অটোয়া, বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের তাৎপর্য - ড. মিল্টন বিশ্বাস

‘মুজিববর্ষে’ করোনা-ভাইরাস কবলিত দিনযাপনের নির্মমতা ও মৃত্যুভীতির মধ্যে শতবর্ষের পথে এগিয়ে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৯তম দিবসের তাৎপর্য অন্বেষণ করা সত্যিই কঠিন কাজ। এবারের ১ লা জুলাই যেভাবে উদযাপিত হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না ঠিকই; কিন্তু ব্যাধির সংক্রমণ ভয়ে গৃহবন্দি মানুষের জীবনে স্মৃতির আঙিনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। ৯৯ বছরের পুরানো প্রতিষ্ঠানটির অগ্রযাত্রা বিস্ময়কর।

আমরা যারা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল,  পিএইচডি কিংবা ভিন্ন সব ডিগ্রি অর্জন করে এদেশের রাষ্ট্র ও সমাজের বিচিত্র কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত- সকলেরই রয়েছে এর সঙ্গে আন্তরিক সংযোগ। বিশেষত যেসব গ্র্যাজুয়েট দেশের বাইরে অবস্থান করছেন কিংবা ভাষা-আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্ত থেকে তাঁদের প্রিয় ক্যাম্পাসে পদচারণা করেছিলেন তারা আশি বছর বয়সে এসেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্মৃতির মণিকোঠায় ধারণ করে আছেন। এদেশের রাজধানী ঢাকা যেমন একমাত্র শহর, তেমনি এদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একমাত্র সফল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।  এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান, গবেষণা, জ্ঞান আদান-প্রদান এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পর্যন্ত অনন্য। জরিপ অনুসারে এশিয়া কিংবা বিশ্ববাসীর তালিকায় এই প্রতিষ্ঠানের নাম নিচে কিংবা উপরে থাকার চেয়ে বাঙালির কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদা। তবে নিজের প্রতিষ্ঠানের সুনাম সকলেই প্রত্যাশা করেন, সকলেই চান এর মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক। উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে গত এক দশক কেবল আলোচনা, সমালোচনা ও সেমিনার হয়েছে। মাঝে মাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়েছেন বিশিষ্টজনরা। অবশ্য কার্যকর পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত গৃহীত হয়নি।

২.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার উদ্ভাবনা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য কাজ বিদ্যার উৎপাদন, তার গৌণ কাজ সেই বিদ্যাকে দান করা। বিদ্যার ক্ষেত্রে সেসব মনীষীদের আহ্বান করতে হবে যাঁরা নিজের শক্তি ও সাধনা দিয়ে অনুসন্ধান, আবিষ্কার ও সৃষ্টির কাজে নিবিষ্ট আছেন। মনীষীদের একক কিংবা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জ্ঞানের উৎস উৎসারিত হবে। শিক্ষার সঙ্গে দেশের সর্বাঙ্গীণ জীবনযাত্রার যোগ থাকতে হবে।  বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই অর্থশাস্ত্র, কৃষিতত্ত্ব, স্বাস্থ্যবিদ্যা, সমস্ত ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে নিজের প্রতিষ্ঠা-স্থানের চারিদিকের নগর কিংবা পল্লির মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে; নিজের আর্থিক সম্বললাভের জন্য সমবায় প্রণালি অবলম্বন করে ছাত্র-শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হবে। আর এরকম আদর্শ বিদ্যানিকেতন হলো ‘বিশ্বভারতী’। 

রবীন্দ্রভাষ্য মনে রেখে বলা যায়, প্রতিষ্ঠা-লগ্ন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল- জ্ঞান সৃষ্টি করা, জ্ঞান-জগতের  অভিনব উদ্ভাবনের  নতুন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং  শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও গবেষণায়  শিক্ষার্থীদের  নিয়ত নিয়োজিত রাখা। এখানকার শিক্ষকগণ একাধারে জ্ঞানদান করেন, নিজে জ্ঞান সৃষ্টির জন্য আত্মনিমগ্ন থাকেন,  শিক্ষার্থীর সুপ্ত জ্ঞান অভীপ্সা জাগিয়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হন, সর্বোপরি মানব কল্যাণে জ্ঞানকে ব্যবহার করেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানার্জনে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও সত্য অনুসন্ধান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় সমাপ্তির পর একজন শিক্ষার্থী কেবল একটি সনদ উপার্জনের জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না। বরং সংস্কারমুক্ত ও যুক্তিশীল মননের অধিকারী একজন ব্যক্তি হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অন্যতম পুরোধাও সে। একারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ ও গবেষণার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মার্কেট ভ্যালুর চেয়ে সোস্যাল ভ্যালু তৈরি করে চলেছে গত নয় দশক ধরে। 

