অটোয়া, শনিবার ২৭ জুলাই, ২০২৪
জাতির বন্দনায় মুজিব শতবর্ষ - দীপিকা ঘোষ

ইংরেজ কবি জন মিলটনের সেই বিখ্যাত উক্তি -‘The childhood shows the man/As morning shows the day’(John Milton, Paradise Regained), যুগে যুগে দৃষ্টান্ত হয়েছে বিশ্বের অজস্র খ্যাতিমান মানুষের জীবনপরম্পরা ঘটনায়। বাংলাদেশের স্থপতি ও প্রথম রাষ্ট্রপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জীবনেও কবির এই প্রবাদ উক্তিটি শতভাগ সত্য। একদিন মানবপ্রেমিক মানুষটি তাঁর মাতৃভূমি আর জনমানুষের ভবিষ্যত রচনা করবেন আকর্ষণীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে, তার ইঙ্গিত ছেলেবেলাকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেই আভাস ফেলেছিল বারবার। পরবর্তীতে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন উৎপীড়িত, অত্যাচারিত, বঞ্চিত মানুষের নেতা হয়ে। তাঁর চরিত্রে সহজাত সাংগঠনিক ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সরল ভাষার বাগ্মিতা, সততা, সাহস, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সঙ্গে নিঃস্বার্থপরতা।

যে কোনো চ্যালেঞ্জপূর্ণ পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সহজাত ক্ষমতা ছিল তাঁর। তিনি ছিলেন সেই ধরনের নেতা, যিনি অন্যকে উৎসাহিত করে অন্তরের অফুরান ভালোবাসা বিলিয়ে নিঃস্বার্থভাবে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় বদ্ধপরিকর। এই বেসিক গুণাবলীর জন্যই শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা ছড়িয়েছিল আকাশচুম্বী হয়ে। তৎকালীন সময়ে তাঁর মতো শক্তিশালি, ক্যারিশমেটিক নেতা দক্ষিণ এশিয়ায় আর ছিলেন না। দেশ এবং জাতির জন্য এতটা নিবেদিত প্রাণ নেতাও ছিলেন বিরল। তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে বিদগ্ধ সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় লিখেছিলেন -‘যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান/ততোকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’। 

একশো বছর আগে ১৯২০-এর ১৭ই মার্চ, এই মহান নেতা জন্ম নিয়েছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। বিস্তীর্ণ মধুমতী নদী আর সবুজ বনান্তের আড়ালে কেটে গিয়েছে তাঁর দুরন্ত শৈশব আর কিশোরকাল। বাংলার জল-মাটি-হাওয়ায়, হাজার বছরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির আবেগে গড়ে উঠেছে তাঁর মনোজগত। স্বদেশপ্রেমের উপলব্ধিতেই তিনি রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। অসীম আকাশের মতো মুক্ত হৃদয় নিয়ে ভালোবেসেছেন বাংলার মানুষ, সাগর-নদী, পশু-পাখী, মাঠ-ঘাট আর অনাবিল প্রকৃতিকে। সাংবাদিক সিরিল ডান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে সেই কারণেই বলেছিলেন, বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র নেতা যিনি ভাষায়, সংস্কৃতিতে, জন্মসূত্রে এবং জাতিসত্তায় এক পরিপূর্ণ বাঙালি। ‘In the thousand-year history of Bangladesh, Sheikh Mujib is the only leader Who has in terms of blood, race, language, culture and birth, been a full- blooded Bengali’ (Cyril Dunn, Journalist).        

এই মন্তব্য উচ্চারিত হওয়ার মূলে ছিল বঙ্গবন্ধুর নিখাদ দেশপ্রেম। বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অব্যাহত ধারা। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার টানেই মাতৃভূমি এবং জনমানুষের কল্যাণে তিনি আজীবন অকাতরে জীবন, যৌবন, মেধা-মননকে বিলোতে পেরেছেন। পাকিস্তানী শাসকদের নিষ্ঠুর নিপীড়ন, অন্যায় অত্যাচার উপেক্ষা করেছেন শারীরিকভাবে। তুচ্ছ তৃণের মতোই ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন নিশ্চিত মৃত্যুর পরোয়ানাকে। হাজার বছরের রূপসী বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে ভালোবেসে একদিকে তিনি আবেগের তরল স্রোতে ভেসেছেন। অন্যদিকে যুদ্ধরত সৈনিকের মতোই নির্মোহ জবাবদিহিতায় দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে স্বদেশবাসীর কল্যাণের জন্য হয়ে উঠেছেন অকুণ্ঠভাবে নির্ভীক।

নেতৃত্বের এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্য মুগ্ধ করেছে জাতিকে। বিস্মিত করেছে আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে। সাংবাদিক সিরিল ডানের কথায়-‘The courage and charm that flowed from him, made him a unique Superman in these times', (Cyril Dunn, Journalist). শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন কিউবান নেতা ফিডেল ক্যাস্ট্রোও। উপলব্ধি করেছিলেন কী অটুট সাহস আর অকুণ্ঠ আত্মবিশ্বাস দোলাচলহীন সাবলীলতায় ছড়িয়ে রয়েছে এই রাজনৈতিক নেতার আপাদমস্তকে। নিউজউইক ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ক্যাস্ট্রো তাই বলেছিলেন-‘I have not seen the Himalayas, but I have seen Sheikh Mujib. In personality and in courage, this man is the Himalayas. I have thus had the experience of witnessing the Himalayas',(Newsweek, 1973, Fidel Castro). 

