অটোয়া, রবিবার ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
৭৫ এর যিশু.......-এডওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ

     ১ আগস্ট ১৯৭৫, ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লাখ লাখ লোক ক্রুস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছেন।  মূলত, একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতোন।’ ঘাতকের বুলেটের আঘাতে তার বাংলার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মতো বিশাল বুক থেকে রক্ত ঝরেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই রক্ত যেন রক্ত জবার মতো ফুটে আছে প্রতি বাঙালির হৃদয়ে। প্রতিটি রক্ত কণা থেকে এক একটি মুজিব সৃষ্টি হয়ে আজ বাংলার ঘরে ঘরে। তিনি মিশে আছেন বাংলার মাটি, আলো, বাতাস সবকিছুর সঙ্গে।  আজ দৃশ্যত বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অমলিন আমাদের মাঝে প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন। ‘আকাশ বাণী’ সেদিন যা বলেছিলেন তার পূর্ণতা খোঁজার প্রত্যয়ে আজকের লেখা। মূলত, যিশু খ্রিস্ট ও শেখ মুজিবুর রহমান এর আবির্ভাব, কর্মপন্থা ও হত্যা অনেকাংশ মিলে যায়। যদি এমন ভাবে বলি;
বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়,
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোনো উপমায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিল,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলার মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।
  [হত্যাকারিদের প্রতি, শহীদ কাদরী]

