দ্ব্যর্থক - হাসান গোর্কি
দ্ব্যর্থক
- হাসান গোর্কি
সময়টা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। দুপুরের শৈত্যক্লান্ত ক্যাম্পাসটা অনেকখানি জনশূন্য হয়ে পড়েছে। দুটো দশের কন্টিনেন্টাল লিটারেচারের ক্লাশ শেষে বাবলাতলার সংক্ষিপ্ত পথ বেয়ে হলে ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, একটা জারুল গাছের অগভীর ছায়ায় টিপু শুয়ে আছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। পাতার ফাঁক দিয়ে কিছুটা সূর্যের আলো এসে পড়েছে ওর মুখে। টিপুকে ডাকলাম। ঘুম থেকে জেগে খুব সহজ ভঙ্গিতে সে চোখ খুলে তাকাল । বলল
─ বস।
আমার কৌতূহল হলো। জিজ্ঞেস করলাম
─ এখানে ঘুমোচ্ছিস কেন?
আমার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে সে বলল
─ ঘুমোবি? শুয়ে পড়।
এমন সৃষ্টিছাড়া আহবান কে আর শোনে! আমি আমার রুমে চলে গেলাম। জানালা খুলে স্টেশন বাজারের পেছনের পুকুরটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কয়েকটা দাঁড়কাক কাদা পানিতে স্নান করছে। ক্যাসেট প্লেয়ারটা চালু করে দিলাম : কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গাইছে : ‘আমার জীবন পাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরি করেছ দান’। এমন দরদ দিয়েও মানুষ গান গাইতে পারে! তার চেয়েও বড় হলো গানের কথা। কি অদ্ভুত শব্দচয়ন: ‘জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া...।’ গভীর মনযোগ দিয়ে শুনছিলাম। তারপরও মনটা বিক্ষিপ্ত। কেন তা জানিনা। মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়াই আমার এরকম হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুমোতে চেষ্টা করলাম। কিছুটা তন্দ্রা এসেছে। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। দরজা খুলে দেখলাম টিপু দাঁড়িয়ে আছে। বলল
─ পদ্মায় যাবি?
অনেকদিন ওদিকটায় যাই না। ভাবলাম, হেঁটে আসি কিছুক্ষণ। আমাদের হল থেকে পদ্মার বাঁধের দূরত্ব আধা মাইল। পদ্মার পাড়ে যখন পৌঁছুলাম তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। টিপু বলল
─ পাথরচরা যাবি?
পাথরচরার দূরত্ব কমপক্ষে পাঁচ মাইল। কোন রাস্তাঘাট নেই। পুরো পদ্মার চর দিয়ে কখনও হেঁটে কখনও নৌকায় যেতে হয়। তাই এরকম একটা প্রস্তাবে কিছুটা বিস্মিত হলাম। বললাম
─ পাথরচরায় কী কাজ?
─ গেলেই জানবি। তোর বিশেষ কোন কাজ না থাকলে চল যাই।
বিষয়টা আমার কাছে এ্যাডভেঞ্চারের মত মনে হলো। রাজী হয়ে গেলাম টিপুর প্রস্তাবে। বাঁধের ওপরের একটা টং দোকানে চা খেয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম দক্ষিণমুখী। একটু পরেই টিপু শহর রক্ষা বাঁধ ছেড়ে পদ্মার চরে নেমে গেল। আমি নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করলাম। আমরা চরের বিস্তীর্ণ অদলিত বালুকারাশির ওপর দিয়ে পশ্চিম দিকে হেঁটে যাচ্ছি। পৌষের পানিশূন্যতায় চরের দৈর্ঘ্য- প্রস্থ বেড়েছে। জনমানবহীন এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলটা যে প্রকৃতপক্ষে প্রমত্তা পদ্মার তলদেশ তা ভাবতেই অবাক লাগে। কিছু নামগোত্রহীন কাঁটাগুল্ম জন্মেছে চরের উষর প্রান্তর জুড়ে। ওরা বেঁচে থাকবে আরো কিছুদিন। বর্ষায় ওদের জীবনাবসান। শীতে পূণর্জন্ম। টিপুর পায়ে একটা দামী বিদেশী কেডস, পরনে ব্লু জিনস প্যান্ট, গায়ে সাদা সোয়েটার। ভীষণ অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সে হেঁটে যাচ্ছে। মনে হলো, এটা তার অনেক পরিচিত পথ। চরের উঁচু নিচু বাঁক, উপত্যকার মত ঢালগুলো সে চিরচেনা পথের মত পাড়ি দিচ্ছে। আমি বললাম
─ টিপু পাথরচরায় কী কাজ?