প্রকৃতপক্ষে শতবর্ষের পথে এগিয়ে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা দেখতে পাই, মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং জ্ঞানসৃষ্টি ও প্রসারের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে এটি। আমাদের দেশে অতীতে রাজনীতির নামে বিবদমান ছাত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও রক্তপাতের কারণে সৃষ্ট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমকে চরমভাবে বিঘ্নিত করত। সেই অবস্থা এখন আর নেই। ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা করতে। দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করে তাদের মেধা, মনন বিকাশের দ্বার রুদ্ধ করা একেবারেই অন্যায়। স্বাধীনতার পরে ‘ডাকসু’ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বেশি মাত্রায় দলীয় লেজুড়বৃত্তি করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছিল। অন্যদিকে স্বৈর-শাসকরা ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবন বিনষ্ট করায় সৎ, যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ এবং নেতৃত্ব গড়ে না উঠার ফলে দেশ ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এই একবিংশ শতাব্দীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থাকবে না বলেই আমরা মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হবে সবার জন্য উন্মুক্ত। সেখানে সকল দলের ও মতাদর্শের সমন্বয় সাধন হবে। স্বাধীনতা-বিরোধী ছাড়া স্বাধীনভাবে অন্য সকলের মতামত প্রকাশের অধিকার থাকবে। ছাত্র-ছাত্রীরা হবে যুক্তিবাদী। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরাই নিরেট সত্য প্রতিষ্ঠা করবে- তবেই  শিক্ষাঙ্গণ হয়ে উঠবে সঠিক জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রস্থল। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে আধুনিক জ্ঞান অনুসন্ধান, জ্ঞানের চর্চা ও জ্ঞানের আদান-প্রদানের তীর্থস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনের মতাদর্শ আরেকজনের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। অযথা জোরপূর্বক কাউকে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে অংশগ্রহণে বাধ্য করারও অবকাশ নেই। তবে দেশের সমাজ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে নিপীড়ন-বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের অবশ্য কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রথম শ্রেণির অন্যান্য সরকারি চাকরির তুলনায় অনেক কম সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেদিকেও মনোযোগ দিতে হবে সরকারকেই। 

৩.
একথা ঠিক ‘সুষ্ঠু পরিবেশ, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গুণগত শিক্ষা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়।’কিন্তু চলতি বছরের ১৪ মে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তখন সুযোগ-সুবিধা কম থাকলেও যোগ্য অধ্যাপকদের অভাব ছিল না। তাঁর স্মৃতিকথা ‘কাল নিরবধি’ এবং ‘বিপুলা পৃথিবী’তে তিনি যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে দেখা যায় পাকিস্তান আমলের বিরূপ রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও তিনি নিজের চেষ্টায় এবং তাঁর অধ্যাপকদের আন্তরিকতায় জীবনে সফল হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। তাঁকেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার জন্য কম নাজেহাল হতে হয়নি। বরং চারিদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঢেউ আর পাকিস্তানপন্থী শত্রুদের মধ্যে থেকেও তিনি লেখাপড়ার কাজ চালিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ নানা কাজের মধ্য দিয়ে গত ৪৯ বছরে বিশ্বের কাছে গৌরবজনক আসন অর্জন করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক গ্র্যাজুয়েটদের দেশপ্রেম ও দায়বদ্ধতার কারণে। যেমন, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা উভয়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর এই দু’জনের অর্জন ও অবদান বিশ্বজন স্বীকৃত। আসলে আমরা যতই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, পাঠ্যক্রম, গবেষণা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন তদারকির কথা বলি না কেন, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের অর্জন কম কথা নয়। 

১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ৯৯ বছর যাবৎ আমাদের চিন্তা-চেতনাকে প্রগতির পথে চালিত করেছে। কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িক ভাবনা, অবিচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা শিখিয়েছে। গড়ে তুলেছে বৈষম্যহীন সমাজ। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা এখন অনুপস্থিত। শতবর্ষে এসে এই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের রাজনৈতিক ঐক্য অর্থাৎ দল-মত নির্বিশেষ মানুষকে প্রগতিশীল চিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিতে আনতে পারবে বলে বিশ্বাস করা যেতে পারে।

ইদানিং কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে হতাশার কথা উচ্চারণ করেন। তাঁরা বলেন মান অবনতির সবচেয়ে বড় কারণ হলো শিক্ষায় রাজনৈতিক প্রভাব। তারপর যে বিষয়গুলো ধর্তব্যের তা হলো- গবেষণা, অবকাঠামো, বাজেট, যোগ্য শিক্ষক এবং ছাত্র শিক্ষক অনুপাত প্রভৃতি। মানের এই অবনমনের জন্য প্রধানত দায়ী শিক্ষকরা। দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলে থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারি কর্তৃত্ব, শিক্ষকদের স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার, শিক্ষায় বরাদ্দ ও গবেষণার অপ্রতুলতা, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অসংগতি, শিক্ষার্থীদের আবাসন ও দলীয় ছাত্র রাজনীতিতে সংকটজনক পরিস্থিতির মতো বিষয়গুলো মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে চিন্তায় আনতে হবে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অর্জনে আগ্রহ কমে গেছে। উপরন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ এখনো বিশ্বমানের নয়। আরো অভিযোগ হলো- শিক্ষকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হলেও এখন মূলত দলীয় রাজনীতি প্রধান হয়ে উঠেছে এবং সরকারদলীয় শিক্ষকদের দাপট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পড়েছে নির্বাচনকেন্দ্রীক। বছরজুড়ে শিক্ষকদের নানা নির্বাচন লেগেই থাকে। 

