অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
করোনার কাছে নয়, স্বার্থপরতার কাছে পরাজিত এক বিশ্ব – সুপ্তা বড়ুয়া

    মানবজাতির জন্য স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহতম সময় অতিবাহিত হচ্ছে এখন। মানুষ এই সময়টাকে আখ্যা দিয়েছে এই ভাবে ‘আমরা ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি বলে’। পৃথিবী যেন শুধু মনুষ্য বসবাসের স্থান, একচ্ছত্র তার আধিপত্য, সেজন্য মানুষ তাকে নানা অভিধায় অভিহিত করছে। কিন্তু আসলেই কি আমরা একটা ভয়াবহ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি নাকি প্রকৃতি তার হিসাব বুঝে নিচ্ছে !
     কোভিড-১৯'এর কারণে ঘরবন্দী হয়ে গেছে মানুষ। সীমান্ত দিয়ে যে বেড়ি আমরা বেঁধেছি, তার সংজ্ঞায় বলতে গেলে, পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ আজ কোভিড-১৯’এর রোষানলে পড়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী যে মানুষের রোষানলে পড়ে প্রকৃতি কোণঠাসা হয়েছে, সেটা যেন মানুষের চোখেই পড়ছে না। মানুষ প্রকৃতির উপর এত অত্যাচার করে হয়ে উঠতে চেয়েছে প্রকৃতির বিকল্প। কিন্তু মানুষ ভুলে গেছে প্রকৃতির কোন বিকল্প নেই। এই করোনার মাঝে গালভরা কথা নিয়ে প্রতিপালিত হলো ‘বিশ্ব ধরণী দিবস'। যেই ধরণীতে রাতদিন আমরা বেঁচে আছি রাতদিন, সেই ধরণীর জন্য আমরা বরাদ্দ করে দিয়েছি একটা দিন। যেসব মানুষ ভোগ ছাড়া কিছুই বোঝে না, সেসব মানুষকেও দেখলাম এই দিবসে নানা ধরণের বুলি আওড়াতে। আসলেই কি আমরা এ ধরণীর জন্য উপযুক্ত কি'না সেই আত্ম-জিজ্ঞাসার বদলে মানুষ ধরণীকে প্রশ্ন করছে কেন এমন মহামারী এলো, চীনকে দোষারোপ করছে সারা পৃথিবী। এই করোনাতেও থেমে নেই সৌদি সেনাবাহিনীর ইয়েমেন হামলা। কিন্তু মানুষের সেই একই স্বভাব, অন্যকে দায়ী করা, অন্যের উপর জুলুম করা থেকে থেকে বিরত থাকছে না।
     করোনা চলাকালীনই কানাডায় হয়ে গেলো স্মরণকালের জঘন্যতম হত্যাকান্ড ঘটে গেলো। একজন ৫১ বছর বয়স্ক বন্দুকধারীর গুলিতে ঝরে গেলো ২২টি প্রাণ কানাডার ম্যারিটাইম প্রভিন্স নোভা স্কশিয়াতে ১৯শে এপ্রিল। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের যে বিধিমালা আজ বছরের পর বছর ধরেও সভ্য সমাজের সভ্য সরকার তৈরি করতে পারলো না, তার বলি হয়ে গেলো আরো ২২টি প্রাণ। আমরা হিংস্রতা, উগ্রতা কিছুই ছাড়ি নি। করোনার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও ঠান্ডা মাথায় কোন মানুষ ২২টি প্রাণ নিয়ে ফেলতে পারে, সে হয়তো আমাদের কাছে অবাক লাগছে। কিন্তু বিকৃত মস্তিষ্কদের জন্য করোনাই বা কি, স্বাভাবিক পরিস্থিতিই বা কি ! এই যেমন এই দুর্যোগকালেও থেমে নেই সরকারী ত্রাণ আত্মসাৎ’এর ঘটনা খোদ আমার মাতৃভূমিতেই। চাল-ডাল-তেল সব কিছুই চুরির মহাসমারোহ চলছে, আবার কার থেকে কে বেশি চুরি করতে পারে, তা নিয়েও হচ্ছে প্রতিযোগিতা। কোটি কোটি টাকার ত্রাণ চুরি করে এক একজন এই সঙ্কটময় মূহুর্তগুলোতে আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নাকি ব্যাপকভাবে আত্মসাৎ হয়েছিল বিদেশী ত্রাণ। বিভিন্ন গল্প, কাহিনী আছে সে সময়টাকে ঘিরে। যার বেশিরভাগই শোনা কথা। কিন্তু এখন মিডিয়ার কল্যাণে সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগও হয়ে যাচ্ছে এই ত্রাণ চুরির ঘটনা। কি আশ্চর্য, এখনও সেই ১৯৭১ পরবর্তী সময়ের মতো সেই একই দল সরকারী ক্ষমতায়।