আজ থেকে একশো বছর আগে যে অখ্যাত গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন, যে গ্রাম বাইরের বিশ্বে তো বটেই, দেশবাসীর কাছেও ছিল নিতান্ত অপরিচিত, সেই গ্রামই পরবর্তীকালে তাঁর আবির্ভাবে পেয়েছিল বিশ্বপরিচিতির গৌরব। কোটি অন্তরের ভালোবাসায় অভিস্নাত হয়েছিল টুঙ্গিপাড়া। সপরিবারে তাঁর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পরে ১৯৭৫ থেকে ৯৫ অবধি তাঁর সব অবদানই আচ্ছাদিত থেকেছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কুটিল ষড়যন্ত্রের আড়ালে। কিন্তু সত্য তো কখনো মানুষকে বঞ্চনা করতে জানে না। বহু বছর পরে পরিবর্তিত পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু তাই তাঁর বিশাল সত্যসমেত জেগে উঠেছেন পুনর্বার।   

মাতৃভূমি ও স্বদেশবাসীর কল্যাণের জন্য যিনি নিঃশেষে জীবনদান করেছেন, তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে অনাবিল ভালোবাসায়, অন্তরের কৃতজ্ঞতায়, অসীম শ্রদ্ধার গৌরবে ভরিয়ে দিতে জাতিও কোনো কার্পণ্য রাখেনি আজ। ২০২০-এর ১৭ই মার্চ থেকে ২০২১-এর ২৬শে মার্চ অবধি মহাসমারোহে উদযাপিত হবে বাংলাদেশের সব আলোকময় এবং অন্ধকার ঘটনাপুঞ্জের প্রতিটি অধ্যায়। এই সুনির্দিষ্ট সময়টুকু ইতিহাসের পাতায় যাতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতোই ভাস্বর হয়ে থাকে, সেজন্য নির্দিষ্ট বছরটি চিহ্নিত হয়ে থাকবে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে। ‘মুজিব বর্ষে’ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবস, জাতীয় শোকদিবস, চার জাতীয় নেতার জেলহত্যা দিবস উদযাপনের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হবে স্বাধীনতালাভের সুবর্ণ জয়ন্তী। বাংলার ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে আয়োজন করা হবে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নেতার জীবন এবং কর্মধারা সম্পর্কে ৯০০০ পৃষ্ঠার বিশাল ভলিউমে প্রকাশিত হবে তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ। যেখানে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন রিপোর্ট আর আগরতলা ষড়যন্ত্রের তথ্যাবলীও লিপিবদ্ধ করা হবে। 

এছাড়াও শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন আয়োজন করেছেন, ইন্টারন্যাশনাল গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২০। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বঙ্গবন্ধুর নামে দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদানেরও উদ্যোগ নিয়েছেন।  ইউনিভার্সিটি অফ লণ্ডন এবং বিশ্বভারতীসহ আরও তিনটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানে তাঁর স্মৃতির সম্মানে পাঁচটি চেয়ার প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিও চলছে। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণ করা হবে ‘বঙ্গবন্ধু সেন্টার’। লণ্ডনের ম্যাডাম টুসুড মিউজিয়ামে, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের হেডকোয়ার্টারে স্থাপন করা হবে ‘মুজিব ভাস্কর্য’। চাইনিজ, হিন্দী, উর্দুসহ বারোটি ভাষায় অনূদিত হবে তাঁর বিশেষ বিশেষ ভাষণ। শেখ মুজিবের আত্মজীবনী নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হবে চলচ্চিত্র। ফিলমের পরিচালক, ভারতের বহু পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত ডিরেকটর শ্যাম বেনেগাল। যিনি এক দশক আগে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ওপর ডকুমেন্টারি ফিলম তৈরি করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ২০১৩ সালে সেটি প্রদর্শিত হয়। 