সে পকেট থেকে গোল্ড লিফের প্যাকেট এবং লাইটার বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল
─ কাজ আছে, ব্যস্ত হচ্ছিস কেন!
আমি জানি টিপু মোটেই হিসেবী মানুষ নয়। তার বেশীরভাগ কাজের পেছনে কোন উদ্দেশ্য থাকে না, পরিকল্পনা থাকে না। সবচেয়ে বেহিসেবী সে পড়াশোনার ক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর থেকেই দেখছি, সে ক্লাশ বাদ দিয়ে লাইব্রেরিতে বসে এনসাইক্লোপিড়িয়া পড়ে; কখনও সকাল থেকে সন্ধ্যা। আমি কথা না বাড়িয়ে ওকে অনুসরণ করতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা একটা খাড়ির সামনে হাজির হলাম। কুয়াশার কারণে খাড়ির প্রশস্ততা অনুমান করতে পারলাম না। লম্বা বাঁশের সাথে একটা ভিঙি নৌকা বাঁধা ছিল। টিপু অবলীলায় গিয়ে নৌকায় উঠল। আমিও উঠে বসলাম। মাঝি নেই। আশেপাশে কোন লোকজনও নেই। টিপু বলল
─ দাঁড় টানতে পারিস?
বললাম
─ পারি না।
টিপু গলুইয়ে বসে দাঁড় টানতে শুরু করল। বেসুরো উচ্চ কণ্ঠে গান ধরল সে─ মেরা জীবন কোরা কাগজ...। এ গানটি সে সবসময়ই গায়। ওর পছন্দের গান। অনেকবার জিজ্ঞেস করেও পছন্দের কারণ জানতে পারিনি। আমরা খাড়ির অপর পাড়ে পৌঁছুলাম মিনিট পনেরর মধ্যে। সে দাঁড়টা উল্টো করে বালিতে পুঁতে রশি দিয়ে নৌকাটা বেঁধে ফেলল। আমরা আবার হাঁটতে থাকলাম। তখন রাত দশটার কাছাকাছি হবে। একটা লম্বা কাশবনের মধ্যে টিপু ঢুকে পড়ল। আমি ওর পেছনে পেছনে ঢুকলাম। সরু পথ। মানুষের চলাচল আছে বোঝা যায়। বাতাসে আন্দোলিত কাশের পাতাগুলো হঠাৎ শিনশিন শব্দ করে উঠল। ভূতের পায়ের পাতাগুলো নাকি পেছনের দিকে থাকে। আমি টিপুর পায়ের দিকে ভাল করে তাকালাম। দেখলাম ওর পায়ের পাতা সামনের দিকে।
কাশবন পেরিয়ে টিপু তার বিখ্যাত কাল্পনিক চরিত্রের গল্পটা বলতে শুরু করল। একজন মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের গল্প। আলেকজান্দ্রিয়ায় নাকি একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ গভীর রাতে হীরার তরবারি হাতে লোকালয়ে ঘুরে বেড়ায়। বিগত আড়াই হাজার বছর ধরে সে জীবিত। একদিন ‘নিশিতে পাওয়া’ অবস্থায় সে নাকি সমুদ্রে স্নান করে অমরত্ব লাভ করেছে। এখন সে প্রতি বছর একজন করে বৃদ্ধের রক্ত পান করে। এটাই তার সারা বছরের খাবার। আজও সেরকম একটা রক্ত পানের কাহিনী বলল টিপু। অন্যসময় গল্পটা আমার বিরক্তি উৎপাদন করে। কিন্তু আমি কখনই রুষ্ট হই না। কারণ টিপুর সাথে আমার বন্ধুত্বের ভিত্তিটা হলো ওর অর্বাচীনতা। কিন্তু এবার গল্পটা শোনার পর আমার গা ছমছম করে উঠল। মনে হলো, টিপু কি সেই নিশিতে পাওয়া মানুষ নাকি! কাশবন পেরিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বললাম
─ টিপু , আর হাঁটতে পারছিনা। চল এবার ফিরে যাই।
সে খুব সহজ করে বলল
─ এই তো এসে গেছি। এই সামনের চরটা পার হলেই গঙ্গাচরা; তারপরেই পাথরচরা। ওখানে না গেলে তুই বুঝবি না কেন তোকে এত করে যেতে বলছি। সত্যিই দেখিস ওখান থেকে তোর আর আসতে ইচ্ছে করবে না।
টিপুর কণ্ঠের স্বাভাবিকতায় সাহস ফিরে পেলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা আর একটা খাড়ির সামনে এসে হাজির হলাম। আমি বললাম
─ এখানে তো কোন নৌকা নেই। কি করে যাবি?
