অটোয়া, বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
সোনার রাজহংসী - অনিক সুমন

     ১. 
     কালরাতে ঘুমের ভীষণ ঘোরে তাকে স্বপ্ন মাঝে দেখাটা ছিলো যতটা বিস্ময়ের তার চে' নিতান্ত অর্থহীন। কেননা তার সাথে আমার সম্পর্কটা চুকেবুকে গেছে সে বহুদিন আগেই। মাঝে বছর চারেক গড়িয়ে গেছে খুব দ্রুত, শশব্যস্তের মতো। মনে পড়ে- এইতো সেদিন, তার হাতে হাত চেপে কলেজের কড়িডোরে ঘুরে বেড়িয়ে ছিলাম বেশ, বেপরোয়া কপোতের মতো। তার কাঁধের কাছে গোলাপ ফুলের অশেষ ঘ্রাণটুকু আজ ও আমার কাছে জীবন্ত, সজীব মনে হয়। অথচ আমি তার  কাঁচের মতো স্বচ্ছ স্কন্ধদ্বয় ক'বার স্পর্শ করেছি গণনা করতে গিয়ে চাতকের মতো হা পিত্যেশ করতে হয়েছে। তার চুলের নাব্যতা নিয়ে আমার লেখা কবিতাগুলো, কতটা কল্পনা আর কতটা বাস্তব সে ব্যবধান আমি ঘুচোতে পারিনি আজ ও। অথচ তার শরীরের সজিবতা আমাকে চাবুকের মতোই স্পর্শ করতো, নির্মমভাবে; অনেকটা তার ভালোবাসার মতোই-লেপ্টে থাকে, পুরনো ক্ষত যেনো, দেহ চর্মের স্তরে স্তরে।
     অতএব তাকে স্বপ্ন মাঝে অকস্মাৎ দর্শণ আমাকে উদ্বেলিত করে না, যতটা করে বিহ্বল। আমার ঘর্মাক্ত দেহের স্বেদবিন্দু ক্রমাগত শুকোতে থাকে। তারি সাথে বিজন রাতে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসাটা ক্লান্তিকর মনে হতে থাকে। আমি একসময়ে হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়ি অথবা জেগেই থাকি স্থানুবৎ। 
     খুব মনে পড়ে, আমার 'নীল পড়ী' কবিতাটি কলেজ সাময়িকীতে প্রকাশিত হলে পরে তা কলেজ প্রাঙ্গনে বিতর্কের ঝড় তোলে। নীল পড়ীর পরিচয় উদঘাটন, পরীক্ষা পাশের মতোই অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় আমার বন্ধু ও সুহৃদবর্গের মাঝে। অতঃপর আমি তার নামাঙ্কিত করি নীলা - সে হয়ে ওঠে আমার একান্ত  নীলাঞ্জনা। যাহোক, বিষয়টা মনের অগোচরেই পড়ে থাকে বহুদিন।
     এক সময় অজান্তেই তার হৃদয়ের অলি গলিতে আমি অন্ধের মতো পথ হারাই। অতএব পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়াটা, আমার কাছে, পঙ্গুর গিরি লঙ্ঘনের মতো দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে পড়ে। আমার কবিতার তোড় যত বাড়তে থাকে, ডায়েরীর সাদা পাতা তত ভরে যেতে থাকে কলমের কাল কালিতে কালিতে। আর তখন পরীক্ষার সাদা পাতা সাদাই থেকে যেতে থাকে ক্রমাগত। এক সময় আমার অন্যমনস্কতা সন্যাসীর মতো চূড়ান্ত রূপ নেয়।