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস এবং জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জনের পটভূমিতে তাঁর অবদান কতটা সুগভীর এবং সুবিস্তৃত, সে সম্পর্কে বিস্তৃত বিশ্লেষণ আজ অবধি ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নানাভাবে করে চলেছেন। সক্রিয়ভাবে যার শুরু হয়েছিল, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র হিসেবে অল ইণ্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্ট ফেডারেশনে তরুণ মুজিবের যোগদানের পরে। এরপরে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতেই সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তান। কিন্তু যিনি হাজার বছরের রূপসী বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতির স্পর্শ নিয়ে বেড়ে উঠেছেন, অন্তরে লালন করেছেন মানুষ এবং স্বদেশের জন্য সুগভীর ভালোবাসা, বাইরের ধর্মের দোহাই মেনে এমন সাম্প্রদায়িক স্বাধীনতায় তিনি সন্তুষ্ট হবেন কেন? হাজার বছর ধরে বাংলার বুকে যে সভ্যতাসংস্কৃতির জন্ম, তার লৌকিক ধর্মের বুনিয়াদে, প্রাত্যহিক জীবনসংস্কৃতিতে স্তরে স্তরে ঠেসে গিয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান এবং ইসলামী সংস্কৃতির নির্যাস। তার সঙ্গীত মন্থনে অনাবিল বয়েছে কীর্তন, পদাবলী, কবিয়াল, ভাটিয়াল আর আউল-বাউলের সঙ্গে জারি-সারির নির্ঝর। 

এই মিশ্রিত সভ্যতাসংস্কৃতিকে অস্বীকার করলে বাঙালির জাতিসত্তাকেই অস্বীকার করা হয়। অশ্রদ্ধা করা হয় আবহমান বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্যকে। তাই রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুর পরে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর প্রধান হয়েই দলীয় আদর্শ থেকে তিনি মুসলিম শব্দটিকে ঝরিয়ে দিলেন। সেকিউলার ইমেজ পেয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছেই হয়ে উঠলো নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। সোহরাওয়ার্দির শিষ্যত্ব ছাড়িয়ে মুজিব হয়ে উঠলেন বাংলার আপামর জনসাধারণের আপনজন। তাদের দীর্ঘকালের বাঞ্ছিত নেতা। কারণ যে ধরনের গুণাবলী থাকলে জাতির জীবনে যোগ্যতম নেতা হওয়া যায়, তার সব বৈশিষ্ট্যই এই মানুষটির চরিত্রে অসাধারণভাবে অটুট ছিল। সততা, সাহস, সমবেদনা, সুসংস্কৃত বুদ্ধি, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, উত্তাল পরিস্থিতিতেও অবিচলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা। ছিল কমিউকেশন স্কিল। একই সঙ্গে উদাত্ত হৃদয়ের মানবিকতা। পরিস্থিতি থেকে দ্রুত শিক্ষা গ্রহণের স্মার্টনেসও ছিল তাঁর। আর ছিল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ইতিহাস সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান। 

বাংলাদেশের স্থপতি অত্যাচারিত জাতির মুক্তিদাতা হিসেবে যতখানি প্রশংসিত, ততোটাই শ্রদ্ধেয় জাতির পিতা হিসেবে। কারণ বাইরের ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডীর বাইরে দাঁড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোয় তিনি নিজে  যেমন আলোকিত হয়েছিলেন, তেমনি সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকা কয়েক কোটি মানুষকেও পিতার মতো নিবিড় স্নেহে এক স্বপ্নের সুতোয় বেঁধেছিলেন। এই অবদানই তাঁকে চিরঅম্লান করে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তাই শ্রদ্ধাভরে যোগ দিয়েছে বিশ্ব। স্বীকৃতি হিসেবে  হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির পরিচয়ে তিনি গৌরবোজ্জ্বল হয়েছেন। 

অথচ এই স্বদেশপ্রেমিক নিঃস্বার্থ নেতাকেও চক্রান্তের আঁতাতে বিপর্যস্ত হতে হয়েছে বারবার। যুদ্ধবিধ্বস্ত, দুঃস্থ দরিদ্র সদ্য স্বাধীন জন্মভূমিতেও তাঁর বিদেশনীতি থেকে অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে সামরিক পলিসি সম্পর্কে হীন ব্যাখ্যা আর মিথ্যে সংবাদ প্রচার করে দেশ এবং জাতিকে বারবার বিভ্রান্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রেস মিডিয়া থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা, ছোট বড় ব্যবসায়ী থেকে ধর্মীয়নেতারা, বুদ্ধিজীবি থেকে ডান-বামের নবীন-প্রবীণ রাজনীতিকরা কেউই পিছিয়ে থাকেননি। এই বিচিত্র বিরোধিতার চরম পরিণতিতেই হত্যাকারীরা সঞ্চয় করেছে হত্যা করার দুঃসাহস।                                                                                          

দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জগতে বিরল নয়।  রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বহুবার বদলে দিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাস। কিন্তু বাংলাদেশে ৭৫-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর পরে জেলখানার অভ্যন্তরে জাতীয় নেতাদের হত্যাযজ্ঞের যে নারকীয় ঘটনা, সামরিক বিচারের প্রহসনে দেশপ্রেমিক সেনাঅফিসারদের জীবননাশের যে ট্র্যাজিক ইতিহাস, বিরাট পাপাচারের এমন দৃষ্টান্ত জগতে আর কোথাও নেই। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে গিয়ে তাই পুরোনো প্রশ্নটাই জেগে উঠছে বারবার, এমন বুদ্ধিদীপ্ত জনদরদী নেতাকেও কেন নিহত হতে হলো নৃশংসভাবে? সে কি কেবলই অমোঘ নিয়তির অপ্রতিরোধ্য পরিণতিতে? নাকি বঙ্গবন্ধুর নিজেরই মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলনে? 

জার্মানীর প্রাক্তন চ্যান্সেলর হেমুট স্মিটের বক্তব্য অনুসারে-‘A politician should never forget to align his doing with what is best for the country. But he or she should know who is an expert in which field and whom to trust. A politician should know when it is better to trust an expert in a field and when it is necessary to do own investigation’,(statement of a former German Chancellor, Helmut Schmidt). এ কথা সত্যি, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বহুক্ষেত্রেই সঠিক পদক্ষেপ ফেলায় বঙ্গবন্ধুর জন্য সীমাবদ্ধতা ছিল। জেনেশুনেও তাঁকে বহু বিষ হজম করতে হয়েছে। কিন্তু নিজের নিরাপত্তা সংরক্ষণে, মানুষ চেনার ক্ষেত্রে তিনি নিজেও যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন না। থাকলে তাঁর অকাল মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। বাংলাদেশের বাস্তবতাও আজ রচিত হতো অন্যভাবে। 

৭৪ এর ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে ভারতের একস্টারনাল ইন্টিলিজেন্স এজেন্সির প্রতিষ্ঠাতা রামেশ্বর নাথ কাও যখন ঢাকায় এসে তাঁকে সতর্ক করেছিলেন, অবিশ্বাসে হেসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৭৫-এর মার্চে  এসেছিলেন ‘র’ এর শীর্ষ পর্যায়ের অফিসার। এবারও তিনি কাঁধ নেড়েছিলেন স্নেহের হাসি ঝরিয়ে। বলেছিলেন - আপনি যাদের কথা বলছেন সেই জিয়াউর রহমান আর ফারুক রহমানরা আমার ছেলের মতো! ওরা কেন এমন কাজ করতে যাবে বলুন তো? অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই নিরপেক্ষতার ভণিতা করে বাকশালসহ আরও কয়েকটি সিদ্ধান্তকে তাঁর হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করার যুক্তি তোলেন। কিন্তু অজস্র তথ্যপ্রমাণে এটি এখন প্রমাণিত, ১৯৭২ সাল থেকেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে উৎখাতের ষড়যন্ত্র তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল। ৭৩-এর মাঝমাঝি ছয় সপ্তাহের জন্য ওয়াশিংটনে এসে জিয়াউর রহমান পাকিস্তান এম্বাসিতে বারকয়েক আলোচনা বৈঠক সেরে সেই ষড়যন্ত্রকে আপাদমস্তক রূপ দেন। 

প্রশ্ন উঠতে পারে, যিনি দেশ এবং দেশবাসীর কল্যাণে আত্মবিসর্জন দিতেও পিছিয়ে থাকেননি, শুরু থেকেই সেই মহান নেতার বিরুদ্ধে কেন জমে উঠলো যড়যন্ত্রের এই কালো মেঘ? এর উত্তর, যে আদর্শের ভিত্তিতে (বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা) জাতির কল্যাণ কামনায় মুজিব আধুনিক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীদের আদর্শের ব্যবধান ছিল সম্পূর্ণ উল্টো মেরুর। স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হলেও পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্বের আদর্শেই এরা তাই মজ্জায় মজ্জায় অনুপ্রাণিত হয়েছে। ‘While there was no question of any rapprochement between Bangladesh and Pakistan, there are Muslim diehard elements in Bangladesh who draw this inspiration from Pakistan. These elements aim to strike at the very basic concept of Bangladesh',(A peep into Sheikh Mujib's assassination by T V Rajeswar). 

কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের হত্যাযজ্ঞ বঙ্গবন্ধুর অমরত্বের পথ প্রতিরোধ করতে পারেনি। তিনি বেঁচে ছিলেন। বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকবেন ভবিষ্যতে। যখনই আসবে দুঃসময়, অনুপ্রাণিত করবেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়ে। সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন -‘বিশ্বের বুকে যতবার হবে বাঙালি জাতির প্রয়োজন/ততোবার তুমি পাশে থেকো নেতা, জাতিরে করিতে উদ্ধারণ’! 

দীপিকা ঘোষ । ওহাইয়ো, আমেরিকা