চিরায়ত বলবিদ্যা থেকে অপেক্ষবাদ - হাসান গোর্কি
অপেক্ষবাদের নাম বলতে পারেন না শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে এমন লোকের সংখ্যা যেমন বিরল, তত্ত্বটি বিষয়ে পরিস্কার ধারণা আছে এমন লোকের সংখ্যাও তেমনি কম। কারণটা হলো এর কোন সহজ পাঠ নেই। ভৌত জগত সম্পর্কে আমাদের প্রাত্যহিক ধারণার সাথে তত্ত্বটি এতটাই বৈপরীত্যপূর্ণ যে কোন পারিপার্শ্বিক উদাহরণ থেকেও এর মূলকথা উদ্ধার করা সহজ নয়। বারট্রান্ড রাসেল তার “এবিসি অব রেলাটিভিটি” (১৯২৫) বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছিলেন, “আইনস্টাইন বিস্ময়কর একটা কিছু করেছিলেন। কিন্তু সেটা আসলে কী সে বিষয়ে ধারণা খুব কম মানুষেরই আছে।” মানব সভ্যতার ইতিহাসে কোন একক ব্যক্তির পক্ষ থেকে করা সবচেয়ে বড় কাজ এটা। বারট্রান্ড রাসেল তার বইটিতে অপেক্ষবাদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার থেকে সহজ করে বলা পরবর্তীতে আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নাই। ডঃ মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল ২০১২ সালে “থিওরি অব রিলেটিভিটি” নামে বাংলায় একটা বই লিখেছেন। এ বিষয়ে আগ্রহীদের জন্য এটা একটা সহায়ক গ্রন্থ হতে পারে যদিও সেখানে কিছু জটিল সমীকরন আছে যা বুঝতে গেলে বিশেষায়িত জ্ঞানের দরকার। তবে গনিতকে পাশ কাটিয়েও এ তত্ত্বের আংশিক পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
এক সময় স্থান, কাল এবং ভরকে পরম বলে ভাবা হতো। এটা ছিল চিরায়ত বলবিদ্যার একটা স্বতঃসিদ্ধ। “ফিলোসোফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ গ্রন্থে নিউটন দাবি করেন, “ সময়ের প্রকৃতি ধ্রুব, বাস্তব এবং গাণিতিক। বাইরের কোন অনুসঙ্গ দিয়ে প্রভাবিত হওয়া ছাড়াই তা নিজে এবং নিজের মধ্যে সুসম গতিতে প্রবাহিত হয়।” আইনস্টাইন বললেন এই তিনটি ধারণার সবগুলোই আপেক্ষিক। পরম স্থান, পরম কাল এবং পরম ভর বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। মুলত এই মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই তিনি তার অপেক্ষবাদ প্রনয়ন করেন। ১৯০৫ সালে “ইলেক্ট্রডাইনামিক্স অব মুভিং বডিস” নামক পেপারে তিনি প্রস্তাব করেন বিশেষ অপেক্ষবাদের। তাতে তিনি দাবি করলেন (১) সমবেগে চলমান সকল পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মাবলী অভিন্ন এবং (২) আলোর গতিবেগ সকল পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে ধ্রুব (যদি তা শুন্য মাধ্যমে চলে) এবং তা আলোর উৎস এবং পর্যবেক্ষকের গতির সাথে নিরপেক্ষ। সূত্রের প্রথম অংশ থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে অসমবেগে চলমান সকল পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মাবলী ভিন্ন। তাহলে কি ভিন্ন ভিন্ন গতিতে চলমান দুইজন পর্যবেক্ষকের কাছে পদার্থবিজ্ঞান ভিন্ন আচরন করবে? হ্যাঁ। ব্যাপারটা আসলেই তাই।
