অটোয়া, মঙ্গলবার ১৭ জুন, ২০২৫
বাঁচার লড়াই - প্রদীপ দে

ম্যানগ্রোভের জংলা জমিকে পাশ কাটিয়ে, মাতলা নদীতে নিকষ কালো জলে ডিঙি বেয়ে বেয়ে চলা। ঢালি আর মুন্নি ভাগাভাগি করে দাঁড় টানে, নিশুতি রাতে নিজেদের শরীরকে বিলিয়ে দিয়ে, পেটের টানে, মাছ আর কাঁকড়া ধরার তাগিদে, চার বছরের ভুলোর জন্য, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সামিল হয়ে, হাড় লিকলিকে শক্ত শরীরে, মনের জোড়ে দাঁড় টেনে টেনে, এই ভাটার সময়, চওড়া নদীতে বয়ে চলাই তাদের জীবিকা আর বৈবাহিক জীবনযাপন।  যখন নদীর জল আর আকাশ দুজনে এক সঙ্গে কালো বিভীষিকায় নিজেদের মুড়ে ফেলেছে, যেখানে হাওয়া নিমেষে অন্তরালে লুকিয়ে, গুমোট বৃষ্টির পূর্বাভাস - সেখান সময় দূর্যোগের, এক অপেক্ষমান পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠেছে। মাছ, কাঁকড়া  ধরতে বেড়ানোর সময় ঘর থেকে মাছ ধরার জাল আর কিছু হাতে তৈরী বাঁচবার মারণাস্ত্র নিয়ে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বিপত্তির শুরু। 

করোনার আগ্রাসী  ছোবল, তার উপর জুন মাস, বর্ষা সবে ঢুকেছে, কিন্তু এবছর তার প্রাধান্য তারই দোসর  ঝড়কে সাথী করেছে, যার জোরালো উপস্থিতিতে আদিবাসীদের নাজেহাল অবস্থা। মাটির ঘর মাটি ছুঁতে চায়, চালা আমফানে ছিন্নভিন্ন, এমতাবস্থায় পঞ্চায়েতের দেওয়া একফালি প্লাস্টিক মাথায় তুলে নেওয়া, দড়ি আর বাঁশের জোড়াতালির সঙ্গে নিজেদের ঢেকির বুদ্ধি আর অনেকটাই মেহনত যা ঘাম ঝরানোর ফসল এই টিকে থাকা, মাথা গুজরানোর চার বাই পাঁচের তৈরি করা আস্তানা। 

পরিস্থিতি ঘোরালো নিয়েই বেরোতে হলো। মাছ, কাঁকড়া ধরা যাদের পেশা তাদের কাছে এই মেঘলা পরিবেশে কিছু যায় আসে না। ডিঙিটাই নিজেদের সম্বল, তাও বেশ পুরানো, ঢালির বাবার হাতের তৈরি করা, যেটা শেষ করে তার বাবার আর ওই ডিঙিতে চড়া হয়ে ওঠেনি, বাঘের খাদ্য হয়ে গেছিল নিজেই। এসব এখানের জলভাত, কেউ ভাবেনা। বেঁচে থাকাটাই অবিশ্বাস্য। মরে গেলে শেষ, যে বেঁচে রইলো তার পিছুপানে তাকানোর সময় থাকে না, স্মৃতি বলে কোন শব্দজ্ঞান এদের নেই। জীবন এখানে একটানা চাকায় ঘোরে, চাকা বসে গেলে দ্বিতীয় বিকল্প কিছু অবশিষ্ট থাকে না।

একটা ঠান্ডা হাওয়া অন্যকোথার বারিপাতের গল্প বলছিল। হঠাৎই ঢালি শিহরিত হয়ে উঠলো, দূরে কালো জলে আরো কালোর নড়নচড়নে। মুন্নি ও ঢালির চোখে ভয়ার্ত মেঘ দেখেই সজাগ হলো।  ধারালো দাঁটা তুলে নিল হাতে, চোখ দুটি ক্ষিপ্ত আগুনে জ্বলজ্বল করে উঠলো, হ্যাঁ অনুমান সঠিক - দুর থেকে তাদের ডিঙি নজর করে এগিয়ে আসছে কালো খর্বকায় ডাঙা আর জলের বিভীষিকাটি।

-- কালা দুশমন, কুম্ভীর ----!