     অথচ নীলার সাথে প্রথম পরিচয়টা ছিলো নিতান্তই সাদামাটা। ক্যাম্পাসে পদার্পনের সপ্তাহ খানেকের মাঝে, হাওয়ায় উড়তে থাকা কোনো ঝরা পাতার মতো এলোমেলোভাবে তার নামটা আমার কর্ণগোচর হয়। একজন সুন্দরী, মেধাবী হিসেবে সে ততদিনে ক্যাম্পাসে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। তথাপি তার সাথে সাক্ষাতে আমি উৎসাহহীন থাকি। অথবা একাধিক অগ্রগন্য বিষয়ের মাঝে নীলা অনায়াসে বিস্তৃত হয়। 
     সেমিস্টার শেষে শীতকালীন ছুটিতে সবাই ক্যাম্পাস ছেড়ে গেলে ও আমি হোস্টেলেই রয়ে যাই, একটা চাকুরিতে জড়িয়ে পড়ার সুবাদে।
     পার্কের মরচেধরা রঙের কাঠের বেন্চিতে বসে শীতের হিমেল হাওয়া আমার চুল এলো-মেলো করে দিত, আর বিস্রস্তের মতো পুনঃপুন নীলার মুখাবয়ব আমার ভিষণ রকম মনে পড়ত। যদিও সেটা ভালবাসা নামক অদ্ভুত বস্তু নাকি নিঃসঙ্গতার নীরব প্রতিশোধ সে সংশয় আমার কাটে না কিছুতেই। তদুপরি তাকে আমার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে খুব এবং সেটা হঠাৎ করেই যেন।
     আমার কাঁধে তার হেলানো কোঁকরা চুলভর্তি মুখাবয়বটা কল্পনা করতেই করতেই একসময় ছুটি শেষ হয়ে আসে। বন্ধুদের তুমুল আড্ডা আর চা-সিগ্রেটের তোড়ে ভেসে যেতে সময় বেশি নেয়নি আমার ভাবালু মনের দুর্বলতা। তদ্দিনে আমি এসবকে স্রেফ মানসিক দু্র্বলতা হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছি।
     জীবনে যেনো বিস্ময়ের কোনো সীমা বা পরিসীমা নেই, ঠিক তেমনি ভাবে একটি দুরান্তর বিষয় কিভাবে যেনো নীলাকাশে মেঘের ভেসে বেড়ানোর চেয়ে ও সহজভাবে, নিশ্বাসের মতো নিকটতম  এবং বিশ্বাসী হয়ে উঠে। 

     ২.
     কোনো এক জটিল শারীরিক দুর্যোগে নীলার হঠাৎ হসপিটালে ভর্তি হওয়া’টা সন্দেহ নেই, আমাকে যথেষ্ট বিচলিত করে। তার রক্ত স্বল্পতার বিষয়টি চিকিৎসক নিজমুখে আমাকে জানালে, আমি সন্দেহাতীতভাবে বিমর্ষ হয়ে পড়ি। নীলা এবং আমার রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়া এবং রক্তদানে তার দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠাটা, আমার জীবনের সুন্দরতম মুহুর্তগুলোর মাঝে অন্যতম।
     সে সুস্থ হয়ে গার্লস হোস্টেলে ফিরে এলে, তার দেখভালের গুরু দায়িত্বটা আমি যেচে নিয়ে নিই। ইচ্ছেমতো গার্লস হোস্টেলে যাওয়াটা মোটেই সহজ ছিল না। সে যাহোক, এরপর ঘনিষ্ট হয়ে পড়াটাই ছিল স্বাভাবিক এবং তাই হয়।
     পুবের আকাশ আলতো কলাপাতা ফুলের মতো ফর্সা হয়ে এলে পরে আমি দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি। পুরনো কাসন্দি ঘাটাঁটা আমার চিরকালের অপছন্দের। আমি বরং ম্যাক্সের (আমার পোষা কুকুরের নাম ম্যাক্স) খাবার সাজাতে রান্নাঘরে যাই। সে খুব ভোরে উঠে পড়ে। সাধারণত রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আমি পটে তার কুকিজগুলো রেখে দিই, গতকালই হঠাৎ তার বাত্যয় হয়।