     চারিদিকে যখন পাপ ও অত্যাচারে ভরে উঠেছিল, তখন যিশু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি মানবতা ও শান্তির বার্তা দিতে শুরু করেন। তখন ইহুদি ধর্মীয় নেতারা যিশুর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তারা তৎকালীন রোমান গভর্নর পীলাত কে বলেছিলেন যিশুকে সাজা দিতে। পীলাত ইহুদি সমাজপতিদের নিজস্ব আইন অনুযায়ি যিশুর বিচার ও শাস্তিদানের অনুমতি দিলেন। যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যিশু খ্রিস্টের অন্যতম শিষ্য যিহুদা ইস্কোরিয়ত যিশুর সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করার পর যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল।
     তেমনি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম আস্থাভাজন শিষ্য মোস্তাক বিশ্বাসঘাতকতা করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলো। আত্মসীকৃত খুনি মেজর নুর, খুনি ফারুক, রশীদ, ডালিম গংরা সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধুর বাসায় অবাধে যাতায়াত করত। বেগম মুজিবকে তারা ‘খালাম্মা’ ও ‘আম্মা’ বলে ডাকত এবং তার হাতের বেড়ে দেওয়া খাবার খেত। তারা খুব সহজেই এই বাঙালি মহিয়সী নারির স্নেহ ধন্য হয়ে উঠেছিল। বেগম মুজিব তাদেরকে তার নিজের সন্তানের ন্যায় স্নেহ করতেন। মানুষ কত নির্মম, বর্বর ও পৈশাচিক গুণ সম্পন্ন হলে এমন বিশ্বাস ঘাতকের ভুমিকায় নেমে এমন হত্যাকান্ড চালাতে পারে। খুনিরা তাকেও ছাড়ে নাই ঘাতকের বুলেটে রক্তাক্ত অবস্থায় প্রাণহীন হয়ে যায় বেগম মুজিবের দেহখানি।
     যিশুকে মারার আগে যিহুদা ইস্কোরিয়ত তাকে চুমু দিয়েছিলেন। যিশু তাকে বলেছিলেন যা করতে এসেছো তা করো। তেমনি  শেখ মুজিবের সাথে ঘাতকের এতো কূটকৌশল সে কথা তিনি জানতেন! গুরুত্ব দেননি। কেন দেননি? এ কথার উত্তর পাওয়া যাবে তাঁরই এক সাক্ষাৎকারে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা কী? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। সেই সাংবাদিকের পরের প্রশ্ন ছিল; আর সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি আমার দেশের মানুষকে খুব বেশি ভালোবাসি।
     তিনি তো সেই মহানায়ক যিনি বিশ্বাস করতেন, যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারবেন? কেউ তা পারে না। সেই অসাধ্য সাধনে কোনো এক আক্রোশে চেষ্টার ত্রুটি করেনি ঘাতকের দল। যে কারণে সেই ভয়াল রাতে রেহাই পায়নি গর্ভবতী নারী কিংবা শিশু। হত্যা করা হয়েছে পরিবারের সবাইকে। উদ্দেশ্য সমগ্র জাতিকে দুঃস্বপ্নে তাড়িত করে তিমির সময়ে ফিরিয়ে নেয়া। স্বপ্নদ্রষ্টা চলে গেলে কাজটি সহজ হয়ে যায় ঘাতকেরা জানত এ কথা। এই হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং দেশের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত করাও ছিল তাদের আরেকটি উদ্দেশ্য। এভাবেই সদ্য স্বাধীন একটি দেশের মাথা তুলে দাঁড়াবার সমস্ত পথ রুদ্ধ করতে তারা সেই রাতে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে গিয়েছিল।
     ভারতের সাবেক কূটনীতিক শশাংক ব্যানার্জি তার বইয়ে লিখেছিলেন জিয়া ১৯৭৩ সালে আমেরিকায় ৬ সপ্তাহের জন্য ট্রেনিং-এ গেলে সেখানে পাকিস্তানের পুরনো বন্ধুদের সাথে কথা হয় যাদের সাথে সে আগে ট্রেনিং করেছিল। পাকিস্তানের মিলিটারি এটাচি ও সিআইএ-এর সাথে জিয়ার আলোচনা হয়। যেহেতু সেসময় এটা প্রচারিত ছিল যে সিআইএ বা আইএসআই বঙ্গবন্ধুর জন্য ঝুঁকিপূর্ন সেহেতু জিয়ার সাথে তাদের দুজনের বৈঠক বিশেষ ইঙ্গিতবাহী। পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী সতর্ক করলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “ওরা আমার ছেলের মত।”
  “দি বাংলাদেশ মিলিটারি ক্যু এন্ড সিআইএ লিংক” বইয়ে জানা যায় আমেরিকার সাথে ডালিম ভিন্ন ভিন্ন দুইটি তারিখে অভ্যুত্থানের টার্গেট করেছিল। একটি মার্চে অন্যটি আগস্টে। লজিস্টিক সাপোর্ট টেস্টিং ফেইল করায় মার্চের অপারেশনটি ব্যার্থ হয়। মার্কিন দূতাবাস থেকে ৮ পাতার একটি রিপোর্টে এই তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে আরও বলা হয় দেরী করলে অভ্যুত্থান পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যেতে পারে এবং ভারতীয় ও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা মুজিবকে জানিয়ে দিতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ভারতীয় গোয়েন্দা প্রধান ঢাকা এসে মুজিবকে এসব জানালেও তিনি গুরুত্ব দেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, কোন বাঙালি তাঁর বুকে বুলেট মারতে পারেনা।
     বঙ্গবন্ধুকে বন্ধু রাষ্ট্রের গোয়েন্দেরাও সরকারের উৎখাতের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সন্তানতুল্য বাঙালিরা তাঁকে বধ করতে পারে এটা বিশ্বাসই করতে পারে নাই। মুসা সাদিক তখন বঙ্গভবনে কর্মরত। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর সামনে মুসা সাদিককে উদ্দেশ্য করে বলেন, স্যার, বঙ্গবন্ধুর গায়ে আঁচড় লাগার আগে আমার বুক বুলেটে ঝাঝরা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে বুকে টেনে নিয়ে শেখ কামাল, শেখ জামালের ন্যায় সন্তানের ন্যায় আদর করতেন। বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কেন সেনাবাহিনীর আক্রমনের ব্যাপারে সন্দিহান থাকবে? যেখানে আছে সেনা প্রধান আছে শফিউল্লাহ ও উপ-সেনা প্রধান জিয়ার মত ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুর বিশাল হৃদয় জুড়ে ছিল বাঙালিদের জন্য ভালবাসা, তিনি যেমন ভনিতা করতেন না ঠিক তেমনি খুব বেশী বিশ্বাস করতেন সবাইকে। তার এই খাদহীন ভালবাসার সুযোগের অপব্যবহার করল খুনি চক্র। 
     যিশু খ্রিস্টের অন্যতম শিষ্য যিহুদা ইস্কোরিয়ত এর সহায়তায় মন্দিরের রক্ষীদল গেৎশিমানি উদ্যানে যিশুকে গ্রেপ্তার করে। যিশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পুরস্কার স্বরূপ যিহুদাকে ৩০টি রৌপ্যমুদ্রা দেওয়া হয়েছিল। তেমনি ৭৫ পরবর্তি সময়ে মোশতাক-জিয়া গংরা খুনিদের ইনডেমিনিটি এ্যাক্ট দ্বারা পুরুস্কার হিসেবে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলো। 
     হাজার বছরের কাঙ্খিত যে লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের মাধ্যমে। ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকান্ডের পর  মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী গোষ্ঠী ক্ষমতায় এসে সংবিধানে কাটাছেড়া করে এমন এমন কাজ করা শুরু করলেন, যা আমমহানাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি। এ হত্যাকান্ডের পেছনে শুধু দেশীয় নয়, বিদেশী কুচক্রী গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল। ইয়াহিয়া খান আক্ষেপ করে একসময় বলেছিলেন, তার জীবনে দুটি ভুলের মধ্যে একটা শেখ মুজিবকে হত্যা না করা, অন্যটা ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা দেওয়া। স্বাধীনতার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে ভুট্টো তিন বছর টাকা ও মেধা ঢেলেছেন। এ থেকে সুস্পষ্ট, এই হত্যাকান্ড ছিল দুর্ভিসন্ধিজাত বাঙালিদেরকে নিয়ে সব সময় ভাববার মহান নেতা স্বাধীনতার মহানায়ক আমাদের জাতির জনককে তারা নির্মম ভাবে হত্যা করে ফেললো। জাতি হারালো তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে, দিশাহীন হয়ে গেল বাঙালিরা। বিশ্ব পরিমন্ডলে আমাদের লেগে গেল বিশ্বাস ঘাতকের তকমা। যেখান থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদেরকে তুলে ধরছেন অনন্য উচ্চতায়। আমি শ্রদ্ধাবনত মস্তকে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও বীরাঙ্গনা মা-বোনদের। স্মরণ করছি ১৫ আগস্টে নিভে যাওয়া প্রদীপ গুলোকে যারা কিনা আজ আমাদের আকাশে নক্ষত্র হয়ে আলো দিতে পারতেন। লেখকরা কেন কোন লেখা উৎসর্গ করে আমি জানিনা। আমি কোন তেমন লেখকও না। তবে আমার এই ধারাবাহিক লেখাটি যদি একজনেরও ভাল লেগে থাকে তাহলে আমি এই লেখা উৎসর্গ করছি ছোট্ট রাসেলের নামে। আজ বেঁচে থাকলে সে আমার থেকে বয়সে অনেক অনেক বড় হত কিন্তু এখন তো সে আমাদের সবার কাছেই ছোট্ট রাসেল, তাইনা?

জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু।
এডওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ


এডওয়ার্ড রিয়াজ মাহামুদ
-লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মী।