অপেক্ষবাদ বলছে, একজন চলন্ত পর্যবেক্ষকের সময় একজন স্থির পর্যবেক্ষকের চেয়ে ধীর গতিতে চলে। ধরা যাক আপনি একটা বিমানে করে ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে এলেন। যাবার সময় আপনি দুটো ঘড়ির সময় মিলিয়ে একটা বাসায় রেখে গেলেন। ফিরে এসে সময় মেলাতে গেলে দেখবেন আপনার ঘড়িটা ৮ ন্যানো সেকেন্ড স্লো। ন্যানো সেকেন্ড হলো এক সেকেন্ডের একশ কোটি ভাগের এক ভাগ সময়। অর্থাৎ গতিশীল থাকার কারণে পৃথিবীতে বসে থাকা আপনার বন্ধুদের চেয়ে আপনি কিছুটা বেশি সময় কাটিয়ে ফেললেন। এই অতিরিক্ত সময়টুকু এসেছে কাল প্রসরণ থেকে। কোন কিছুর গতি যত বৃদ্ধি পাবে তার সময় তত বেশি সম্প্রসারিত হবে। আপনি যদি আলোর গতির ৯৯% গতিতে চলতে পারে এমন কোন মহাকাশযানে করে দূরের কোন নক্ষত্রে বেড়াতে যান তাহলে আপনি কাল প্রসরণের সুবিধা পাবেন ৭০০ গুন। এক হাজার বছর পর ফিরে এলে আপনি দেখবেন পৃথিবীতে মোটে ১৬ মাস সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। আপনার মহাকাশযানের গতি যদি আলোর গতির আরও কাছাকাছি (ধরে নেওয়া যাক ৯৯.৯৯৯%) নিয়ে যেতে পারেন তাহলে মহাকাশে হাজার দশেক বছর কাটিয়ে এসে দেখবেন আপনার সাথে টেবিলে যারা সকালের নাস্তা করতে বসেছিল তাদের কেউ কেউ টেবিলেই বসে আছে। চা পান করছে। এই সময়ের মধ্যে হয়তো আপনি কয়েকশ গ্রহে গেছেন, সেখানে বাড়িঘর তৈরি করে বসবাস করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, বিয়ে করে ছেলেমেয়ের বাবা বা মা হয়েছেন। খাবার টেবিলের কেউ এই কথাটা বিশ্বাস করবে না। তারা ভাববে আপনি বাথরুমের বেসিনে হাত ধুতে গিয়েছিলেন।
বিষয়গুলো বাহ্যত গোলমেলে। আগেই বলেছি অপেক্ষবাদ বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো আমাদের পারিপার্শ্ব থেকে উপযুক্ত উদাহরনের অভাব। ধরা যাক হাসান এবং হোসেন একইসাথে জন্মগ্রহন করে ৬০ বছর পর একইসাথে মারা গেল। হাসান যে ঘরে জন্মগ্রহন করেছিল সে ঘর থেকে জীবনে কখনও বাইরে যায়নি। হোসেন প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে বিমানে ভ্রমন করেছে। হিসেব করলে দেখা যাবে হাসানের চেয়ে হোসেন দশ মাইক্রো সেকেন্ড বেশি সময় পৃথিবীতে জীবিত ছিল। আর তাদের জীবনকাল যদি ৬০ কোটি বছর ধরা হয় তাহলে হাসানের চেয়ে হোসেন ৬০০ কোটি মাইক্রো সেকেন্ড বা ১০০ মিনিট সময় বেশি সময় উপভোগ করবে। আমরা তো বলছি তারা একসাথে জন্মগ্রহন করে একসাথে মরে যাবে। তাহলে হোসেন এই অতিরিক্ত ১০০ মিনিট সময় কোথায় পাবে? হ্যাঁ। সে এই ১০০ মিনিট পাবে কাল প্রসরণ থেকে। উচ্চ গতির কোন যানবাহনে ভ্রমন করলে কম দিনে কাল প্রসরণের বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে। যেমন রাশান মহাকাশচারী সেরগেই ক্রিকলায়েভ একনাগাড়ে ৮০৩ দিন একটা মহাকাশযানে করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছেন যেটার গতি ছিল সেকেন্ডে সাড়ে পাঁচ মাইল। অভিযান শেষে তিনি দেখতে পেলেন তার ঘড়ি পৃথিবীর অন্য ঘড়িগুলোর তুলনায় ০.