     কাল বিকেলে অফিস ফেরার পর, আমার ভীষণ মাথা যন্ত্রণা করতে থাকে। ক্যাড সফট্ওয়্যারটি কাজ করছিল না ভালোভাবে,  ড্রাফটিং স্কেলটি ভেঙ্গে গিয়েছে, সপ্তাহ খানেক হলো -বিচ্ছিরি অবস্থা। কয়েক পেগ্ হুইস্কিতে গলা ভিজিয়ে তড়িৎ বিছানায় শরণাগত হই। একটা বিভৎস সকালে অসন্তুষ্ট ক্লায়েন্টের সাথে বচসা, দুপুরে লান্চ আওয়ারে পার্টনারের সাথে কথা-কাটাকাটি -যাচ্ছে তাই। আর্কিটেক্ট ফার্মটির হাল হকিকত ইদানিং বড্ড খারাপ। হাতে তেমন কোন প্রজেক্ট নেই বললে চলে।  গতবছর  একটা বাজে প্রজেক্টে চড়া মাসুল এখনো গুনে যেতে হচ্ছে। মার্কেটে ফেসভ্যলু হঠাৎ পড়ে গেলে, চড়ানো সহজ নয়। ইদানিং স্টুডিও থেকে বের হয়ে সলো কিছু করার চিন্তাটাই ভাবাচ্ছে বেশী। 
     ক্লায়েন্টের ফরমায়েশ, অযাচিত শিশু সুলভ বায়না, লেট পেমেন্ট ইত্যকার নানাবিধ বিষয়ে মেজাজ খিঁচড়ে উঠেছে, তা বলাই বাহুল্য। টিভিতে নানা রকম কুকিং শো দেখে একপ্রকার নেশা হয়ে গিয়েছে, আজকাল তাই, সবছেড়ে ছুড়ে শেফ্ হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কখনো কখনো মাথা চাড়া দিচ্ছে ভিষণ। আর্কিটেক্ট জীবনের প্রতি এক ধরনেরর বিচ্ছিরি অনুভুতি ঘিরে ধরেছে, শ্যওলাজমা পিচ্ছিল পুকুর ঘাটের মতো।
     নীলার সাথে সম্পর্কাবসানের দ্রুততা আমাকে অবাক করে ছিলো সন্দেহ নেই। কলেজ পেরুনোর পরে, আমাদের ভালোবাসার রং ফিকে হয়ে এলে ও, আমরা একে অপরের বেশ দেখভাল করতাম, অনুরাগী ও ছিলাম বলা যায়। কিন্তু নানাবিধ ব্যস্ততা আমাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছিল, হয়তো বা আমরা দূরেই সরে যেতে চেয়ে ছিলাম একে অপরের থেকে। পুরো বিষয়টা একসময় পোষাকি হয়ে দাঁড়ায়।
     নীলার জীবনে অপর কারো ছায়া সব সময়ই ছিলো। আমাদের চূড়ান্ত একান্ত মুহুর্তে ও তাকে আমি অন্যমনস্ক হয়ে যেতে দেখেছি। এক সময়ে নিজেকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হতে থাকে। মনে হচ্ছিল একটা পাখিকে অনেকটা যেনো নিজ প্রয়োজনে আমি খাঁচায় পুরে রেখেছি, তাও জোর করেই। ভাবলাম, এর অবসান হওয়া উচিত। উচিত, পাখিটিকে আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মতোই উড়তে দেয়া। আমরা শেষাবধি একে অপরের পরিপূরক হতে পারিনি, সে ব্যর্থতা আমার যতোটুকু, তার ও কম কিছু নয়। অথবা তার ফানুসের মতো অনুরাগকে ভালোবাসার শক্ত দেয়াল মনে করে, আমি নিজেই নিজেকে কারাবন্দী করে ছিলাম, যার একটা দ্রুত সুরাহা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সে অর্থে 'অবাক' হওয়াটা অতি রঞ্জন বলা চলে। বলা যায়, 'ইট্ জাস্ট ওয়াজন্ট মিন্ট টু বি হ্যাপেন্ড '।  

     ৩. 
