যেনো কি হলো। না চাইতেই দুই ডজন চুড়ি কিনে দিলেন আমাকে। আমি সেদিন রিনরিন শব্দ হয়ে সাড়াবাড়ি ঘুরে ছিলাম। জুতার বাক্সে যেখানে পুতুল ঘুমাতো, রাতের বেলা সেইখানে খুলে রাখতাম চুড়িগুলো। মাঝে মাঝে চুড়িগুলো পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাতদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। হাত নাকি চুড়ি। আমার কৈশোর এর সেইসব দিন এত কম ছিলো যে, মনেহয় পলকেই যেনো চলে গেছে!

সেই ফেরিওয়ালা কতদিন ডেকে গেছে এরপর। কই আর তেমন ইচ্ছেতো করেনি কখনো! আমি তখন শরৎ চন্দ্র পড়ছি। আমি তখন পরিণীতা পড়ে ললিতার মত ঘোরে ডুবে আছি। আমি তখন প্রথম শাড়ি পড়ে গোধূলীর রঙ মেখে জন্মদিনের উৎসব করছি।

সবাই আমার জন্য বই নিয়ে এসেছিল একবার। তখন বই ছাড়া আমরা কেউ কাউকে কোন উপহার দেইনি কখনো। উপহারের তালিকা বেড়েছে আরো অনেক পরে। মাঝে মাঝে কড়ি বা হাতির দাঁতের মালা কেউ উপহার দিলে নিজেকে অন্যরকম সুখি মনে হতো।

প্রথম যেবার ক্যাসেট উপহার পেয়েছিলাম। মান্নাদে! শুনতে শুনতে ফিতাগুলো মাঝে মাঝে জড়াজড়ি হয়ে যেতো। আমাদের ন্যাশনাল প্যানাসনিক সেই ক্যাসেট প্লেয়ারটা থেকে আস্তে করে বের করে আবার পেন্সিল দিয়ে ঠিক করতাম।

"সুন্দরী গো দোহাই দোহাই মান কোরনা।", "ললিতাগো ওকে আজ চলে যেতে বলনা", "কি দেখলে তুমি আমাতে"," এ নদী এমন নদী" এমন কত গান। " জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা মতি খসে পড়েছে", এই গানটা শুনলে মনে হতো, আমি একটা সাদা ছেড়া পুঁতির মালা হাত এ বসে আছি। এই ক্যাসেটটার অদ্ভুত এক মায়াও ছিল। আমি গভীর ঘুমে থাকলে এই ক্যাসেট কেউ বাজালে ঘুম ভেঙে যেতো!

ভালোবাসা তখন বুকের ভিতর প্রজাপতির মত পাখা মেলছে। রাত জেগে অল দ্য রিভারস রান সিরিজ দেখতাম। দ্য থর্ণ বার্ডস সিরিজটা যে কি ভালো লেগেছিল। আসলেই মানুষের অদ্ভুত স্বভাব হলো ভালোবাসাবাসি। আমার কাছে , ভালোবাসা হলো রংধনুর মত। ভালোবাসলে হৃদয় প্রকাশিত হয়। বড় হবার সময়, ছেলেবেলার হাতের মুঠোভরা চুড়ির সেই রিনরিন হৃদয়ের একূল থেকে ওকূলে বয়ে যায়।

আর তখন থেকেই শুরু হয় আকাশ দেখা। আকাশের শূন্যতাতে হারানো। মেঘের সাথে হারিয়ে যাওয়া। এভাবেই ভালোবাসতে শেখা আমাদের প্রজন্মের মানুষদের। মাঝে মাঝে ডাইরী খুলে কত কথা লেখা। প্রিয় বই থেকে কোটেশন লেখা। অথবা হঠাৎ পড়া কোন কবিতার লাইন। গলা ছেড়ে গান গাওয়া “থাকতে দেনা আপন মনে আমায় থাকতে দেনা।“  এভাবেই ভালোবাসা বুকের ভিতর পাহাড় ডিঙায়, আকাশ পাড়ি দেয়। কখনোবা সমুদ্র ছুঁয়ে ঘুরে বেড়ায় কত দেশ!

ভালোবাসার লালগোলাপ খুঁজে পায় সবাই। এর জন্য অনেক অপেক্ষার পথ পাড়ি দিতে হয়।হাত ভরে রংধনু রঙ চুড়ি পড়ে একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গাইতে হয় সবারই............ "আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়”

সুলতানা শিরীন সাজি
অটোয়া, কানাডা।