কথা শেষ হলো না ঢালির, নিমেষের মধ্যে বিশালাকার ওই জন্তুর আক্রমণে ডিঙি নড়েচড়ে উঠলো, মুন্নি দাঁ দিয়ে এক কোপ বসালো, যতোটা হাত যায়, একবার, দুবার বেশ ভালো আঘাত পেল কুমিরটা, মস্তক খানিকটা  কেটে গেল। আরো ক্ষিপ্র  গতিতে সে ডিঙির নিচে দিয়ে গিয়ে, উল্টোদিকে চলে গেলো, চকিতে মুখ দিয়ে টান মারলো, যেখানে হাল ধরেছিলো ঢালি। ডিঙি উল্টে গেলো। ঢালিও  হাতের হাল দিয়ে মারলো সজোরে, ভালো আঘাত পেল জন্তুটি। চারদিক অন্ধকার, জলে কালো কালো মেঘের কালচে ছবিতে কালো জন্তুটার অস্তিত্ব ঠাহর হতে সময় লাগছিলো, জন্তুটিও সমান সুযোগের অপেক্ষায় দাঁত কামড়াচ্ছিলো। ডিঙি উল্টে বিপদ বাড়লো, ঘরোয়া অস্ত্র আর প্রয়োজনীয় জিনিস নাগালের বাইরে, তদুপরি জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে লড়াই, এতো বড় কথাটার মুখোমুখির সামনে পড়ে গেল দুইজনায়। প্রথমেই ডুব সাঁতার দিয়ে দুজনে একটু দূরে সরে যেতে চেষ্টা করলো, কিন্তু বিশালাকার প্রানীটির সঙ্গে পারা মুশকিল হলো। পিছনে চলে গেছিলো মুন্নি, দাঁয়ের কোপ চালাতে লাগলো অনবরত, সামনে থেকে সরে যাওয়ার আপ্রান লড়াই জারি রাখলো শক্ত সামর্থ শরীরের উত্তরাধিকারী ঢালি। লড়াই বেশ চললো, মুন্নির সঙ্গে কুমীরের, আর নিরস্ত্র ঢালি নিজেকেই বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। জল প্রচন্ড আওয়জে ফুলে ফেঁপে উঠলো, উপরেও মেঘের গর্জন শুরু হয়ে গেছে, বৃষ্টিপাতও শুরু হয়ে গেলো, প্রকৃতির এক বিভ্যৎস রুপ প্রকাশিত। সাহসী মুন্নির আঘাতে জন্তু অনেকটাই কাহিল হয়েছে, এই ভেবে অশান্ত,  ক্লান্ত মুন্নি কিছুটা মূহুর্ত নিরীক্ষণ করতেই, প্রবল বেগে বৃষ্টিপাত শুরু হলো সঙ্গে প্রবল হাওয়া, আর এই অবকাশেই   হঠাৎই প্রচন্ড শব্দে কুমিরটা লাফিয়ে উঠে ঢালিকে ধরার জন্য জলে আছড়ে পড়লো। সচকিতে মুন্নিও দাঁটা ছুঁড়ে দিলো সজোরে, কালো জলে বুঁদবুঁদ করে লাল রক্ত ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠতে থাকলো, নিঝুম রাতে, ভোর হওয়ার অনেক আগেই কাকেরা যেন কোনো অশুভ ইঙ্গিতে ডেকে উঠলো। ভেসে যাওয়া রক্তজলে মুন্নির পরনের সাদা শাড়ি লাল রঙে ভিজে রক্তাম্বর হয়ে উঠলো।

প্রদীপ দে। কোলকাতা