করোনা কালচার - দিদার আলম কল্লোল
বিকেল চারটা হতে না হতেই সাজিন, রাদ, ইরফানরা কলিং বেল বাজিয়ে আলম সাহেবের গিন্নীর নেপিং এ ব্যাঘাত সৃষ্টি করে প্রায়ই তাদের বন্ধু রানু, আনু-কে নিয়েই বেরিয়ে পড়ত। তারা বাসার সামনের প্রসস্থ রাস্তার একপাশে কিংবা ছাদে দলবেঁধে খেলা করত। আনু সপ্তাহে দু'চার দিন আবাহনী মাঠে ও খেলতে যেত। ফুটবল তার ধ্যান জ্ঞান। ঘুমের মধ্যেও সে বলে লাথি মারে। ইউনাইটেড ম্যানচেষ্টার, বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলান ক্লাবসমুহের প্ল্যয়ারদের কার কি পারফরম্যান্স, রেকর্ড, সবই তার মুখস্থ। ছুঁ মেরে মা'র মোবাইলটা নিয়ে গিয়ে ইউরোপিয়ান কাপ খেলা দেখে। দশ বছর বয়সী ছেলের এমন দুরন্তপনা আলম দম্পতি বেশ এনজয় করেন। যতসব বিচিত্র প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা আনুর। এই বয়সে সে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট ইসলামিক চিন্তাবিদদের মত কথা বলে। খুবই হিউম্যারাস। ঠাট্টা মস্করায় উস্তাদ। যাহোক, এত খেলার নেশা যে ছেলেটির সে তিন মাস ঘরবন্দি থাকার পর তার বাবাকে নিয়ে যখন ছাদে গেল, একটু দূর থেকে দেখলো রাদ তার বাবার সাথে খেলা করছে। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে দেখে দৌড়ে গিয়ে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হওয়া মাত্রই তাদের হাত চেপে ধরলেন রাদে-র বাবা ও আনু-র বাবা। কাছে আসা যাবে না, দূর থেকে একটু হ্যালো হাই কর। আহ্ কি নির্মমতা! এরকম একটি প্রানহীন, স্বার্থপর, অচেনা অদ্ভুত পৃথিবী আমাদের নিস্পাপ শিশুরা চায় না। করোনাকাল তাদের শিশুমানস ও মনস্তত্ত্বের উপর কি ভয়ানক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে, মনের গহীনে কি বিরুপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, এসব ভাবতে ভাবতে এবং নিজে নিয়মিত হাঁটতে না পারার দুঃখে আলম সাহেবের বুকে মাঝে মধ্যে চিন চিন করে। এমনিতে একটানা মাসের পর মাস গৃহে অবস্থানের কারণে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কি ধকলটাই না যাচ্ছে। দু'তালা থেকে পাঁচ তালা ছিল তাদের পৃথিবী। এখন আরও সংকোচিত হয়ে গেল। করোনাকাল নাকি দীর্ঘজীবন লাভ করবে। কেন এ পৃথিবীটা শিশুদের জন্যও অনিরাপদ ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠলো। করোনা, মহামারী, সামাজিক দুরত্ব এসব ওদের অবুঝ মন বুঝে না, ওরা শুধু খেলা করতে চায়। এতদিন মানুষ খেলেছে, এখন বোধহয় বিধাতা খেলছেন এ বিশ্বলয়ে আআন-মনে। কে একজন ছাদের ঈষান কোন থেকে স্বগোক্তি করল।
রেশমার স্বামী দীর্ঘদিন পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরছে। প্রিয়তমা স্বামীকে রিসিভ করতে রেশমা একটি ফুলের তোড়া ও কোলের শিশুকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা এয়ারপোর্টে গিয়ে হাজির। এয়ারপোর্টে সে একটু আগেভাগেই এসেছে, টান টান উত্তেজনা আর আবেগে রাতে সে ঘুমাতে পারেনি, কতক্ষনে দেখা পাবে জারিফের বাপের, পরম মমতায় একজন আরেকজনকে কাছে টেনে নিবে। প্লেন একটু বিলন্বে ল্যান্ড করবে, রেশমা মাইকের ঘোষণা শুনছে, আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কাউকে সে চিনতে পারছে না। সবাই মাস্ক বা মুখোশ পরে হাঁটাহাঁটি করছে। একটু দুর থেকেও চিনার কোন উপায় নেই। রেশমার রুপ লাবন্যে বিমোহিত হয়ে কেউ যেন টাস্কি না খেয়ে বসে সেজন্য বছর তিনেক পূর্বে কদম আলী দেশে আসার সময় যে দামি হিজাব নিয়ে এসেছিল, তাই দিয়ে সম্পূর্ণ মুখমন্ডল আবৃত করে সেও এয়ারপোর্টে এসেছে। রেশমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, সে একটা মানুষেরও চেহারা চিনতে পারছে না। মানুষগুলো সব মুখোশধারী হয়ে গেলে সে চিনবে কি করে।