০২ সেকেন্ড পিছিয়ে আছে। পুরা এক সেকেন্ডের কাল প্রসরণ উপভোগ করতে চাইলে ক্রিকলায়েভকে ঐ মহাকাশযানে কাটাতে হতো ১০৯ বছর। ভৌত জগত সম্পর্কে ধারণা পাবার ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা সময় সম্পর্কিত আমাদের ধারণা। সময়কে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই তিন স্তরে ভাগ করাকে আইনস্টাইন ব্যাখ্যা করেছেন বিভ্রম হিসেবে; তার ভাষায় ‘স্টাবরনলি পারসিস্টেন্ট ইলিউশন’। বাংলা করলে দাঁড়ায় স্থির নিবিষ্টভাবে ধারাবাহিক বিভ্রম। চিরায়ত বলবিদ্যায় সময় ছিল ধ্রুব। যেমন যে কোন একটি নিদিষ্ট সময়ের দৈর্ঘ সকল পর্যবেক্ষক সাপেক্ষে একই। অপেক্ষবাদ বলছে পর্যবেক্ষক সাপেক্ষে সময়ের দৈর্ঘ ভিন্ন হবে। একজন স্থির পর্যবেক্ষকের দুই মিনিট একজন গতিশীল পর্যবেক্ষকের দুই ঘণ্টা, দুইশ বছর বা দুই হাজার বছরের সমান হতে পারে। চিরায়ত বলবিদ্যা সময়কে বাস্তব এবং একই অর্থে পরম বলে ধরে নিয়েছিল। অপেক্ষবাদের ধারনায় কীভাবে সেটাকে আপেক্ষিক বলা হল সে বিষয়ে পরের অনুচ্ছেদে কিছু আলোচনা করা যাবে। তার আগে দেখা যাক সময় গানিতিক নয় কীভাবে। দুই মিনিটের সাথে দুই মিনিট যোগ করলে ফলাফল চার মিনিট পাবার কথা। কিন্তু সেটা সবসময় পাওয়া যায় না। আমি ঘরে বসে আমার ঘড়ি ধরে দুই মিনিট কাটালাম এবং আমার বন্ধু ০.৯৯c গতিতে চলমান মহাকাশ যানে দুই মিনিট কাটালো। আমাদের অতিবাহিত করা সময়কে যোগ করলে চার মিনিট পাবার কথা। কিন্তু কাল প্রসরণের সুবিধা পেয়ে আমার বন্ধু ঐ দুই মিনিটের মধ্যেই কাটিয়ে ফেলবে ২৩ ঘণ্টা ২০ সেকেন্ড। চিরায়ত বলবিদ্যার চার মিনিটে আমরা দুই বন্ধু বাস্তবে কাটিয়ে ফেলব ২৩ ঘণ্টা ২ মিনিট ২০ সেকেন্ড।
বিশেষ অপেক্ষবাদের দ্বিতীয় অংশে বলা হচ্ছে আলোর গতিবেগ সকল পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে ধ্রুব। একটা আটপৌরে উদাহরন থেকে এই কথাটা বোঝার চেষ্টা করা যাক। পাশাপাশি লাইনে বিপরীতমুখী দুটি ট্রেনের গতি যদি ৬০কিমি/ঘণ্টা এবং ৪০কিমি/ঘণ্টা হয় তাহলে ট্রেন দুটি পরস্পরকে ১০০ কিমি/ ঘণ্টা গতিতে অতিক্রম করবে। ট্রেন দুটি যদি ২০০০০০ কিমি/সেকেন্ড এবং ২৫০০০০ কিমি/সেকেন্ড গতিতে বিপরীতদিকে চলে তাহলে তারা পরস্পরকে (২০০০০০+২৫০০০০=) ৪৫০০০০ কিমি/ সেকেন্ড গতিতে অতিক্রম করার কথা। কিন্তু অপেক্ষবাদ বলছে তারা পরস্পরকে ৩০০০০০কিমি/ সেকেন্ড গতিতে অতিক্রম করতে দেখবে। কারণ এটাই পরম গতি। আবার ধরে নেওয়া যাক কেউ একজন মঙ্গলগ্রহে বসে পৃথিবীর দিকে মুখ করে একটা টর্চ জ্বালিয়ে রেখেছে। আমরাও তাকে লক্ষ্য করে একটা টর্চ জ্বালালাম। প্রচলিত গনিত অনুযায়ী টর্চ দুটির আলো পরস্পরকে ছয় লাখ কিমি/ সেকেন্ড গতিতে অতিক্রম করার কথা। কিন্তু তা ঘটবে না। আলোকরশ্মি দুটোর অনুভূতি থাকলে তারা দেখত তারা পরস্পরকে তিন লাখ কিমি/ সেকেন্ড গতিতে অতিক্রম করছে।
ছবিঃ গুগল ইমেজ (ওপেন সোর্স) থেকে সংগৃহীত।