     নীলা কখনো প্রফেশনাল আর্কিটেক্ট হতে চায়নি। তার আর্কিটেক্ট কলেজে ভর্তি হওয়াটা নিতান্তই এক্সিডেন্টাল বলা চলে। তার নার্শারীর প্রতি অনুরাগ ছিল, প্রকৃতি ভালোবাসত ভীষণ। সবুজ দুর্বা ঘাসে পায়ের গোড়ালী অব্দি ডুবিয়ে চলা ছিল তার খুব পছন্দের। ফুল নিয়ে খেলতে ভালোবাসত, প্রায়শই খোঁপায় ফুল গুঁজে সোজা চলে আসত ক্যাম্পাসে। তার ব্যক্তিগত অবস্থান ছিলো, ইট, কাঠের, পাথুরে আর্কিটেক্ট জীবনের সাথে সাথে একদম বেমানান। সন্দেহ নেই, তার প্রাণহীন কাজে রেজাল্টের ও সেরূপ অধোগতি ঘটতে থাকে।
     আমি প্রথম যে ফার্মটিতে জয়েন করি, তা ছিলো আমাদেরই একজন স্যারের যিনি কলেজ জীবনে আমাকে ব্যক্তিগত ভাবেই পছন্দ করতেন। সেখানে স্যারকে বলেকয়ে আমিই নীলাকে নিয়ে আসি। কিন্তু কাজের প্রতি (এবং কিছুটা আমার প্রতি ও) তার উন্নাসিকতা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। তো তাকে একদিন কফিশপে নিয়ে গিয়ে বকাঝকা (যেটা আমাকে করতেই হয়েছিল স্যারের অনুরোধে) করলাম বেশ। হয়তোবা একটু মাত্রা ও ছাড়িয়েছিলাম (আমাদের তলানিতে ঠেকা সম্পর্কটা এরমাঝে অন্যমাত্রা যোগ করে ছিল সন্দেহাতীত ভাবে)। যা ভেবেছিলাম, নীলা তার উল্টোটাই করে বসে। নিজেকে আরো শাণিত করার পরিবর্তে, সে চাকুরীতেই ইস্তফা দেয়।    
     তার আলসেমীতে ভরা কাজ করাটাকে স্যার কতোটা পছন্দ করতেন বোঝা যায়, সে চলে যাওয়ার পর। স্যার নিত্য আমার কাছে তাকে ফের নিয়ে আসার জন্য অনুযোগ করতে থাকলেন। বরাবর নানা ছুতোয় এড়িয়ে যেতে থাকলাম আমি। আফ্টার অল নীলাকে ধমক দেযার পরিকল্পনাটা স্যারের সাজানো ছিল।
     স্যারকে বোঝাতে ব্যর্থ হলাম যে, প্রকৃতপক্ষে নীলার এ পেশার প্রতি কোন আর্কষণই নেই; এখানে ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ই নেই। সে আগে কিংবা পরে হোক, কাজটি ছেড়েই দিত। স্যার নাছোড়বান্দা। আমি ও নীলাকে অনুরোধে অনাগ্রহী (আমাদের সম্পর্ক তদ্দিনে একপ্রকার শেষ বলা চলে)। প্রাক্তন প্রেমিকার রোজ কায় অফিসে মুখোমুখি হওয়া -বিষয়টি ভীষণ অস্বস্তির এবং আমি চাইছিলাম না তা ঘটুক (সে ও হয়তো তাই চাইছিল অন্তরালে)।  
     স্যারই একদিন ব্যাপারটা খোলাসা করলেন (অনেকটা যেচে পড়েই)। সংক্ষেপে ব্যাপারটা যা দাঁড়ায়, তা অনেকদিন এরূপ -বেশ কয়েক বছর আগে স্যারের একমাত্র মেয়েটি রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। কিছুটা মুষড়ে পড়লেও স্যার নিজেকে ঠিকই সামলে নেন। কিন্তু স্যারের স্ত্রী একেবারেই নুয়ে পড়েন কোনো লতা গাছের মতো। কোন এক অনুষ্ঠানে (যার ব্যাপারে আমি সম্যক অবগত নই) স্যারের স্ত্রী'র সাথে নীলার আলাপ হলে পরে, নীলাকে তার ভীষণভাবে ভালো লেগে যায়- যেনো  আকাশের চাঁদ হেসে উঠলো তার নিঃসীম শুন্যতায়। নীলাকে তিনি নিজের মেয়ের মতো করেই পেতে চাইছিলেন।
     তা বেশ তো। ফোন করলেই হয়। আমাকে ঘাটানো কেন এসবে আবার?  