টিপু বলল
─ অসুবিধা নেই। পানি খুবই কম। হেঁটেই পার হওয়া যায়।
কেডস খুলে ঐ বরফ শীতল পানিতে নেমে পড়লাম। পৌষের শ্রীহীন, নির্জীব পদ্মা। স্রোত নেই। কিন্তু বালিতে পা রাখা যায় না। চোরাবালির মত মুহূর্তে গর্ত হয়ে যায়। বেশ কষ্টে খাড়ি পার হয়ে ওপাড়ে উঠলাম। পা জোড়া অবশ হয়ে গেছে। নাড়াতে পারছি না। কিন্তু ততক্ষণে পাথরচরার কি এক দুর্দমনীয় আকর্ষণ আমাকেও পেয়ে বসেছে। মোহাবিষ্টের মত হাঁটতে শুরু করলাম টিপুর সাথে। এক সময় পাথরচরা পৌঁছুলাম। অনেক উঁচু চর। কিন্তু জনবসতি নেই। এরকম উঁচু চরে জনপদ গড়ে ওঠার কথা ছিল। ওঠেনি; কেন কে জানে। চরের উঁচু ঢালের ওপরে কিছু ঝোপঝাড়। তার পাশে একটা খড়ের গাদা। কেউ যত্ন করে তৈরি করে রেখেছে। টিপু ঐ খড়ের গাদার ওপর গিয়ে শুয়ে পড়ল। আমাকে বলল
─ চলে আয় এখানে।
আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। আমাকে শুয়ে পড়ার জন্যে সে পীড়াপীড়ি করতে থাকল। আমি বসেই রইলাম। টিপু আকাশের দিকে তাকিয়ে গান শুরু করল─ মেরা জীবন কোরা কাগজ...। খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখন মধ্যরাত্রি পার হয়ে গেছে। ভীষণ গতিতে মেঘখণ্ডগুলো ছুটে চলেছে দক্ষিণে। মনে হচ্ছে চাঁদটাই উত্তর দিকে ছুটে যাচ্ছে। মহাশূন্যের কি ভীষণ জনশূন্যতার মধ্যে চাঁদটা বাস করে! কোন সঙ্গ নেই, প্রতিবেশী নেই, পারিপার্শ্বও নেই। আমাদের চারপাশের নির্জনতাটাও কিছুটা সেরকম। গান শেষ হলে টিপু বলল
─ একটা ভূতের গল্প শুনবি?