এই ছবিটিতে দেখুন তিনজন পর্যবেক্ষকের দুইজন আলোর গতির ৮০ ও ৯০ শতাংশ গতিতে পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসছে। অবজারভার A তার হাতে থাকা টর্চ লাইটটি অবজারভার B-এর দিকে তাক করে জ্বালিয়ে রেখেছে। অবজারভার ‘B’-র কাছে আলোর গতি ( c+.৯c+.৮c=) ২.৭c মনে হবার কথা। অবজারভার A-র কাছে আলোর গতি ( C- .9C=) 0.1C মনে হবার কথা। এবং অবজারভার ‘C’-র কাছে সেটা ( c+.৯c=) ১.৯c মনে হবার কথা। কিন্তু এই তিনজন দর্শকের সবাই ঐ টর্চের আলোকে সমান গতিতে (C বা ৩০০০০০কিমি বা ১৮৬০০০ মাইল/সে) চলতে দেখবে। তাহলে কি আমাদের মানতে হবে দুই আর দুই যোগ করলে তিন হয়? হ্যাঁ। অপেক্ষবাদ মানলে যে সেটাও ক্ষেত্র বিশেষে মানতে হবে উপরের হিসেব থেকে আমরা তা বুঝেছি।
অপেক্ষবাদ বলছে স্থান পরম নয়। গতির অভিমুখে গতিশীল বস্তুর দৈর্ঘের সংকোচন ঘটে। অর্থাৎ সময়ের মত স্থানও গতির বৃদ্ধির সাথে সংকুচিত হয়। অপেক্ষবাদের পাঠে বহুল ব্যবহৃত এই উদাহরনটি দেখুন। ধরা যাক এক ব্যক্তি হাতে ২০০ ফুট লম্বা একটা লাঠি নিয়ে রাস্তা দিয়ে আলোর গতির ৯৯% গতিতে দৌড়াচ্ছে। সে যে রাস্তায় দৌড়াচ্ছে সেটা ১০০ ফুট লম্বা একটা ঘরের মধ্যে দিয়ে গেছে। লোকটির হাতে থাকা লাঠিটির মাথা যখন ঘরের শেষ প্রান্তে পৌঁছুবে তখন যদি ঘরের দুই দিকের দুটি দরজাই একসাথে বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় তাহলে তা করা যাবে, যদিও তা খুব কম সময়ের জন্যে। ধরে নেওয়া যাক দরজা দুটি আমরা ০.০০১ ন্যানো সেকেন্ডের জন্য বা এক সেকেন্ডের এক লাখ কোটি ভাগের এক ভাগ সময়ের জন্য বন্ধ করে খুলে দিলাম। কাজটি করতে হবে লোকটির দৌড়ানোর গতিকে কোনরকমভাবে ব্যাহত না করেই। এক্ষেত্রে আমরা দেখব ২০০ ফুট লাঠিটি ১০০ ফুট লম্বা ঘরের মধ্যে ধরে গিয়েছিল। অর্থাৎ অতি উচ্চ গতির কারণে লাঠিটির দৈর্ঘ ৫০% কমে গিয়েছে।
তৃতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিশেষ অপেক্ষবাদের স্বতঃসিদ্ধ বলে দাবি করা হলো সেটা বস্তুর ভর সম্পর্কিত। আইনস্টাইন বললেন বস্তুর ভর পরম নয়; ভরকে শক্তিতে এবং শক্তিকে ভরে রুপান্তর করা সম্ভব। কোন বস্তুতে কী পরিমান শক্তি নিহিত থাকে সেটা নির্ণয় করার একটা সমীকরণও তিনি বের করে ফেললেনঃ E= mc² । এখানে m হলো বস্তুর ভর, c হলো আলোর বেগ এবং E হলো প্রাপ্ত শক্তির পরিমান। অর্থাৎ কোন বস্তুর ভরকে আলোর বেগের বর্গ দিয়ে গুন করলে যে রাশি পাওয়া যাবে সেটা ঐ বস্তুর শক্তির সমরুপ। এই সূত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে একটা ক্ষুদ্র ভরই বিপুল শক্তির জন্ম দিতে পারে। পরমাণু বোমার ক্ষেত্রে আমরা এর নমুনা পাই। হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমায় যে ইউরেনিয়াম-২৩৫ ব্যবহার করা হয়েছিল তার ফিউশনযোগ্য অংশের পরিমান ছিল আধা কেজির কিছু বেশি। আর এই বোমার ধ্বংস ক্ষমতা ছিল ১৫ কিলোটন টিএনটি-র সমান। এই একই প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ (এনরিচড) ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার রিএক্টরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