এ সম্পর্কে আমাদের অভিমত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু একাডেমিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিধির অনুবর্তী সেজন্য নির্বাচন এবং শিক্ষকদের দলীয় প্ল্যাটফর্ম থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে বিষয়টি এখন সামনে আনা দরকার তা হচ্ছে- দলীয় আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে অধ্যাপকদের রাজনীতিতে বেশি সময় ব্যয় কিংবা রাতদিন নিজের দলের ভেতর একাধিক গ্রুপের অতিতৎপরতা প্রভৃতির অনুশীলন। আওয়ামী লীগ মতাদর্শের সমর্থকদের ভেতর একাধিক বিভাজন থাকাটা কতটা যৌক্তিক কিংবা এক গ্রুপের বিরুদ্ধে অন্য গ্রুপের নোংরা প্রচারণা থাকা আদৌ দরকার কিনা- এসব বিষয় নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। কারণ আনিসুজ্জামানের পূর্বোক্ত গ্রন্থদ্বয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থপর অধ্যাপকদের নোংরামির বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।

৪.
আসলে শিক্ষক রাজনীতি যে কলুষিত হয়েছে এটা মানতেই হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ছাত্রজীবনে ভালো ফলাফলকে গুরুত্ব না দিয়ে দলীয় বিবেচনায় ‘ভোটার’ নিয়োগ দিয়েছিলেন। ফলে সেসব নিম্নমেধার শিক্ষকরা এখন অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়ে দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করছেন। এতে নতুন চিন্তা-ভাবনা এবং মুক্তবুদ্ধির প্রসারণের চেয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে পড়েছে নির্বিকার সার্টিফিকেট বিতরণের জায়গা। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বা গবেষণার চেয়ে সরকারদলীয় আনুগত্য প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতে শিক্ষকতার মান, শিক্ষার্থীদের সুযোগ ও গবেষণার মতো বিষয়গুলো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। গত সাড়ে  ১১ বছরে শেখ হাসিনা সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টায় উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটলেও পুরানো ভূত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দূর হয়নি। অথচ আমরা সকলে বলে থাকি, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও উন্নত গবেষণা হচ্ছে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি। 

বিএনপি-জামায়াত আর স্বৈরশাসকদের আমল ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি অলঙ্কৃত করেছেন বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রথম উপাচার্য স্যার ফিলিপ হার্টগ থেকে শুরু করে আর সি মজুমদার হয়ে হালের অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান পর্যন্ত সেই ধারা বজায় রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।গত এক দশকে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ সরকার যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।  এতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং পদ দুটোই সম্মানিত হয়েছে। তবে যুগের রীতিনীতি পাল্টেছে। একসময় উপাচার্যরা কাজ করতেন নিভৃতে। জনসাধারণের তাদের নাম জানার প্রয়োজন ছিল না। পক্ষান্তরে এখন দেশের উপাচার্যরা হয়ে গেছেন রাজনৈতিক। কারো কারো কাছে প্রশাসনের বিভিন্ন পদ হয়েছে লোভনীয়। বিদেশে উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠন এবং গবেষণায় উৎকর্ষের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে চেষ্টা করেন। এই ব্যাপারে সকলেই তাঁর ওপর আস্থাবান। কাজেই ব্যক্তিটি কে তা জানার কোনো প্রয়োজন পড়ে না সেখানে। অথচ আমাদের দেশে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। একমাত্র ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যদ্বয় নিজেদের মর্যাদা বজায় রাখতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি। 

৫.
সকলে এক কথায় স্বীকার করবেন, শেখ হাসিনা সরকারের সময়োপযোগী শিক্ষানীতি ও এর সফল বাস্তবায়নের সুবাদে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় বরাদ্দ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন এখানকার শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ফ্যাকাল্টি মেম্বার বিশ্বের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গবেষণা করছেন। তাদের গবেষণার ফলাফল নন্দিত হচ্ছে। অনেকেরই গবেষণা ও প্রকাশনা আন্তর্জাতিক মানের। তাঁরা মেধার ভিত্তিতেই সেখানে প্রতিযোগিতা করে টিকে আছেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই বিষয়গুলো সকলে মনে রাখলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব কখনো ম্লান হবে না।

(লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-writermiltonbiswas@gmail.com)