অটোয়া, রবিবার ৪ জুন, ২০২৩
চড়ুইভাতির গল্পবলা দিন - সুলতানা শিরীন সাজি

কদিন এক সকালের হাত ধরে উঠে এসেছিল ওরা।
ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে নদীর বালিয়াড়ির কাছে পৌছাতে অনেক সময়!
ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার কার জন্য অপেক্ষা?
যে আসবো বলেও আসেনি, তার?
যে বলেছিল,যদি আসি ,তা শুধু তোমার জন্যই।
এই একটা কথাতেই বুকের ভিতর হুহু করে জেগেছিল ঝাউবন।
ছবিতে দেখা প্যারিসের আইফেল টাওয়ার এর কথাও মনে এসেছিল খুব।
বই এর ভাঁজে রাখা প্রথম চিঠির সুরভীর সাথে, লুকানো সেই ছবির সামনে মাঝেমাঝেই হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকতো ও।
ইচ্ছে হতো,যখন বড় হবে,
একদিন ওখানে গিয়ে বাতাসের গন্ধ নেবে।
ইটবিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার বুকের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াবে।

ব্রীজে ওঠার পর সবাই কলকল শব্দের মত মুখরিত হয়ে এগোয়।
ওর পা সরেনা।
খুব ইচ্ছা করে, ও আসুক।
খুব ইচ্ছা করে ও এসে বলুক শুধু তোমার জন্যই একটা সকাল দুপুর।

দুপুরের ট্রেনটার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে ও।
মনে হয় দূর থেকে ও হেঁটে আসুক। একটা মানুষ ,একটা পৃথিবীর আনন্দ নিয়ে ,শুধু ওর জন্য!

রান্নার জন্য কাঠ কুড়াতে বনের মধ্যে যায় কয়েকজন।
ও তাদের সাথে যায়।
পুরো বন জুড়ে শুধু বৈচী ফলের ঘ্রাণ!
ওর ইচ্ছা করছিল, সে আসুক আর ওর পিছনে হাঁটুক।

রান্না ,খাওয়া ,খেলার ফাঁকে
ওর মন খারাপের আকাশে জমা হতে থাকে কষ্টরা।
ঘাসের উপর চাদর বিছিয়ে বসে সবাই যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে থাকে,
একসময় ওর পালা এলে ও গাইতে থাকে,
"প্রভাতে পথিক ডেকে যায়, অবসর পাই নে আমি হায়-
বাহিরের খেলায় ডাকে সে, যাব কী ক'রে ।।"
এই বাহিরের খেলা'র কাছে এসে ওর চোখ টলমল করে।
ভিতরের খেলা তাহলে আছে?
যে খেলায় ,প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের সামনে তার হাত ধরে ঘুরে বেড়ায় ও।

একটা দিন,একটা উচ্ছল চড়ুইভাতির দিন, একটা ভালোলাগার মানুষের জন্য কেমন চোখের জল হয়ে যায়!
শেষ বিকালের ট্রেনটা ব্রীজের কাছে এসে দাঁড়ায়।
বাসায় ফেরার সময় দূর থেকে দেখে ওর সাইকেল। 
যার জন্য একটা পুরো দিনের অপেক্ষা,সে মানুষ ওর এত কাছে।
পা চলেনা,মনেহয় পালিয়ে যায় দূর বহুদূর।

ভীষন জ্বরের ঘোরে পড়েছিল ও।
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ,সারাদিনের সব অভিমান টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে।
হাত বাড়িয়ে ওর দেয়া বইটা নিয়ে ও পালায়।
বই এর পাতার ভাজে সারাদিনের বিস্ময়!
"চৈতালী, এত জ্বর,দু'দিন ধরে। সকালের ট্রেন ধরতে পারতাম না ।দুপুরের ট্রেনটাও ধরা হলোনা।
তুমি যখন ব্রীজের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছিলে, আমি তোমার পাশেই ছিলাম।
তুমি যখন বৈচী ফলের বাগানে অদ্ভুত গন্ধের ঘোরে ছিলে, আমি তোমার পিছনে হাঁটছিলাম।
জানোতো ,মানুষের কাছে থাকার নাম নিঃশ্বাস।
আমি জানি তুমি এটা বিশ্বাস করবে,শিমুল"

বাথরুমের কল দিয়ে পানি পড়ছে অবিরাম।
ওর চোখ ভেসে যাচ্ছে।
ও শুনতে পাচ্ছে মেঝপা ওর সাথে কথা বলছে।
ওরা জোরে জোরে হাসছে।

এর নামই ভালোবাসা। এর নামই প্রেম। এর নামই কাছে থাকা।
শিমুলের সাথে ওর দেখা হয়নি আর কোনদিন। পৃথিবীর কোথাও ও নেই আর।
কিন্তু ও আছে।
সব ভালোবাসাই থাকে।
শিমুলই তো বলেছিল,"মানুষের কাছে থাকার নাম নিঃশ্বাস।"

সুলতানা শিরীন সাজি
অটোয়া, কানাডা।