আমরা যে ভৌতিক পরিবেশের মধ্যে আছি, কোন গল্পের বিষয় তার থেকে ভৌতিক হতে পারে না। আমার একটুও ভয় লাগল না। বললাম
─ বল।
বানিয়ে বানিয়ে টিপু একটা ভূতের গল্প বলল। তার সব গল্পের শুরুটা একঃ ‘গভীর রাত। চারিদিকে অন্ধকার, কোথাও কোন জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই...।’ এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না। সে এক দম্পতির শিশু সন্তানের গল্প বলল। ঐ শিশু নাকি প্রতি রাতে একটা করে বেড়াল মেরে তার রক্ত পান করত। একদিন ঐ দম্পতি শিশুটিকে রক্তপানরত দেখতে পেয়ে ভয়ে পালাতে গেলে শিশুটি বাবা-মা দু’জনেরই ঘাড় ভেঙে দেয়। তারা মারা যায়। মনে মনে ভাবলাম, বাবা- মা দু’জন-ই যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে ঘটনাটা পরে জানা গেল কীভাবে। কিন্তু কিছু বললাম না। কারণ ঐ ধরনের ছেলে ভুলানো গল্পই টিপু সবসময় বলে। বলার ধরন দেখে মনে হয়, গল্পগুলো সে বিশ্বাসও করে। আর সে ধরেই নেয়, যাকে সে গল্পটা বলছে সে-ও সেটা বিশ্বাস করছে আদ্যপান্ত।
এই শিশুসুলভ আচরণের জন্যেই তার সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এই কর্মব্যস্ত একবিংশ শতাব্দীতে একজন মানুষ যে কতখানি জীবনবিমুখ হতে পারে তা টিপুকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এই হাড় কাঁপানো শীতের রাতে, লোকালয় থেকে এতটা পথ হেঁটে এসে, পাথরচরার এই অপার্থিবতার মধ্যে কিসের শান্তি খুঁজে পাচ্ছে সে! এ কেমন সুখের অন্বেষণ! দূর থেকে ভেঙে পড়া ঢেউয়ের কলকল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল এ মুহূর্তে থেমে গেছে, শুধু এই জলধ্বনি ছাড়া। টিপু বলল
─ জায়গাটা খুব চমৎকার। কি বলিস?
এরকম নিশ্চিন্তে. এমন নিমগ্নতা নিয়ে আমি আর কখনও প্রকৃতির দিকে তাকাইনি। প্রকৃতির যে নিজস্ব একটা ভাষা আছে, তার যে নিজস্ব একটা ধ্বনি আছে তা ঐ মুহূর্তে অনুভব করলাম। নদীর জলধারা, খয়ে যাওয়া চাঁদ, খড়ের গাদা, মেঘখণ্ড, বিস্তৃত বালির চর─ এ সব কিছুর মধ্যে একটা ঐক্যের সুর যেন চারদিকে ছড়িয়ে আছে। খড়ের একটা ছোট গাদা তৈরি করে বুকের নিচে দিয়ে টিপু উপুর হয়ে শুয়ে আছে। আমার ঘুম পাচ্ছিল। টিপুকে ডাকলাম। ও জবাব দিল না। পিঠে হাত দিয়ে নাড়া দিলাম। দেখলাম, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি খড়ের গাদার মধ্যে পুরো শরীরটা ঢুকিয়ে দিলাম। উষ্ণতা অনুভব করলাম একটু একটু। তন্দ্রা এসে গেল তাড়াতাড়িই।
কাত হয়ে শুয়ে টিপুর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, কেমন বিস্ময়কর ওর জীবনপদ্ধতি। মা- বাবার সাথে যোগাযোগ নেই। ভাই- বোন কোথায় থাকে তার কোন খোঁজখবর সে জানে না। খাওয়া দাওয়া ঘুম গোসল কোন কিছুই নিয়মমাফিক চলে না তার। তাকিয়ে দেখলাম, বেঘোরে ঘুমোচ্ছে টিপু। ঘুমের মধ্যেই অস্ফুট কণ্ঠে সে বলল ‘পানি খাব। পানি!’ ঘর ঘর শব্দ করে টিপুর গলাটা অজগর সাপের মত লম্বা হতে শুরু করল। লম্বা হতে হতে মুখটা গিয়ে পৌঁছুল নদীর জলে। চক চক শব্দ করে সে পানি পান করছে। টিপুর গলায় হাত দিলাম; এডামস এ্যাপেলটা উঠানামা করছে। অনুভব করলাম, নদী থেকে পানির একটা স্পন্দিত স্রোত বয়ে চলেছে টিপুর পাকস্থলির দিকে।
ভিক্টোরিয়া, কানাডা
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন
প্রবন্ধ : চিরায়ত বলবিদ্যা থেকে অপেক্ষবাদ - হাসান গোর্কি
-
গল্প//উপন্যাস
-
20-06-2017
-
-