     আমি চিরকালই সস্পর্কের এসব আঁকিবুঁকি থেকে দূরে থাকতে চাইতাম (সন্দেহ নেই, নীলাই ছিলো, আমার প্রথম প্রেম)। কাজের দোহাই দিয়ে, আমি ঘরের বাইরে থাকাটা পছন্দ করতাম বেশ। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, আর স্টুডিওতে ডিজাইনের কাজ -'নীলা বিহীন' জীবন আমার মন্দ কাটছিলো বলাটা ভুল হবে। বরং ডিজাইন জীবনের ব্যস্ততা, নীলার অনুপস্থিতিটা আড়াল করেছিলো ভালোই। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছিলো তটে আর মুছে দিয়ে যাচ্ছিলো পুরনো সম্পর্কের সব বলীরেখা, ধীরে ধীরে। এত সহজ এবং সাবলীলভাবে যে, মানুষ শেষাবধি পরাজিত হয় না, জিতেই যায়। জীবনই তাকে হারতে দিতে চায় না, অথবা বেঁচে থাকার অফুরান আকুতি  মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, সে যে কোনো এক ভাবেই হোকনা কেন।

     ৪. 
     স্যার শেষাবধি নীলাকে ফেরাতে ব্যর্থ হন, যার কিছুটা অভিদোষ আমার উপরে ও চেপে বসে, ফলস্বরূপ স্যারের সাথে কাজ করাটা অসম্ভবপর হয়ে পড়ে। আরেকবার চাকুরী বাগিয়ে নেয়াটা কঠিন কিছু ছিল না কিন্তু আমি নিজেই চাইছিলাম, নিজের একটা প্রতিষ্ঠান হোক, একটা স্টুডিও মতো। 'ইন এন আইডিয়াল ওয়ার্ল্ড নীলা কুড্ হ্যাভ বিন মাই পার্টনার'- আমি এভাবেই ভাবতাম। সেটা তো আর হওয়ার নয় -সে নিজেই যখন প্র্যাকটিস্ করবে না সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। তার সাথে শেষ বারের দেখায় (স্যারের অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতোই) নিস্তব্ধতা এমনভাবে জেকেঁ বসেছিল যে, আমরা দুজনেই নিরুপায় ছিলাম, আর ভাবছিলাম কিভাবে ভাঙ্গা যায়, এ দেয়াল। সে যন্ত্রণা বেশিক্ষণ টেকেনি, স্যার নিজেই হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেন আমাদের মাঝে।
     নীলা বরাবরই ভনিতাহীন মেয়ে যা আমাকে আর্কষণ করতো ভীষণ। হয়তো সে কারনেই, স্যার তাকে বড্ড বেশি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে আগেই মনঃস্থির করে রাখা মেয়ে, যার ঝাপটা আমাকে ও সইতে  হয়।
     সে যাহোক, এরপর তার সাথে আমার বিশেষ কোনো যোগাযোগ ছিলো না। তার বিয়ে হওয়া এবং ভেঙে যাওয়া -দুটোই আমি জানতে পারি বন্ধু মারফত। আমার ভীষণ খারাপ লাগে, তদুপরি আমি যোগাযোগের পুনঃ উদ্যোগ নেওয়া থেকে বিরত থাকি। আমি জানতাম সে শক্ত মনের মেয়ে এবং সে নিজেই জানে তার কি করার প্রয়োজন। আমার উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করতে পারে বরং। ভাবতে পারে, আমি একজন সুযোগ সন্ধানী, যা আমি চাইছিলাম না। আর নিজস্ব ফার্ম ওপেন হওয়ার সুবাদে, আমার ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিলো অনেক। একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা চাট্টিখানি বিষয় ছিল না। যদিও আমরা তিনজন পার্টনার নিয়ে কাজটা শুরু করি, মূল উদ্যোগ যেহেতু আমারই ছিল, প্রজেক্ট সফল করার দাযিত্বটা আমার উপরেই চাপে। বলা বাহুল্য, একসময় আমি তাকে ভুলে যাই, অনেক স্মৃতির মাঝে সে উইপোকার মতো আটকে পড়ে বিবর্ণ হয়। 