অনেকে রেইনকোটের মত সারা দেহ ঢেকে, চোখে মুখে আরো কতকি পরে বেরুচ্ছে, এত কিম্ভূতকিমাকার মানুষ এর আগে রেশমা দেখেনি। তাঁর চৌদ্দপুরুশের কেউ এই রেইনকোট জাতীয় জিনিসটিকে পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট বা পিপিই বলে শুনেনি। তাঁর নিজের উপরেও রাগ হচ্ছে। আমিও তো নিজেকে সম্পূর্ণ আড়াল করে রেখেছি, আমাকেই বা চিনবে কি করে, রেশমা স্বগোক্তি করে আর উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে তার প্রাননাথ বেরিয়ে আসছে কিনা। যদি তারে নাই চিনিগো, সেকি আমায় চিনে নিবে, এ নব ফাল্গুনের ও দিনে, জানিনে; রেশমা গুন গুন করে গান গায়। অপেক্ষার প্রহর আর কাটে না। আল ইন্তেজারু আশাদ্দু মিনাল মউত, অর্থাৎ অপেক্ষার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। কোলের বাচ্চাটির কান্না এখনো থামেনি। একটু বিরতি দিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে। সে কি তার জন্মদাতা পিতাকে দেখতে পাচ্ছে না বলে কাঁদছে? না, তা নয়। বিমানবন্দরের কনকরর্স হলে ঢোকার সময় কর্তব্যরত কর্মচারী রেশমার হাতে শিশি কাত করে স্যানিটাইজার দেয়, সে বুঝতে পারে না এটা কি সে ছেলের মাথায় দিবে, নাকি তার গায়ে মাখাবে। মা, তুমি তো আমাকে গোসল করিয়ে সরিষার তেল মাখিয়েই নিয়ে এসেছ, এরা আবার তেল দিল কেন? অবুঝ ছেলেটির প্রশ্ন। যেই আরেকজন জ্বর মাপার পিস্তলসদৃশ যন্ত্রটি শিশুটির কপালে তাক করলো এমনি ভয় পেয়ে শিশুটি চিৎকার করে উঠল। নিশ্চয়ই শিশুটির করোনা হয়েছে, না হলে এমন করে কাঁদছে কেন? এই ভয়ে অপেক্ষমান দর্শনার্থী সব রেশমার কাছ থেকে দুরে সরে গেল। রঙ্গিলা মনে মনে ভাবলো, ভালই হয়েছে। এখন কদম আলী নাইনটি ডিগ্ৰী এঙ্গেলে তাকালেও তাকে দেখতে পাবে। তফাতে দাঁড়িয়ে আছে। জেদ্দা থেকে একটি ফ্লাইট এসেছে, রেশমার বহু প্রতীক্ষিত কাতার এয়ারলাইন্স বিমানবন্দর স্পর্শ করতে আরও পনের মিনিট বাকি। মনিটরে দেখতে পায় রেশমা। একে একে ইমিগ্রেশন, কাষ্টমস সেরে যারা বেরিয়ে আসছে তাঁরা মানুষ নাকি এলিয়েন ঝুঝা দায়। এক স্বর্নকেশী স্মার্ট মেয়ে তার প্রিয়জনকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে কাছে গিয়ে হাত বাঁকা করে কনুই এগিয়ে দিল। আগত আপনজনটি ও তাই করল। হাতে হাত নয়, বুকে বুক নয়, একজনের কনুই আরেকজনের কনুই স্পর্শ করে পরস্পর সম্ভাষণ ও আলিঙ্গন জানানোর এ নুতন রীতি কবে থেকে চালু হল, তা রেশমা জানে না। তাহলে কি পৃথিবী বদলে গেছে, যা দেখি নতুন নতুন লাগে। হঠাৎ একটি ঘোষণা শুনে রেশমার মাথায় যেন বাজ পড়লো। এতক্ষণ বাচ্চার কান্দনের ছোটে ভালো করে শুনতে পায়নি। যাত্রীরা তাঁদের স্বজনদের সাথে, হাত মেলানো, কুলাকুলি করতে পারবেন না। একজন আরেকজনের কাছে থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরে থেকে সশ্যাল ডিসটেন্স মেইনটেইন করতে হবে। সব যাত্রীরা এ নিয়ম মেনেই বাসায় গিয়ে ১৪ দিন হোম কোয়ারিন্টিনে ও আইসোলেশনে থাকতে হবে। কোন ধরনের মেলামেশা করা যাবে না, অন্যতায় জেল জরিমানা হবে। এ ঘোষণা শুনে রেশমার সব স্বপ্ন, স্বাদ, আল্লাদ মুহূর্তেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। এতদিন পরে কদম আলী প্রিয়তমাকে হাতের কাছে পেয়ে তার কোমল হাতের একটু স্পর্শ ও পাবে না, তার বাছাধনকে কোলে নিয়ে একটু আদর করতে পারবে না, তা কি করে হয়। না না আমি এ নিয়ম মানি না, এটা হতে পারে না। এ করোনা পীড়িত স্বদেশ আমার না। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। রেশমার চাপা কান্নার শব্দে বিমানবন্দরের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। অতঃপর রেশমার সাথে তার পরিবারের মহামিলনের সকরুণ দৃশ্য লেখকের কল্পনা শক্তিকেও হার মানায়।
দিদার আলম কল্লোল
এডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
ঢাকা, ০৩/০৭/২০২০ ইং
-
গল্প//উপন্যাস
-
03-07-2020
-
-