১৯০৫ সালে আইনস্টাইন যখন স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশ করেন তখন তিনি বিখ্যাত কেউ নন। সুইস পেটেন্ট অফিসে পেটেন্ট ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে এই ধরণের পদকে পেটেন্ট এক্সেমিনার বলা হয়। তাদের কাজ হলো নতুন কোন আবিস্কারের জন্য কেউ পেটেন্টের আবেদন করলে পরীক্ষা করে দেখা যে আবিস্কারটা আসলেই মৌলিক কিনা। এই চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি তার গবেষণাপত্র গুলো তৈরি করেন।
এবার দেখা যাক আইনস্টাইনের সাধারন অপেক্ষবাদ কী বলে। এটি আসলে তার মহাকর্ষ বিষয়ক তত্ত্ব যা তিনি ১৯০৭ থেকে ‘১৯১৫ সালের মধ্যে বিকশিত করেন। এসময় তিনি বার্ন ও জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯১৬ সালে তিনি “দ্য ফাউন্ডেশন অব দ্য জেনারেল থিওরি অব রেলেটিভিটি” নামক গবেষণাপত্রে তিনটি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেনঃ
(১) সময় উচ্চতর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে আরও বেশি স্লথ। (২) মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের উপস্থিতিতে আলোর গতিপথ বেঁকে যায়। এবং (৩) মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে কেন্দ্র থেকে গ্যালাক্সিসমূহের দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক হারে।
পুরাতন ধারনার বিপরীতে আইনস্টাইন বললেন মহাকর্ষ কোন বল নয়; এটি হলো স্থান-কালের বক্রতা। তিনি আরও বললেন স্থান ও কাল আলাদা কিছু নয়। স্থানের তিনটি ডাইমেনশন- দৈর্ঘ, প্রস্থ এবং উচ্চতার সাথে চতুর্থ ডাইমেনশন ‘সময়’ যুক্ত থাকে। তাই উচ্চতর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে স্থানের সংকোচন ঘটার অর্থ সময়েরও সংকোচন ঘটা। সময় সংকোচনের সবচেয়ে ভাল উদাহরন হলো ব্ল্যাক হোল। এদের ভর এত বেশি যে আশপাশের সবকিছু এমনকি পাশ দিয়ে ছুটে চলা আলোক রশ্মিকেও এরা গিলে ফেলে। আলো এর মধ্যে ঢোকার পর আর বের হতে পারেনা। ফলে সময় সেখানে স্থির হয়ে যায়। এটা অনেকটা গ্রামের বিলে মাছ ধরার মত। বিলের মধ্যে ছোট একটা পুকুর তৈরি করে তার প্রবেশমুখে ৯০ ডিগ্রী কোনে দুটি বেড়া স্থাপন করা হয়। ঐ বেড়া ঠেলে মাছেরা ঐ পুকুরে প্রবেশ করতে পারে কিন্তু বাইরে আসতে পারেনা। ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্ত অনেকটা ঐ বেড়ার মত যার বিপরীত দিকের ঘটনা বিষয়ে আমাদের কোন ধারণা পাবার আশা নেই।
একসময় মনে করা হতো আলো যেহেতু একটি তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ সে সবসময় সরল রেখায় চলবে। আপেক্ষিকতার সাধারন তত্ত্বে বলা হলো অতি উচ্চ ভরের বস্তুর (যেমন সূর্য) পাশ দিয়ে চলার সময় আলোর পথ কিছুটা বেঁকে যায়।
ওপরের ছবিতে দেখুন একটা তারকার আলো সূর্যকে অতিক্রম করার সময় বেঁকে গেছে। ফলে তাকে আমরা তার প্রকৃত অবস্থানে না দেখে অন্য একটা অবস্থানে দেখছি।
১৯১৯ সালের ১৯ মে তারিখের পূর্ণ সূর্য গ্রহনের সময় স্যার আরথার এডিংটন এ বিষয়ে একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তিনি হিসেব করে দেখলেন গ্রহনের সময় হায়াডিস তারা স্তবকের অবস্থান হবার কথা সূর্যের ঠিক পেছনে। ঐ নক্ষত্রমন্ডলীকে পৃথিবী থেকে দেখা যাবে যদি সেখান থেকে বিচ্ছুরিত আলো কিছুটা বাঁকা পথে চলে। সূর্য গ্রহনের সময় আবছা অন্ধকারে এডিংটন তার দূরবীন দিয়ে ঐ তারা স্তবককে দেখলেন এবং নিশ্চিত হলেন যে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের উপস্থিতিতে আলোর গতিপথ বেঁকে যায়।
সাধারণ অপেক্ষবাদে আইনস্টাইন আরও বললেন মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে এবং কাছের গ্যালাক্সিগুলোর চেয়ে দূরের গ্যালাক্সিগুলো বেশি গতিতে পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্বের কেন্দ্র (কাল্পনিক) থেকে যে গ্যালাক্সি যত দূরে তার ছুটে চলার গতি তত বেশি। ১৯৩৭ সালে রেডিও টেলিস্কোপ আবিস্কৃত হবার পর থেকে এই সম্প্রসারনের গতি বিষয়ে ধারণা পাবার চেষ্টা চলছে। বিজ্ঞানীরা ‘ডপলার সরণ’ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে হিসেব করে দেখেছেন মহাবিশ্বের প্রায় প্রান্ত সীমায় যে সকল গ্যালাক্সির অবস্থান চিহ্নিত করা গেছে সেগুলো ছুটছে আলোর গতির প্রায় নব্বই শতাংশ গতিতে। কোন বস্তু যদি আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে তাহলে আমরা তার আলোর বর্ণালীরেখার বিচ্যূতি দেখবো লালের দিকে আর কাছে আসতে থাকলে বিচ্যুতি ঘটবে বেগুনির দিকে। বর্ণালীবিক্ষণের মাধ্যমে সরণ মাপার এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ডপলার সরণ’ পদ্ধতি। এভাবে মহাবিশ্বের আয়তন প্রতি মিনিটে বাড়ছে এক লক্ষ কোটি ঘন আলোক বছর যা আমাদের পুরো গ্যালাক্সির আয়তনের দশগুণ। এ হিসেবে মহাবিশ্বের আয়তন প্রতি সেকেন্ডে যে হারে বাড়ছে তার পরিমাণ দশ লাখ কোটি সৌরজগতের আয়তনের সমান। সম্প্রসারণের এই ভয়াবহ চিত্রটা মাথায় নিতে চেষ্টা করা অর্থহীন। তাই আপাতত এখানেই ক্ষান্ত দেয়া যাক।
শেষ করা যাক আইনস্টাইনের শিশুবেলার একটা গল্প দিয়েঃ-
আইনস্টাইনের বয়স তিন বছর হওয়া পর্যন্ত তিনি কোন কথা বলেননি। ফলে তাঁর মা-বাবা খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। একদিন রাতে খাবার টেবিলে সবাই আছেন। আইনস্টাইনও। টেবিলে অন্য কিছু খাদ্যের সাথে স্যুপ দেওয়া হয়েছে। স্যুপ মুখে দিয়ে হঠাৎ তিনি চিত্কার করে বললেন, ‘এই স্যুপটা খুবই গরম।’ উহ্, হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন মা-বাবা। ছেলের মুখে প্রথম বুলি শুনে তাঁরা আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর আগে কেন তুমি কোনো কথা বলোনি?’ জবাবে আইনস্টাইন বললেন, ‘কারণ, এর আগে সবকিছু ঠিকঠাক ছিল!’
ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা
hassangorkii@yahoo.com
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন
গল্পঃ দ্ব্যর্থক - হাসান গোর্কি
-
নিবন্ধ // মতামত
-
24-07-2017
-
-