     আমি অবিবাহিত থেকে যাই, কাজের ব্যস্ততা আমাকে রাহুর মতো গ্রাস করে। কর্মসূত্রে দু'একজন সুন্দরীর সাথে যোগাযোগ হলেও কারোর সাথেই তা টেকে নি বেশিদিন -শীতকালীন পরিযায়ী পাখিদের মতো তাদের আগমন এবং সাত তাড়াতাড়ি প্রস্থান। ডিজাইনের কাজে আমি আরো বেশি করে মনোনিবেশ করি; এমনকি আমার  উইক এন্ডগুলো কেটে যেতে থাকে, নানা প্রজেক্টের ডিটেইলিং করার মাঝে।  
     বিয়ে নিয়ে যে চিন্তা করছিলাম না, এমনটা  নয় -তবে তা মায়ের হাতে ছেড়ে দেয়া সমীচীন মনে হলো।
     জীবনের নিস্তরঙ্গতার খোলস যেমন বেশিদিন টেকে না, ঠিক তেমনি ভাবে কয়েকটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার ছাঁট, ঠিকই আমাকে ভিজিয়ে দিল -হঠাৎ নামা বৃষ্টির মতো।
     প্রথমত গেল বছরে, একটা প্রজেক্টে (যেটাতে আমার অনীহা ছিল ভীষণ) আমাদের ট্রাইপড্ ফার্মের সাথে ক্লায়েন্টের দেনাপাওনা নিয়ে ঝামেলা হলো বড় রকমের। কোর্ট কাচারি ও হয়ে যেতো, যদিনা আমি পার্টনারদের বিরত করতাম। ফলাফল - হিতে বিপরীত। পার্টনার আমাকে ক্লায়েন্টের সহোযোগী ভাবতে শুরু করে। এটা মনে করতে থাকে যে, কোর্টে না যাওয়ার পেছনে আমার 'ভেস্টেড্ ইন্টারেস্ট' রয়েছে। আমি, আইসোলেটেড অনুভব  করতে থাকি....  বুঝতে  পারি, ফার্মে আমার সময় দেয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে। জীবনে একটা নতুন মোড়ের পাশে আমি এসে দাঁড়িয়েছি। তথাপি ট্রাইপড ডিজাইন ফার্মটি থেকে সত্বর বেড়িয়ে আসা থেকে আমি বিরত থাকি (আফ্টার অল্, নিজের হাতেই গড়া)।

     ৫.
     এইরূপ পেশাগত ঝামেলার মাঝেই একদিন নীলা ফোন করে আমার সাথে দেখা করতে চায় (সে তা কখনো করেনি, এমনকি আমাদের সম্পর্কের চূড়ান্ত মধ্যগগনে ও আমিই তাকে ফোন করে দেখা করতে চাইতাম)। কিছু টা অবাক হলেও  পরে আমি রাজি হই। সে যথারীতি ভনিতা না করেই, আমার কাছে অর্থ সাহায্য চাইল, এমন সহজ ভাবে যেন এটা তার অধিকার। কারন জানার কিউরিসিটিটা যথাসম্ভব চেপে গেলাম।
     প্রাথমিক কিছুটা অপারগতার দোহাই দিলেও, শেষমেষ সাহায্য করবো বলেই মনঃস্থির করি (পুরনো প্রেম বলে কথা, কিছুটা প্রশ্রয় দেওয়াই যায়)। বিদায়ের মুহূর্তে, নীলার কেন জানি হঠাৎ মনে হলো, কারণটা না জানানো অনুচিত হবে। আমি যতটুকু বুঝতে পারি, তাতে মনে হলো, সে নার্শারী জাতীয়  একটা প্রতিষ্ঠান শুরু করতে চায়, যা জানতে পেরে আমার ভালোই লাগে। নীলা সত্বর টাকাটা রিটার্ন করবে ব'লে প্রমিজ করলেও  আমি চাইছিলাম, টাকাটা সে রেখেই দিক (তার প্রতি আমার দুর্বলতাটুকু রয়েই গিয়েছিল এবং হলফ করে বলা যায়, সে তা বিলক্ষণ জানত)।