     কিছুই কি আমাদের হিংস্রতা দমাতে পারছে? পারছে না। তাই কোভিড'ও পারবে না। সবাই বলছে কোভিড পরবর্তী বিশ্ব হবে একটা পরিবর্তিত বিশ্ব। কিন্তু আমার মনে হয় না আমরা খুব বেশি বদলাবো বরং আমাদের হিংস্রতা, দীনতা, হীনমন্যতা দিনকে দিন আরো আরো বেড়ে যাবে। কোভিডের কারণে জেনে না জেনে প্রবাসীর বাড়ি হামলা থেকে শুরু করে মৃত কোভিড রোগীকে দাফন/সৎকার থেকে বিরত রয়েছেন আত্মীয়স্বজন। অচ্যুতের মতো করে ব্যবহার করছে পরিচিত জনের সাথে। মৃত ছেলের লাশ নিয়ে রাস্তায় বসে ছিলো মা, সাথে তার কন্যা। কেউ এগিয়ে আসে নি। মৃত কোটিপতি'র সৎকার করতে এগিয়ে আসে নি আত্মীয়স্বজন, কিংবা ছয় হাসপাতাল ঘুরে পিতার জন্য চিকিৎসা আদায় করতে পারে নি সন্তানেরা অথবা কোভিড রোগী শুনে এ্যাম্বুলেন্স আসে নি নিতে। কোথায় বদলে যাওয়া পৃথিবী, বরং এটাই মনুষ্য প্রজাতির চরম স্বার্থপরতার নিদর্শন এসব। কোভিডের কাছে পরাজিত হওয়ার আগে আমরা স্বার্থের কাছে পরাজিত হয়ে গেছি। 
     ১৫ এপ্রিল, সিলেট মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মঈন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর সময় পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবাও পায় নি, বেঁচে থাকতে তো পায় নি পর্যাপ্ত সুরক্ষা। ডাক্তারদের সুরক্ষা দেওয়ার বদলে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিলো ধর্মীয় নেতাদের পিপিই দিয়ে, সেই একই কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছিলো  সরকার ডাঃ মঈনের মৃত্যুর সময়। সিলেট থেকে ঢাকা আসার জন্য এয়ারএ্যাম্বুলেন্স চেয়ে পায় নি একজন ডাক্তার আর ওদিকে হাটহাজারীর শফি হুজুরকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ারএ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা আনা হয়েছিলো। যে দেশের সরকারের কাছে ডাক্তারের প্রাণের মূল্য একজন প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় নেতার চেয়েও কম, সে দেশের জনগণের এভাবেই তো মরা উচিত, তাই না! তাই যখন খবরে পড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাধারণ জনগণ করোনা আক্রান্ত ডাক্তার দম্পতিকে পিটিয়ে এলাকা ছাড়া করে, তখন আমাদের কি দুঃখ পাওয়া উচিত?
     করোনার সময় ঘরবন্দী মানুষের মাঝে বেড়ে গেছে পারিবারিক সহিংসতা। খোদ ফ্রান্সেই ৩০ ভাগ বেড়ে গিয়েছিলো ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এপ্রিলের মাঝামাঝি। তাহলে বাংলাদেশের মতো নারীদের জন্য অরক্ষিত একটা দেশে কি অবস্থায় আছে নারীরা এই বন্দী সময়ে। ১৪ই এপ্রিল ফেনী পৌরসভার অধিবাসী টুটুল নামে এক ব্যক্তি ফেসবুক লাইভে এসে বউকে কুপিয়ে মেরেছে। আরো এক অপরাধী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এই লকডাউনের সময়েই বউকে পিটিয়েছে। মাদ্রাসাগুলোয় নিয়মিত ধর্ষণ কার্যকর রয়েছে, ঘরে ঘরে থেমে নেই নির্যাতন, তাহলে আমরা এই কঠিন সময় থেকে শিক্ষা নিলাম কি?
     এই পরিস্থিতি কি শুধু বাংলাদেশে? না, শুধু বাংলাদেশে নয়। সারা পৃথিবীতেই সকলে অরক্ষিত হয়ে গেছে। মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের সদস্যদের মাস্ক পরতে বলায় ২৩ বছরের একটা ছেলে খুন করে ফেলেছে এক দোকানের নিরাপত্তারক্ষীকে। চট্টগ্রামে স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করা ফেনীর এক অধিবাসীর লাশকে গ্রামে ঢুকতে দেয় নি গ্রামবাসী। অন্য এক আত্মীয়ের গ্রামে গিয়েও পারে নি লাশ দাফন করতে, লাশের সাদা কাপড় দিতে অস্বীকার করেছে এক কাপড় ব্যবসায়ী আত্মীয়, জানাজা পড়তে অস্বীকার করেছে মসজিদের ইমাম। তবে যেই পুলিশ বাহিনীকে বছরের পর বছর দেশের মানুষ নানা কটুক্তি, ঘৃণা, অবজ্ঞা করে এসেছে তারাই এগিয়ে এসে রাত দুটোয় সেই ব্যক্তির লাশ দাফন করেছে। এটুকুই আমাদের আশা, হয়তো মুদ্রার অন্য পিঠটাও আমরা দেখবো, চিনবো মানুষকে। স্বার্থপরতা আর সংকীর্ণতার কাছে মানুষের পরাজয় হয়েছে অনেক আগেই, করোনার সময় সেটা আমরা আরো একটু বেশি করে প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু তারপরও এই মানুষের কাছেই প্রত্যাশা তারা ঘৃণার বদলে মানুষ চিনবে, ধর্মের বদলে মানুষ জানবে। এ পৃথিবীকে ভালোবাসবে নিজের ঠিকানা হিসেবে।

সুপ্তা বড়ুয়া। অটোয়া, কানাডা
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে তাঁর নিজস্ব ব্লগ supta.ca ভিজিট করুন।