অটোয়া, রবিবার ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
করোনা- সভ্যতার ফিরতি পথ - অমিতায়ু চক্রবর্তী

     সুজান সণ্টাগ তার ‘ইলনেস অ্যাজ মেটাফর’ গ্রন্থের শুরুতে বলেছেন, অসুখ আমাদের প্রাত্যহিক যাপনেরই একটি অনালোকিত দিক। বস্তুত মানুষ তার অজান্তেই সুখ ও অসুখের সমান্তরাল রাজ্যের দ্বৈত নাগরিকত্ব ভোগ করে। সুখটা প্রাধান্য পায় শুধুই ব্যক্তিগত রুচির অবকাশে। সুজানের এই বক্তব্য থেকে দুটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। প্রথমত, অসুখ কোন আধুনিক আমদানি নয়, তা প্রাচীনকাল থেকেই জীবনের একটি অবহেলিত অথচ অবিচ্ছেদ্য উপাদান এবং দ্বিতীয়ত, যেহেতু আমাদের জীবনে অসুখের দিকটি আলোক বঞ্চিত, তাই তা আজও সভ্যতার শুরুর দিনের মতই আদিম ও প্রায়-অনাবিষ্কৃত। 
     ইতিহাস পুরোনো দিনের গল্প বলে। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন এমন মানুষ মাত্রেই একথা জানেন যে ইতিহাস পাথুরে প্রমাণের ও প্রাসঙ্গিক অনুমানের ওপরে ভিত্তি করে রচিত হয়। কাজেই যেসব প্রশ্নের উত্তরে পাথুরে প্রমাণ থাকে না, সেখানে ইতিহাস আশ্রয় নেয় যুক্তিসম্মত কল্পনার। জন লক নামক একজন দার্শনিক আদিম পৃথিবীর মানবসমাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, সেসময় মানুষ ছিল সহৃদয়, নির্লোভ এবং শান্তিপ্রিয়। কার্ল মার্ক্স নামে অপর এক দার্শনিক এই আদিম শান্তির তত্ত্বটিকে খারিজ করে, আদিম সংঘাতের তত্ত্ব দেন। প্রসঙ্গত, বলা যেতে পারে অ্যাডলফ হিটলার নিজের আত্মজীবনীতে স্পষ্ট অক্ষরে একথা জানিয়েছেন, যুদ্ধই মানুষকে মহান করেছে, শাশ্বত শান্তিতে তার বিনাশ ঘটবে (Mankind has grown great in war. It will decay in eternal peace)। মার্ক্স ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণের এলাকা ছেনে একথা প্রমাণ করেছেন, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্যে দিয়েই মানবসভ্যতা পথ চলেছে অতএব সহজেই অনুমান করা যেতে পারে, আদিমকালেও এই একই ধারা অব্যাহত ছিল, একেবারে বিপ্রতীপ কোন ঘটনা সেখানে ঘটেনি। 
     এই মুহূর্তে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মানুষ গৃহবন্দী। এর মধ্যে ব্যতিক্রম থাকলেও উন্নততর প্রযুক্তির এই যুগেও আজ পৃথিবীর কোন মানুষের অনুমতি নেই তার নিজের বর্তমান বাসস্থান ছেড়ে অন্য কোন দেশে পাড়ি জমাবার। দ্রুতগামী এরোপ্লেন, জাহাজ যাতে কয়েকঘন্টার মধ্যে কোন মানুষের পক্ষে এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে, এমনকি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব, সেই সব উপকরণগুলি থাকা স্বত্বেও মানুষ আজ বন্দী। অদরকারে দূরস্থান, নিতান্ত দরকারেও তার আজ এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাওয়ার উপায় নেই। 
