সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যা
পার্থ প্রতিম হালদারঃ ২০২০ সালের এই অভিশপ্ত বছরে একদিকে যখন সারা বিশ্ব করোনার আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে আছে, লাখো লাখো মানুষ মারা যাচ্ছে, লকডাউনে জীবনটা বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত করে দিয়েছে, ঠিক তখন বলিউডের তরুণ অভিনেতা তথা সুদর্শন নায়ক সুশান্ত সিং রাজপুত যিনি ছিলেন নতুন প্রজন্মের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় মুখ বা মেয়েদের হার্টথ্রব, তিনি আজ (অর্থাৎ ১৪ ই জুন রবিবার ) দুপুরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করলেন। তাঁর অভিনয়, চলাফেরা, হাসি, নাচ এমনকি চেহারাতেও ভক্ত দের কে মুগ্ধ করে দিয়েছিল। অভিনয়ের কেরিয়ার তে যথেষ্ট সাফল্যও তিনি পেয়েছেন। একের পর এক হিট ছবি তিনি আমাদেরকে বা দর্শকদেরকে উপহার দিয়েছেন। সেইসঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সুন্দরী মেয়ে বা গার্লফ্রেন্ডেরও অভাব ছিল না। আর্থিক সংকট ও ছিল বলে তো মনে হয় না। কত শত স্ট্রাগেল করে তিনি অমন একটা জায়গাতে পৌঁছতে পেরেছিলেন, সাফল্যের মধ্য গগনে বিরাজও করছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি কেন যে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আত্মহত্যা করে বসলেন তা ভেবে কূল পাওয়া যায় না।
১৯৮৬ সালের ১১ ই জানুয়ারি বিহারের পাটনায় তিনি জন্মগ্রহন করেন। কিছু দিন দিল্লিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনাও করেছিলেন। তবে থিয়েটার করার ঝোঁক তাঁর মধ্যে প্রবল ছিল। যে কারণে থিয়েটারে সুযোগ পাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে মুম্বাই তে যান। তারপর ২০০৮ সালে 'কিস দেশ মে হ্যায় মেরা দিল' সিরিয়াল তে প্রথম অভিনয় করেন। অর্থাৎ ছোট পর্দা থেকে বড়ো পর্দাতে তিনি ধীরে ধীরে নিজের জায়গা টা করে নিয়েছিলেন। যাইহোক এরপর ২০০৯ সালে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পান - 'পবিত্র রিস্তা' নামক সিরিয়ালে।আর এই সিরিয়ালে তাঁর অসামান্য অভিনয়ের কারণে তিনি দর্শক দের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। যার ফলে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। ২০১৩ সালে shuddh Desi Romance এবং kai po che ছবিতে অভিনয় করেন। ২০১৪ সালে pk, ২০১৫ সালে Detective Byomkesh Bakshy, ২০১৬ তে M. S. Dhoni : The Untold story, ২০১৭ তে Raabta , ২০১৮ তে kedarnath , ২০১৯ তে Sonchiriya, Drive Chhichhore ছবিতে অভিনয় করেন। kai po che ছবিটি চেতন ভগবতের the three mistakes of my life অবলম্বনে করা হয়েছিল। এই ছবিটি করার পর তিনি তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন ফ্লিম ফেয়ার এওয়ারড। সেইসঙ্গে ছবিটি বাজারে খুব ভালো ব্যাবসাও করেছিল। সিরিয়াল বা বড়ো পর্দাতে অভিনয় ছাড়াও তিনি 'জরা নাচকে দিখা', 'ঝলক দিলা জা' প্রভৃতি রিয়েলিটি শো-তে অংশ গ্রহণ ও করেছিলেন।
এবারে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক। অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত বরাবরই একটু ডিপ্রেসনতে ভুগতেন । তবে সেই ডিপ্রেসন প্রকৃত কি কারণে তা সঠিক ভাবে জানা যায়নি । মনে করা হয় কয়েক বছর আগে তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর থেকে তিনি অনেকটা ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি কেন যে বারবার গার্লফ্রেন্ড বদল করতেন তা ভেবে পাওয়া যায় না। বছর বছর তাঁর নিত্য নতুন গার্লফ্রেন্ড দেখতে পাওয়া যেত। তা যে কারণেই হোক না কেন ব্যক্তিগত জীবনে যে তাঁর অনেক গুলো গার্লফ্রেন্ড এসেছে চলে গেছে তা ঠিক। একটা সম্পর্ক ভেঙে গিয়ে আবার নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এভাবে ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছে। যেমন 'পবিত্র রিস্তা' রিলিজের পর অভিনেত্রী অঙ্কিতা লোখান্ডের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর তাঁর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেলে রবতা ছবির পরে কৃতী শ্যাননের সঙ্গে প্রেম শুরু হয়। এটাও আবার ভেঙে যায়। তারপর কেদারনাথ ছবি করার পরে সারা আলি খানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাও কিন্তু বেশি দিন টেকেনি। সারা আলি খানের সাথে বিচ্ছেদের পর তাঁর-ই বান্ধবী বাঙালি কন্যা রিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে ঘনিষ্টতা হয়ে যায়। এভাবে তাঁর জীবনে একের পর এক প্রেমিকা এসেছে আবার চলে গেছে - সম্পর্ক একদিকে গড়েছে অন্যদিকে ভেঙেছে। তবে নায়ক সুশান্ত সিং রাজপুত এই বাঙালি কন্যা রিয়া কে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। রিয়ার জন্য পাগোল হয়ে নিজের ফ্লাট ছেড়ে রিয়ার ফ্লাটে গিয়ে থাকতেন। রিয়ার জন্মদিনে তিনি তাঁকে একটি দামী লকেট উপহার দিয়েছিলেন, দুজনে একসাথে ছবি তুলেও ছিলেন। এমনকি রিয়া কে 'মাই জলেবি' বলে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছিলেন। কিন্তু তাঁর বিয়ের প্রস্তাবে রিয়া রাজি হননি। রিয়া চেয়েছিলেন সুশান্তের জায়গা টা বলিউডে পাকাপোক্ত ভাবে হয়ে গেলে তবেই বিয়ে করবেন। কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না। সেই সময় আর আসলো না। তাঁর জীবনের সময় টা ৩৪ বছর বয়সে এসে শেষ হয়ে গেল। সত্যি এই মুহুর্তে ধোনি মুভির নায়িকার সেই অসাধারণ ডায়ালগটা মনে পড়ে যাচ্ছে - 'মাহি, পাক্কা না ? বহোত টাইম হ্যায় না হামারে পাস ।'
সব থেকে ভাবলে অবাক লাগে এই ভেবে যে, কয়েক দিন আগে সুশান্ত সিং রাজপুতের প্রাক্তন ম্যানেজার দিশা সালিয়ন বহু তল ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন ।তার ঠিক ৫ দিন পর নিজের বাসভবনে ( মুম্বইয়ের বান্দ্রায় ) তিনি আত্মহত্যা করলেন। ব্যাপারটা পুরো রহস্য জনক বলে মনে হচ্ছে। এটা ঠিক কিছু মাস হলো তাঁকে অতটা পরিমানে সোশাল মিডিয়ায় দেখা যেত না। যেখানে অন্যান্য নায়ক নায়িকা দের যেমন করে সোশাল মিডিয়ায় দেখা গেছে লকডাউনের বাজারে, তেমন টি কিন্তু সুশান্ত সিং রাজপুতের ক্ষেত্রে হয়নি। এটা হয়তো ঠিক লকডাউনের কারণে সোশাল মিডিয়াতে অতটা পরিমানে সেলিব্রেটিরা আসতে পারেনি। তাই তাঁরা কে কোথায় কিভাবে আছেন তা অনেক টাই অজানা । অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত নাকি এই কয়েক মাস প্রবল ডিপ্রেসনের মধ্যেও ফ্লাটে একা ছিলেন। তার ওপর লকডাউনের কারণে নতুন ছবি বের হয়নি তাই হয়তো পয়সা ইনকামও হয়নি। তার ওপর সেলিব্রেটিদের যে লাইফ স্টাইল তাতে করে খরচ টাও তো অনেক। কিন্তু এত বড় মাপের একটা অভিনেতা আর্থিক সংকটের কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন তা তো হতেই পারে না। ছিছোড়ে, ধোনি, কেদারনাথ প্রভৃতি মুভির সাফল্য তাঁকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি যে কেন আত্মহত্যা করে বসলেন তা ভেবে পাওয়া যায় না। যে মানুষটির মুখে সবসময় একটা ইনোসেন্ট হাসি লেগে থাকতো সেই মানুষটি যে এইভাবে আত্মহত্যা করতে পারেন তা ভাবতে পারাই যায় না, বিশ্বাস করা যায় না। অভিনেতা অক্ষয় কুমার থেকে শুরু করে অনুরাগ কাশ্যপ পর্যন্ত জনপ্রিয় সব অভিনেতা তাঁর আত্মহত্যা তে নির্বাক হয়ে গেছেন, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন, শোক প্রকাশ করেছেন। আমরাও সবাই বাকরুদ্ধ, ভগবানের কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
পার্থ প্রতিম হালদার। করিমগঞ্জ, আসাম
-
নিবন্ধ // মতামত
-
14-06-2020
-
-