     পরবর্তীতে আমি যা জানতে পাই, তা আমাকে হতবাক করেছে বললে, কম বলা হবে। নীলা দেশত্যাগ করে। বলা বাহুল্য, আমার দেয়া পুরো টাকাটা, সে এ কাজেই ব্যবহার করে। সব যেন, বিবর্ণ হয়ে যায়, হঠাৎ করেই... একটা বিশ্বাসের দেয়াল যেন ভেঙে পড়ে আমার উপরে। 
     একই শহরে নীলা ও আমার বসবাস ছিল বলে অনেক কটা রাত আমার কেটে গেছে আনন্দে। আমি শুধু ভাবতাম, 'নীলা, তুমি শুধু  আমার পাশেই থাক... এই শহরে.. ধুলিকণার মাঝে.. রাস্তার পাশে ঝুপড়িতে চা খাওয়ার ব্যস্ততায়.... পুড়ে যাওয়া লোকাল  বাসগুলোর কালো ধোঁয়ার ছোঁয়াতে... কিংবা হকারের হঠাৎ হঠাৎ মোরগের মতো ডেকে ওঠার আজব স্বভাবে।
     আমার মনে হলো, বিশ্বাসের একটা চর যেন ডুবে গেল নদীতে, হঠাৎই।
     নীলার অনেক অন্ধকার দিক ছিল, যা আমার জানার মাঝে ছিল। তবে সে কখনো মিথ্যেবাদী ছিলো না। 'মিথ্যেবাদী নীলার সাথে, সেটাই আমার প্রথম এবং সম্ভবত শেষ দেখা। হয়তো বা, এ জীবনে সে আর কখনো আমার সামনে এসে দাঁড়াতে সাহস করবেনা।
     তবে জীবনের মিরাকল নিয়ে খুব কমই পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব।

     ৬.
     তারপর কাল রাতেই সে হঠাৎ উড়ে আসে আমার স্বপ্নে, প্রজাপতির মতো, কোথা হতে যেন। কৃত অপরাধের জন্য সোজাসুজি ক্ষমা চাইল। তার এভাবে ক্ষমা চাওয়াটা আমার অপছন্দ হলেও তাকে আমি বুকে টেনে নিই। তার ঘন কালো চুল থেকে আজও গোলাপের সতেজ ঘ্রাণ আসে ভেবে, আমি বিস্মিত হই; কিংবা কাঁচের মতো স্বচ্ছ কাঁধ আজো নজরকাড়া চিকচিক করে দেখে হই বিহ্বল।
     সে ঠোঁট ফুলিয়ে আমাকে অনেক কিছুই বলতে চাইল, ইনিয়ে বিনিয়ে। সে বলে -আমি নাকি কোনদিন তাকে ভালোই বাসিনি - পুরোটাই লোক দেখানো। বলে, আমি তাকে দয়ার পাত্র ভেবেছি সবসময় -ভালোবাসার মোহর নয়; যা অসত্য। বুঝলাম অনেক অমিমাংসীত বিষয় রয়ে গিয়ে ছিল আমাদের মাঝে, যার সুরাহা হওয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু হয়নি। এসবের জন্য নিজেকে একাই দোষী মনে হতে থাকে।
     সে যাহোক, আমি তাকে আমার কিছু স্বপ্নের কথা জানালাম। বললাম, একটা ডুয়ো আর্কিটেক্ট ফার্মের বিশদ পরিকল্পনা। এসবই আমার আরো আগেই তাকে জানানো উচিত ছিল -সে অনুযোগ করতে থাকে। তাহলে সব হয়তো অন্যরকম হতে পারতো।
     বলতে বলতেই নীলা আমার কাছে ঘেঁষে আসে, খুব কাছে। তার সুগন্ধি নিশ্বাসে, আমার কপালের চুল উড়তে থাকে পতাকার মতো পতপত করে। তার ঠোঁটের  উপরে জমা স্বেদ বিন্দু নজরকাড়া চিকচিক করতে থাকে, যেনো সূর্যের আলোতে জ্বলছে সাগরের লোনাপানি। বিকেলের শেষ আলো মেপল্ গাছের পাতা চুইয়ে তার শ্বেতশুভ্র চিবুক ছুঁয়ে আমাকেও স্পর্শ করছিল বেশ।
     বিবর্ণ পাথরের বুকে যেন কয়েক গোছা বিস্মিত সবুজ দুর্বাঘাস গজিয়েছে, তেমনিভাবে হঠাৎ ইচ্ছে হলো নীলাকে আবার ভীষণভাবে ভালোবাসি। (সমাপ্ত) 

অনিক সুমন। চট্টগ্রাম