     ইতিহাস যে আদিম যুগের গল্প আমাদের জানায়, সেখানেও পরিস্থিতি কিছুটা এরকমই ছিল বলে আন্দাজ করে নেওয়া হয়। তুষার যুগে যখন পৃথিবীর জলভাগগুলি জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল, তখন সেই জমাট সমুদ্রের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে মানুষ এবং মানবেতর আরও অনান্য প্রাণী সারা পৃথিবীর সমস্ত ভূখন্ডগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে মনে করা হয়। তুষার যুগের আগে এই অগাধ জলরাশি পার করার কোন উপায় ছিল না মানুষের হাতে। আর আজ, এই একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হাতে থাকা স্বত্বেও মানুষ একইভাবে বন্দী। মানুষ যেন ফিরে গিয়েছে সেই আদিম যুগে। তার সমস্ত আহূত জ্ঞান, প্রযুক্তির জোর আজ যেন থেকেও নেই। 
     এবারে তাকানো যাক মানুষের মনের অন্দরে। মার্ক্স আদিম মানুষের সমাজের যে ছবি বর্ণনা করেছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেন, মানুষ ছিল সন্দেহপ্রবণ এবং কলহপ্রিয়। ইতিহাসের পাথুরে বা কাগুজে প্রমাণের যুগেও আমরা দেখি, বিদেশ থেকে আগত অচেনা মানুষ বারবার সন্দেহ ও রোষের শিকার হয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে। এবারে ফিরে দেখা যাক বর্তমানে। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার নিদান অনুযায়ী, রাস্তায় চলাচলের সময় মুখে মাস্ক ব্যবহার অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এই মাস্ক পরার ফলে আমাদের অতি পরিচিত মুখগুলিও হঠাত করে অচেনা বলে মনে হচ্ছে। আমরা সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছি আমাদের অতি পরিচিত প্রতিবেশীর দিকেও। সন্দেহ অচেনার, অজানার। আর অচেনা অজানাকেই ভয় পাই আমরা, অকারণেই আক্রমণ করি তাকে। মানুষ এত আধুনিক হয়েও মুক্তি পায়নি তার এই আদিম স্বভাব থেকে। আমরা আজও তাই চিনতে না পেরে সন্দেহ করছি আমাদের নিকটজনকে। সভ্যতা যত এগিয়েছে, মানুষ বুদ্ধি আর প্রযুক্তির বলে বলীয়ান হয়েছে, ততই বদলে গিয়েছে তার কাছে নৈকট্যের সংজ্ঞা। নৈকট্যের পরিধি বাড়তে বাড়তে আজ বিশ্বমানবতা, বিশ্বভাতৃত্বের মত শব্দ জলভাত হয়ে গিয়েছে আমাদের প্রাত্যহিক ব্যবহারে। সেই আধুনিক সমাজে আগন্তুক এই অতিমারি, এই জীবাণু খুব অল্পসময়ে আমাদের আবার পিছিয়ে দিয়েছে নৈকট্যের সেই আদিম ধারণায়। আর তাই আজ আমরা আমাদের সঙ্গে এক ছাদের নীচে বসবাসকারী পরিবার বা পরিজন বাদে আর সকলকেই অবিশ্বাস করছি, সন্দেহ করছি, ভয় পাচ্ছি। এমনকি সেই ভয়টাও আদিম ও অকৃত্রিম। মৃত্যুভয়। ভয় আক্রমণের নয়, সংক্রমণের। তবু ভয়। বিশ্বজনীনতা এক লহমায় মিথ্যে করে ফের আদিম বেঁচে থাকার লড়াইতে নেমে পড়েছে গোটা মানবজাতি। যেখানে শুধুই সে বাঁচতে চায়, সঙ্গে বাঁচুক বড়জোর তার নিজের পরিবার। বিশ্বকে নিয়ে ভাবার সময় আজ আর তার নেই। যেমন ছিল না সেই আদিমযুগে। কয়েক শতাব্দীর পার করে আসা পথ যেন কয়েক মাসেই পিছু হেঁটে ফিরে গিয়েছি আমরা। ফিরে গিয়েছি সেই আদিমতায়, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এই পথচলা। সঙ্গী শুধু প্রগতির, উন্নতির, সভ্যতার প্রাণহীন কিছু অকেজো কঙ্কাল। 

অমিতায়ু চক্রবর্তী
সোদপুর, কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ।